এসো নীপবনে আজ অফিসে যেয়ে টের পেলাম আজ শবে'বরাতের রাত। রাতে মুমিন- মুসলমানরা সারা রাত জেগে নামাজ পরবেন। আল্লাহপাকের কাছে চাইবেন। এই দিনে আল্লাহপাকের কাছে মন-প্রাণে কিছু চাইলে নাকি পাওয়া যায়। তিনি কাউকেই নিরাশ করেন না।
আমার কেবল মনে হলো, আহা গতকাল কেন এই রাত এলো না। তবে একদিন বাড়তি ছুটি পেতাম। শুক্রবার তো এমনিতেই ছুটির দিন। সবার কেমন যেন এই একটু তাড়াহুড়া। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে, নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিবে।
অফিসে গ্রাহকের ভীড়ও তেমন নেই। কেউ কেউ এসে বললো ঢাকা শহর নাকি ফাঁকা হয়ে গেছে। কি জানি, অফিসে ঢুকলে তো কিছুই টের পাইনা। কখন দুপুর হলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, কখন সূর্যের তেজ তীব্র হলো আর কখন ঝুম বৃষ্টি হলো। কিছুই বোঝার উপায় নেই।
এক অদ্ভুত সময় কাটাচ্ছি।
দুপুরের খাবার খেতে এসে এক সহকর্মীর সাথে কথা বলতে বলতে মনে পড়ে গেল আমার সেই ছোটবেলার শবে'বরাতের সেই রঙ্গিন রাতগুলোর কথা। মনে হলো আজ বাসায় ফিরে আমি সেই সব স্মৃতির রোমন্থনে ভাসবো। সেই সব হারিয়ে যাওয়া দিন গুলো।
আমরা ছোটবেলায় ছিলাম ফরিদাবাদের ২৩ নং বাসায়।
বাড়িটা অনেকটা জাহাজ বা লঞ্চের মতো। চিকন আর লম্বা। গেট দিয়ে ঢুকে সরু গলি চলে গেছে পেছনের দিকে। প্রথমে একতলা এর পর দুতলা বাড়ি। আমি আজ বাড়ির বর্ণনা দিতে বসি নাই।
কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে, বাড়ি সম্পর্কে না বললে, বাড়ির মানুষগুলো সম্পর্কে না বললে, সেই সব দিনগুলো কত রঙ্গিন ছিলো তার কোনো ছিটে ফোটা দেয়া যাবে না। যাই হোক, বাড়িটা তিন ভাইয়ের। আমরা ভাড়া ছিলাম। এই তিন ভাইকে আমি মামা ডাকতাম। বড় মামা, মেঝ মামা আর ছোট মামা।
সাথে থাকতো তাদের দুসম্পর্কের এক বোন। আমি তাকে ফুফু ডাকতাম। আসলে আমার নিজের মামাদের চেয়ে এই মামারা ছিলেন অনেক আপন, নিজের ফুফুদের চেয়ে এই ফুফু ছিলেন অনেক অনেক ভালো। কেননা, দেশে যাওয়াই খুব একটা হতো না, আর এই বয়সে এসে সত্যি বলছি, এই মামাদের আমার আপন মামা নয় এমন কখনো মনে হয়নি। তারা কি যে ভালো ছিলেন!
সেই ফরিদাবাদের বাড়ির নিয়ম হলো শবে'বরাতের রাতে ঘরের পুরুষেরা ঘরে অথবা মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়বে, আর আমার মা, মামী, ফুফু, খালা মনিরা, সারারাত জেগে হলেও হালুয়া তৈরি করে রাখবে।
হালুয়া হবে তিন প্রকারের।
১। বুটের ডালের হালুয়া
২। সুজির হালুয়া
৩। গাজরের হালুয়া
বুটের হালুয়া বানানোই মনে হয় সবচেয়ে কঠিন বেশি।
প্রথমে বুট সিদ্ধ কর, এর পর বাটো, এর পর তেল, চিনি-ঘি দিয়ে নাড়ো। আর সেকি নাড়া! আম্মু, মামীর হাত ব্যথা হয়ে গেছে দেখেছি। তবু কি আনন্দে হালুয়া বানিয়ে চলেছে। একটু হয়ে গেলে সেই বুটের মন্ডটাকে বড় চালনীর মধ্যে ঢেলে ঠান্ডা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আর এতো হালুয়া কি একটা চালনীতে হয়, দুই-তিনটা চালনী লাগে।
কিন্তু প্রত্যেকের তো একটার বেশি চালনী নেই। তবে উপায়? এটা কোনো ব্যাপারই না। কেননা হালুয়া তো সারা বাড়িরতে এক জায়গাতেই হচ্ছে। তাই, অন্যের কাছ থেকে চালনী নিয়ে নিলেই হলো।
প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আমাদের পড়তে বসার, আর ১০টা বাজলেই খেয়ে ঘুমতে যাওয়ার যে বাধা ধরা নিয়ম তা এই দিনে নেই।
আজকে একটু বেশি জাগলেও কেউ কিছু বলছে না। সন্ধ্যার পর এই ঘরে ওই ঘরে গেলেও কেউ বকছে না। কি মজা। আমার মনে আছে আমরা ছোটরা আজকে স্বাধীন। যার যা খুশি খেলতে পারি।
বড় মামার খাটটা ছিলো অনেক উঁচু। আমরা সহজেই এর নিচে যেয়ে খেলতে পারতাম। কেউ হুট করে ঘরে ঢুকে গেলেও বুঝতে পারতো না। আবার, এই খেলা সবার সামনেও খেলা যায় না। কি খেলা? এটা হলো সংসার সংসার খেলা।
এই খেলায় একজন মা হন, একজন বাবা হন আর একজন কি দুইজন হতে পারে তাদের সন্তান। আমি কোনোদিন বাবা হতে পারি নাই, কেবল সন্তান হয়েছি
একদিন শবে'বরাতের রাতে বড় মামা বললেন আয়, তোদের আজকে জাদু দেখাবো। আমরা ছোটরা তো খুবই খুশি। জাদু দেখা যায় কেবল ঈদের অনুষ্টানে। আর আজকে বড় মামা জাদু দেখাবে।
মামা একটা দশ পয়সার কয়েন নিলেন। কয়েন রাখলেন তার হাতের তালুর উপর। এরপর কি যে হলো কয়েনটা হাটতে শুরু করলো। একটু একটু করে মামার হাতের উপরের দিকে উঠে আসে। কয়েনটা মামার ফুল হাতা শার্টের ভেতর ঢুকে যেতে চাচ্ছে, মামা হাতা গুটালেন।
এরপর আরো উপরে উঠে, আরো উপরে উঠে কনুইয়ের কাছে চলে এলো। কি আশ্চর্য!
মামা বললেন, এইটা আর কি, এর চেয়েও আরো কঠিন জাদু দেখাতে পারি। আমরা বায়না ধরলাম, মামা দেখান। মামা বললেন, যা একটা দেয়াশলাইয়ের বাক্স নিয়ে আয়। কেউ একজন আনলো।
মামা সেই দেয়াশলাইটের বাক্সের ভেতর কয়েনটা ঢুকিয়ে দিলেন। এরপর আবার সেই হাতের উপর রাখলেন। কি আশ্চর্য! বাক্সটা এবার নিজেই নড়াচড়া শুরু করলো। এর পর হেলে-দুলে একটু একটু করে হাতের তালু থেকে উপরের দিকে উঠতে লাগলো। শুধু সেই ছোট বয়সে কেন- আজো আমার মাথায় কিছু ঢুকে না, মামা এইটা কিভাবে করতেন।
পরের দিন সকালে উঠে নাস্তা করেই সবাই বসে যেত, বেলুন-পিড়ি নিয়ে। রুটি বানানোর জন্য। রুটিও আবার দুই ধরণের। আটার রুটি আর চালের রুটি। রুটি বানানোর দৃশ্যটা অদ্ভুত।
দুই-তিন জন বসে গেছে রুটি বানাতে, আর একজন মাখিয়ে রাখা চালের দলাটাকে শুধু পুটুলি করে পাকিয়ে দিচ্ছে। ডিমের মতো সেই দলা বেলে বেলে রুটি বানিয়ে রাখা হচ্ছে চালনীতে। সেখান থেকে নিয়ে ফুফু চুলায় বসিয়ে ছ্যাকে দিচ্ছে। এই রুটি কি আর একটা দুইটা শ'য়ে শ'য়ে। এগারোটা-বারোটার মধ্যেই রুটি বানানো শেষ।
এরপর কেবল বিলানোর পালা। থালা থালা করে প্রত্যেকের ঘরে চলে গেলো সেই রুটি আর হালুয়া। থালায় করে সাজিয়ে এবার প্রতিবেশীদের বাসায় পাঠানো হচ্ছে। আবার সেই প্রতিবেশিদের থেকেও আসছে রঙ বেরঙের নকশি করা হালুয়া রুটি।
বুটের ডালের হালুয়া।
সুজির তকতি হালুয়া। এটা শক্ত হয়।
গাজরের হালুয়া
সুজির নরম হালুয়া
সেই ছোট বয়সে হালুয়া রুটি থাকতো অনেক দিন পর্যন্ত। রুটি যেতো শক্ত হয়ে। কিন্তু হালুয়া অনেক দিন পর্যন্ত রেখে খাওয়া যেত।
ও হ্যাঁ, যা বলছিলাম, দুপুরের পর থেকে তো ফকির মিসকিন আসা শুরু করতো। বিলি করা হতো তাদের মধ্যেও। তাদের দেওয়ার পদ্ধতিটা হচ্ছে, একটা রুটির উপর দুইটা হালুয়ার টুকরা রেখে তার উপর আরেকটা রুটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এর পর যে আসছে তাকে যত ক্ষন রুটি হালুয়া আছে ততক্ষন বিলি করা হচ্ছে। একটু বলে নিই।
এই বাড়িতে যে রুটি হালুয়া বানানো হলো শুধু সেগুলোই বিলি হতো। আসতো কিন্তু অনেক, সেগুলি কিন্তু কখনো বিলি হতো না। তাই রয়ে যেত বলা যায় অঢেল।
সন্ধ্যায় আব্বু তারা বাতি এনে দিলে আমরা ঘর অন্ধকার করে অথবা ঘরের সামনে তারাবাত্বি জালাতাম। আমি যে কি ভয় পেতাম।
আব্বু তারা বাত্বি জ্বলিয়ে ধরে রাখতো আমি আব্বুর হাতের ভেতর দিয়ে একটু করে ধরতাম। আব্বু কত অভয় দিতেন কিছু হবে না ধরো। আমার কি আর ভয় কাটে। আজ আর কেউ এই ভাবে অভয় দেয় না। কেউ বলে না- এসো ধরো, কোনো ভয় নেই।
সেই সময়- এটা ১৯৮৬-৮৭ সালের কথা বলছি- এক ধরনের হাত বোমা পাওয়া যেতো। এক একটা আটানা করে বোধ হয়। একটা চিকন বাঁশের কাঠির মাথায় একটু পুটুলির মতো লাল-নীল-সবুজ কাগজ মুরানো। এগুলো সজোরে কোথাও আঘাত করলে ঠাস করে ফুটে উঠতো। এমন পবিত্র দিনে কেন তখনো বাজি ফুটাতো জানি না।
কিন্তু বেশ লাগতো। সত্যি বলছি, নিজেকে একটু একটু সিনামার হিরো হিরো লাগতো। আমি লাঠি পটকা ফুটাচ্ছি। সেই আনন্দ কোথায়! আজকের উৎছন্নে যাওয়া ছেলেরা তাবিজ ফুটায়।
এই হলো আমার এক্কেবারে পিচ্চিবেলার শবে'বরাতের স্মৃতি।
একটু বড় বেলার টা এর পরের পর্বে লিখবো কাল। তাই কাল আর সক্রেটিস এর উপর লেখা হবে না। সকলেই ভালো থাকুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।