বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বেশ কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর বাসায়। সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে তার ছোটভাই স্কুল থেকে আসল। সে সম্ভত নার্সারীতে বা ওয়ানে পড়ে।
তখন টিভিতে 'ডিজনি' নামক একটা হিন্দি কার্টুন চ্যানেল চলছিল। আমার বন্ধুটি আমাকে কিছু লিচু এবং জাম খেতে দিয়েছিল।
আমি তার ভাইটিকে তা খাওয়ার জন্য বলি। সে আমাকে বলে, "মে নেহি খাউনগা, মে ডোরেমন দেখুনগা। " আমি তো অবাক!!!!
সম্ভবত ১৯৯২ সালের দিকে দেশে কেবল টিভির প্রচলন হয়। তখন খুব স্বল্প পরিসরে ঢাকা ও তার আশেপাশের শহরে এর প্রচলন ছিল। আস্তে আস্তে তা দেশের জেলা শহর, উপজেলা থেকে বর্তমানে গ্রামে ছড়িয়ে পরেছে।
একসময় টিভি বলতে আমাদের দেশে ছিল বিটিভি। এরপর ১৯৯৭ সালে এল এটিএন বাংলা, ১৯৯৯ তে চ্যানেল আই, ২০০০ এ ইটিভি। বর্তমানে দেশে চ্যানেল প্রায় ২০টি।
এদেশের মানুষ একসময় বিটিভির নাটক দেখার জন্য মুখিয়ে থাকত। ওপার বাংলার মানুষরাও তা দেখত।
আজ রবিবার, কোথাও কেউ নাই, সংশপ্তক ইত্যাদি বিটিভির সেরা প্রযোজনা। কিংবা 'ইত্যাদি' যা কিনা এখনও আমাদের সেরা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান।
কিন্তু আস্তে আস্তে আকাশ সংস্কৃতি আমাদের এইদেশে সহজলভ্য হতে লাগল। এ দেশের মানুষের কাছে হিন্দি চ্যানেল গুলো জনপ্রিয় হতে লাগল।
আজ যে লোকটি ঠিকমত পড়তে জানে না সে আজ ঘন্টার পর ঘন্টা বসে টিভিতে হিন্দি ছবি দেখে।
আমাদের নারীরা সিরিয়ালের কোন পর্ব মিস করে না। অনেকে একই দিনে যতবার তা রিপিট হয় ততবারই দেখে।
আজ আমাদের নাগরিকরা দুই-একটি বাংলা চ্যানেলের নাম বলতে না পারলেও ভুলে না হিন্দি সিরিয়াল কিংবা ভারতীয় বাংলা সিরিয়ালের সময় সূচী।
এই সকল সিরিয়ালের কাহিনীতে দেখানো হয় শুধুমাত্র হিংসা, পরকীয়াসহ নানা অবাস্তব জিনিস যা কিনা আমাদের সমাজের সাথে সাংঘর্ষিক। যার ফলে আমাদের পরিবারগুলোতে বাড়ছে কলহ, অশান্তি।
আমাদের শিশুরা মাতৃভাষা ঠিকমত বলতে না পারলেও পারে হিন্দিতে খুব সুন্দর করে কথা বলতে। যার উদাহরন আমি শুরুতেই দিয়েছি।
আজ আমাদের কেবল লাইনে যদি ৮০টা চ্যানেল থাকে তা হলে ৬০-৭০টি ভারতীয় চ্যানেল। National Geography, Discovery, Animal Planet এর মত চ্যানেল বর্তমানে বাংলায় অনুষ্ঠান প্রচার করলেও আমি অনেক জায়গায় তা হিন্দিতে প্রচার করতে দেখেছি।
অথচ আমাদের চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানের মান বিশেষ করে নাটকের মান ভারতীয় সিরিয়ালের তুলনায় হাজারগুন মানসম্পন্ন।
কিন্তু ভারতের দুই-একটি জায়গা ছাড়া কোথাও আমাদের চ্যানেল দেখানো হয় না। আজ তাদের শুধুমাত্র স্টার গ্রুপের চ্যানেল গুলোর জন্য আমদেরকে বছরে দিতে হয় ২০০০কোটি টাকারও বেশি।
আজ আমাদের দেশে অবাদে তাদের চ্যানেল দেখতে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাদের কেবল অপারেটরা তাদের দেশের চ্যানেল রক্ষায় আমদের চ্যানেল দেখায় না। কিন্তু আমাদের অপারেটরা হিন্দি চ্যানেল বন্ধ করতে চান না গ্রাহক হারানোর ভয়ে।
আজ আমাদের তরুণরা ঘরে বসে হিন্দি ছবি দেখে। কোন ছবিই তারা মিস করে না, তা যত বস্তা পচা হোক না কেন। হয়ত বাংলা ছবিতে নির্মাণগত, প্রযুক্তিগত, বাজেট ইত্যাদি নানা সম্যসা আছে। তারপরও ভাল বাংলা ছবি নির্মাণ হচ্ছে, যা কিনা আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাচ্ছে। কিন্তু তারা বাংলা সিনেমার কথা শুনলে নাক সিটকায়।
আজ তারা 'শিলা কি জওয়ানি' শুনে, কিন্তু নজরুল-রবীন্দ্রনাথ তাদের ভাষায় খেত।
আজ আমাদের নাগরিকরা বন্যার্তদের খবর দেখে না সিরিয়াল মিস হবে বলে। তারাই বলে বাংলাদেশকে দিয়ে কিছু হবে না। কিন্তু আমাদের দেশকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে হলে আমদের সংস্কৃতিই হবে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
আর সবার কাছে তা তুলে ধরতে হলে আমদেরকেই তা ধারন করতে হবে।
নইলে আমার বন্ধুর ভাইটির মত সকল শিশুই হিন্দিতে কথা বলা শুরু করবে। যার ফলে রফিক-সালাম, বরকতের রক্তে অর্জিত ভাষা হুমকির মুখে পড়বে। যা কিনা কারও কাম্য না।
পরিশেষে বলব আসুন দেশীয় সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারন করি, একে ভালবাসি । ভবিষ্যত প্রজন্মকে একটি সুন্দর দেশ উপহার দিই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।