আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন না সুন্দরবনের পরিবেশের উপর হিংস্র হায়েনার থাবা?

যে মুখ নিয়ত পালায়......। । বর্তমান সরকার ভারতের সহযোগীতায় সুন্দরবনের বাফার জোনের চার কিলোমিটার দূরে রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি চূড়ান্ত করেছেন। তেরশো বিশ মেগা ওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন হবে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রথম কথা বাফার জোন কি? বাফার জোন হল সংরক্ষিত এলাকা জঙ্গলের পশুপাখির জন্য।

সাধারনত এই ধরনের জায়গায় যাতে নিশ্চিন্তে পশু পাখি বসবাস করতে পারে এজন্য ব্যবস্থা রাখা হয়। এই সব পশু পাখি বন ও পরিবেশের জন্য অপরিহার্য। তো সুন্দরবনের ও এমনি বাফার জোন আছে। যেখানে বনের পশুপাখি থাকে। এই বাফার জোনের চার কিলোমিটার মাত্র দূরত্বে নির্মান করা হচ্ছে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে।

অর্থাৎ কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হবে। কয়লা প্ল্যান্ট কাজ করে মোটামোটি এভাবে- কয়লার মধ্যে থাকে জমা রাসায়নিক শক্তি। তা অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ায়(মানে জ্বলে) তাপ শক্তি,মেকানিকাল এনার্জি এবং সবশেষে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করে। বেশ সহজ হিশাব। তবে বিদ্যুৎ উৎপন্নের সাথে প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ উদগীরন করে এই কয়লা প্ল্যান্ট।

ধারনা করি এই পুড়ানো কয়লার ধোঁয়া চার কিলোমিটার আশপাশের বন, গাছপালা, পশুপাখির উপর মারাত্বক প্রভাব ফেলবে। কয়লার ধোঁয়াতে থাকে সালফার ডাই ওক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, মার্কারি ইত্যাদি। আমেরিকায় সর্বোচ্চ পরিমান সালফার ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয় কয়লা ভিত্তিক প্লান্ট থেকে। যদি প্ল্যান্টে ডি সালফারাইজেশনের ব্যবস্থা রাখা হয় ফ্লু গ্যাস দিয়ে তবুও প্রতি বছর সালফার ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয় ৭০০০ টন। আর ডিসালফারাইজেশনের ব্যবস্থা না থাকলে উৎপন্ন হয় বছরে প্রায় ১৪১০০ টন।

এই সালফার ডাই অক্সাইড মানুষের ক্ষতি তো করেই তার চেয়ে মারাত্বক ব্যাপার এসিড রেইনের সৃষ্টি করে। এসিড রেইন বনভূমি এবং পশুপাখির জন্য ভয়ংকর। একটি অনিয়ন্ত্রিত কয়লার প্লান্ট থেকে বছরে নাইট্রোজেন অক্সাইড উৎপন্ন হয় প্রায় ১০৩০০ টন বছরে। আর নিয়ন্ত্রিত হলে ক্যাটালাইটিক রিডাকশনের মাধ্যমে উৎপন্ন হয় ৩৩০০ টন। এই নাইট্রোজেন অক্সাইড ওজোন স্তর ভাঙে এবং মানুষের অনেক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে।

আরেক ভয়ংকর বস্তু মার্কারি। কয়লা প্ল্যান্ট থেকে উৎপন্ন হয়। এক চামচের ১/৭০ অংশ মার্কারি ২৫ একর লেকের পানিতে মিশে গেলে ওই লেকের মাছ খাওয়া বিপদজনক। মার্কারী ব্রেইনের কার্যকারিতা নষ্ট করতে পারে। মানুষ দ্বারা যত পরিমান মার্কারি দূষন হয় আমেরিকায় তার অর্ধেকই হয় এই কয়লার প্লান্ট থেকে।

এছাড়া লেড, ক্যাডমিয়াম,কার্বন মনোক্সাইড,আর্সেনিক,উদ্বায়ী জৈব যৌগ এবং বিভিন্ন ধরনের হাইড্রোকার্বনের দূষন হয় কয়লা প্লান্ট দ্বারা। বাংলাদেশের রামপালে যেটা হচ্ছে তাতে এসব দূষন তো থাকবে অবশ্যই। যেখানে দূষন নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা রাখলেও দূষিত হয় পরিবেশ। আমাদের এখানে দূষণ নিয়ন্ত্রনের কোন ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে কি না তা আমি জানি না। বিশ্বে যদিও বর্তমানে ৫০০০০ হাজারের মত এক্টিভ কয়লা প্ল্যান্ট আছে তবুও এর দূষনের কথা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য।

সুন্দরবনেও যে ক্ষতি হবে এটা নিশ্চিত। তবে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পংকজ শরণ অবশ্য বলেছেন, “বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। কারণ এ প্রকল্পে পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্যে বিভিন্ন সতর্কতা নেয়া হবে। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে কাজ করছেন। ” যতই সতর্কতা নেয়া হোক ক্ষতি তো হবেই।

কিন্তু পংকজ সাহেবের কথা টা বেশ ভাবায়। এত বেশী বেশী আশ্বাসের বানী শুনতে কেমন কেমন যেন লাগে। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, “এ প্রকল্প দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে দেবে। বিদ্যুত্ ঘাটতি পূরণসহ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হবে।

বাংলাদেশ ও ভারতের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও বাড়বে”। ঠিক আছে। সবাই যদি সুস্থ থাকে, অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয় তাহলে ভাল জিনিস। তবে ভাগ্য বদল নিয়ে কথা আছে। সৌভাগ্যে না দূর্ভাগ্যে বদলে দেবে সে শংকা যে এসে পড়ছে এখানে।

প্রথম আলো পত্রিকায় ১৯/৬/২০১২ তে “অনিশ্চয়তায় রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র” নামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। যেখানে উল্লেখ করা হয়: ১। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। তারপর এই সহযোগিতার ক্ষেত্র চিহ্নিত করে ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি এবং পিডিবি-এনটিপিসির যৌথ উদ্যোগে রামপালে ওই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ২।

সুন্দরবনের কাছাকাছি হওয়ায় রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এমন মানের কয়লা ব্যবহার করতে হবে, যার প্রতি কেজির তাপমান পাঁচ হাজার ৮০০ থেকে ছয় হাজার কিলোক্যালরি। ৩। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ায় যে কয়লা পাওয়া যাবে তার প্রতি কেজির তাপমান পাঁচ হাজার ১০০ থেকে পাঁচ হাজার ৭০০ কিলোক্যালরি। ৪। অপর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার প্রতি কেজি কয়লায় পাঁচ হাজার ৮০০ থেকে ছয় হাজার ৩০০ কিলোক্যালরি তাপমানের কয়লা পাওয়া যাবে।

এই দুই মানের কয়লা এনে তা একত্রে মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। ৫। ইন্দোনেশিয়ার কয়লার প্রতি টনের দাম বর্তমানে ১৪৫ মার্কিন ডলার। আনার খরচ পড়বে প্রতি টনে প্রায় ২৭ ডলার। দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার কয়লার দাম ১৬০ ডলারের কাছাকাছি।

আনার খরচ পড়বে প্রতি টনে প্রায় ৩৯ ডলার। ৬। পরিবহন পদ্ধতি: খরচ অপেক্ষাকৃত কম রাখার জন্য ৮০ হাজার মেট্রিক টনের জাহাজে করে কয়লা আমদানি করার কথা বলা হয়েছে সিইজিআইএসের প্রতিবেদনে। কিন্তু এই মাপের জাহাজ সমুদ্রমোহনার আকরাম পয়েন্ট (মংলা বন্দরের জেটি থেকে ৪৪ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে) আনতে হলেও কিছুটা খননকাজ করতে হবে। কারণ, আকরাম পয়েন্টের দক্ষিণেও সমুদ্রের তলদেশ ভরাট হয়ে জেগে উঠেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই স্থান খনন করে ৮০ হাজার মেট্রিক টনের জাহাজ আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত এনে সেখান থেকে ছোট ছোট জাহাজে (পাঁচ থেকে ১০ হাজার টন) প্রকল্প এলাকায় আনতে হবে। তবে এ জন্যও জোয়ার কাজে লাগাতে হবে। কারণ, বর্তমানে মংলা বন্দর এলাকায় পানির যে গভীরতা, তাতে যেকোনো সময় ১০ হাজার টনের জাহাজ কোনো পথেই সেখানে আসতে পারে না। খনন প্রসঙ্গ: উপরিউক্ত পদ্ধতিতে কয়লা আনার জন্য সিইজিআইএস খননের যে প্রয়োজনীয়তার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, তার দুটি অংশ রয়েছে। প্রথমত, ক্যাপিটাল ড্রেজিং বা মৌলিক খনন।

এ জন্য সাড়ে ১০ কোটি (১১৫ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার দরকার হবে। এ ছাড়া কয়লা পরিবহনের পথে প্রতিনিয়ত রক্ষণাবেক্ষণ খনন চালাতে হবে। এই কাজে প্রতিবছর ব্যয় হবে তিন কোটি (৩০ মিলিয়ন) ডলার। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যত দিন চলবে বা যত দিন কয়লা আমদানি করতে হবে তত দিন এই ব্যয় চালিয়ে যেতে হবে। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, খননের বিষয়টি শুধু ব্যয়সাপেক্ষ নয়, সময়সাপেক্ষও।

প্রতিবেদনে যে ধরনের খননের কথা বলা হয়েছে, প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে সে ধরনের খনন শুরু করতেই হয়তো পাঁচ বছর লেগে যেতে পারে। -- প্রথম আলো। // তাই প্রকল্প স্থগিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমরা দেখতে পাই ১২-০৩-২০১৩ তারিখের প্রথম আলো তে প্রকল্পের বিষয়টি চূড়ান্ত। এখন আমার প্রশ্ন আছেঃ দশমাস আগে দেখলাম সুন্দরবনের কাছাকাছি হওয়ায় কয়লার প্রতি কেজি তাপমান লাগবে পাঁচ হাজার ৮০০ থেকে ছয় হাজার।

এবং সেই হিশেবে ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এনে মিশানো ব্যয় সাপেক্ষ এবং খনন করতেই পাঁচ বছর লেগে যাবে। এখন যে এত তাড়াতাড়ি চুক্তি হয়ে গেল চূড়ান্ত, কয়লার তাপমান কি তাহলে কম নেয়া হয়েছে? যদি নেয়া হয় তাহলে তো আরো বিপদজনক হবে সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য। কয়লা প্লান্টের ব্যাপারে আরো কিছু তথ্য হলো ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনকে (এনটিপিসি) ১০ বছরের জন্য কর মওকুফ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ ও রাজস্ব বোর্ড নাকী এই কর মওকুফে রাজী ছিল না। সরকারের উচ্চপর্যায়ের চাপে দিতে বাধ্য হয়েছে।

এখানে ভারতীয় কোম্পানি বিনিয়োগ করছে। আয়করের উপর কর মওকুফ তো করা হয়েছিলই তার উপর মুনাফার উপর ও কর মওকুফ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ বড় রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হলো। অন্যায় এক সুবিধা পেল ভারত। যেখানে কয়লা প্ল্যান্ট নির্মান হচ্ছে সেখানকার জমির গত দশ বছরের উৎপাদনঃ এই ছবি আমাদের বুধবার থেকে।

সংযুক্তিঃ রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অনিশ্চয়তা- প্রথম আলো রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রথম আলো। UCSUSA রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না - পঙ্কজ শরণ  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.