এসো নীপবনে
সক্রেটিস - পর্ব ৯ (সক্রেটিস এর বিরূদ্ধে অভিযোগ সমূহ)
সক্রেটিস - পর্ব ৮ (কিছু উক্তি)
শায়মা আপিকে কথা দিয়েছিলাম, আমি সক্রেটিস নিয়ে লিখবো। সেই কথা রাখতেই এই লেখা শুরু করা। দেখতে দখতে ১০ পর্ব হয়ে গেলো। সক্রেটিস যদি আজকের দিনে আমাদের দেশে জম্মনিতেন তবে তাঁকে হেমলক পানে নয়, আরো বিশ্রীভাবে মৃত্যূ বরণ করতে হতো। কেন?
আগেই বলেছি, সক্রেটিসের বিরূদ্ধে আনীত অভিযোগ গুলো আসলে কোনো ভিত্তিই ছিলো না।
এই সব অভিযোগে আসলে কারো মৃত্যূদন্ড হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এমন কি অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলেও না।
তিনি অধার্মিক বা নাস্তিক ছিলেন না তা খুবই স্পষ্ট। এথেন্সের প্রচলিত দেবদেবীকে তিনি কেন, এথেন্সের কোনো শিক্ষিত ব্যাক্তিই পৌরাণিক দেবদেবীর গল্প বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না।
নতুন দেবদেবী প্রবর্তনের অভিযোগটাও ফাঁকা।
কারণ এই অভিযোগটা যখন উঠতে পারতো তখন ওঠে নি। সক্রেটিসের বিচারের বাইশ বছর আগে এ্যারিস্টোফেনিস তার 'ক্লাউডস' (Clouds) ব্যাঙ্গাত্মক নাটকে দেখিয়েছেন যে সক্রেটিস ঘোষণা করছেন দেবতা জিউস সিংহাসন চ্যুত হয়েছেন, তার জায়গায় 'ঘূর্ণিবার্তা' এসেছেন। সক্রেটিসের এইরকম চরিত্র আঁকা সত্ত্বেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয় নি।
আর তরুণদের তিনি সেই সব শিক্ষা দিয়ে বিপথে নিচ্ছেন। এর বিষয়ে তো আগেই বলা হয়েছে।
তাই বোঝাই যায় যেসব অভিযোগ সক্রেটিস এর বিরুদ্ধে আনা হয়েছিলো তার একটিরও কোনো ভিত্তি ছিলো না এবং সেগুলির একটিও আদালতে প্রমাণিত হয় নি। বার্নেটের মতে, 'অভিযোগগুলির মানে যে কি তা কেউ জানতো না, এমন কি অভিযোগকারীরা নিজেরাও জানতো বলে মনে হয় না। '
আসলে সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড একটি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ছাড়া আর কিছু নয়। সক্রেটিস এর বেশ কিছু শিষ্য ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান, তাদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে অভিজাত দল নিয়ন্ত্রিত বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই যে, তার শিষ্যদের কর্মকান্ডের জন্য সক্রেটিস মোটেও দায়ী ছিলেন না।
তবে তিনি সেই সময়ের এথেনীয় গণতন্ত্রের একজন কড়া সমালোচক ছিলেন। তাঁর তীব্র সমালোচনা থেকে এথেনীয় সর্বাগ্রগণ্য নেতা পেরিক্লিস থেকে শুরু করে কেউ রেহাই পান নি।
সক্রেটিস এথেনীয় গণতন্ত্রের সমালোচনা করতেন তাঁর মূল দার্শনিক অবস্থান থেকে। সক্রেটিসের কাছে জ্ঞান ও ভালোত্ব ছিলো এক ও অভিন্ন। ভালোত্বের জ্ঞান ছাড়া ভালোত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়।
কথাটা তাহলে রাষ্টপরিচালনার ক্ষেত্রেও খাটে। রাষ্ট্রপরিচালনার জ্ঞান ছাড়া সঠিক পথে রাষ্ট কোনোমতেই পরিচালিত হতে পারে না। কিন্তু পেরিক্লিসীয় গণতন্ত্রের মূল কথাটাই হচ্ছে সকলেই রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নেবার অধিকারী, ধরে নেওয়া হবে সবাই যোগ্য, যোগ্য অযোগ্য বাছাইয়ের কোনো প্রশ্ন উঠবে না। মানুষ মাত্রেই 'সর্বকর্মা'। অতএব গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপরিচালনায় জ্ঞানের কোনো প্রয়োজন নেই।
সক্রেটিস মনে করতেন গণতন্ত্রের এইটাই হচ্ছে মূল ব্যাধি।
'জাহাজ তৈরি করতে বিশেষজ্ঞের পরামর্শের দরকার হয়, দুর্গ বানাতেও বিশেষজ্ঞ লাগে- শুধু জাতীয় নীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ ন্যায় অন্যায় স্থির করার প্রশ্নে যে খুশি উঠে দাঁড়িয়ে গেল আর কথা বলতে শুরু করলো, সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ে গেল বিজ্ঞ বিচারক। ' এটা অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হতো তাঁর। তিনি ক্ষান্তিহীনভাবে গণতন্ত্রের সমালোচনা শুরু করেছিলেন। প্লেটোর ডায়ালগ 'জর্জিয়ান'- দেখা যায়, সক্রেটিস পেরিক্লিস থেকে শুরু করে সমস্ত গণতান্ত্রিক নেতাদের তীব্র সমালোচনা করছেন।
তখন একজন গণতন্ত্রী নেতা তাঁকে এই বলে সাবধান করে দিচ্ছেন যে, গণতন্ত্রকে তোয়াজ না করতে পারলে যে কোনো সময় তাঁর বিপদ ঘটতে পারে। অনুরূপভাবে 'মেনো' ডায়ালগে এ্যানিটস একই মর্মে সক্রেটিসকে সাবধান করে দিচ্ছেন।
এইবার আসুন লেখা শুরু করেছিলাম যে কথা দিয়ে, এখন যদি সক্রটিস জম্মাতেন তিনি কি করতেন? আমাদের দেশের গণতন্ত্রকে মেনে নিতেন? এই পরিবার তান্ত্রিক, ব্যবসাতান্ত্রীক রাজনীতির কি তীব্র সমালোচনা করতেন না? এই গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে যে একনায়কতান্ত্রীক আচরণ, এর বিরুদ্ধে বলতেন না? অবশ্য যদি কেউ শুনতো!
আসুন এবার সক্রেটিসের মুখে কিছু কথা শুনি। তিনি বলছেন, 'মেলিটস বা এ্যানিটস আমার কিছুই করতে পারবেন না। পারবে এই অজস্র লোকের কুৎসা ও হিংসা।
এই কুৎসা ও হিংসা অতীতে বহু সৎ মানুষের সর্বনাশ করেছে এবং আমার ধারণা আরো করবে। আমাতেই এর শেষ সে ভয় নাই। কেউ হয়তো বলবেনঃ 'সক্রেটিস, যে পেশা আপনি বেছে নিয়েছিলেন সে পেশার দোষেই আজ আপনার মৃত্যুর ঝুঁকি- এহেন পেশা বেছে নেওয়ার কারণে কি আপনি মরছেন না?' অবশ্য তার উদ্দেশ্যে আমারও ন্যায্য জবাব তৈরি আছেঃ 'যে মানুষের মধ্যে বিন্দুমাত্র সততাও বিদ্যমান তার পক্ষে কোন কাজ হাতে নেওয়ার আগে কাজটা করলে সে বাচবে না মরবে, ভেবে দেখা দরকার- এই যদি আপনার বক্তব্য হয়ে থাকে তবে আপনি ভুল করছেন, হুজুর। তার শুধু বিচার করা দরকার, যা করছেন তা ন্যায্য কি অন্যায্য, তার কাজ কি সৎ মানুষের মানায়, না মানায় বদলোককে। '
সক্রেটিস যখন নিজেই নিজের মামলা পরিচালনা করে বাদীদের জেরা করে প্রমাণ করেদিয়েছিলেন যে তিনি আদৌ দোষী নন তখন সেই বিশাল সংখ্যক বিচারকরাও দ্বিধাগ্রস্ত হলেন।
মাত্র ৩০ ভোটের ব্যবধানে তিনি দোষী সাবস্ত হলেন। এথেনীয় আইন অনুসারে তখন অভিযোগকারীদের জিজ্ঞাস করা হলো তারা সক্রেটিসের জন্য কি শাস্তি প্রস্তাব করছেন? অভিযোগকারীরা সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড দাবি করলেন।
এথেনীয় আইন অনুযায়ী অভিযুক্তব্যক্তি পাল্টা শাস্তি প্রার্থনা করতে পারতেন। আইনের এই সুযোগটা গ্রহণ করে মৃত্যুদন্ডের বদলে মৃত্যুদন্ডের কাছাকাছি কোনো একটা শাস্তি- কারাদন্ড বা নির্বাসন- সহজেই চাইতে পারতেন। আর তেমন শাস্তির প্রস্তাব করলে হয়তো তা মঞ্জুরও হতো।
কিন্তু তিনি তা করলেন না। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, তেমন করলে দোষ স্বীকার করা হয়। তিনি বললেন, কোনো শাস্তিই তাঁর প্রাপ্য নয় বরং জনসেবার জন্য, বা অলিম্পিক বিজয়ীদের যেমন মাঝে মাঝে সম্মান দেখানো হয়, তেমনিই সম্মান তাঁর প্রাপ্য। অবে এথেনীয় আইন অনুযায়ী যেহেতু শাস্তির বিরূদ্ধে শাস্তি চাওয়াটাই বিধান, সেজন্য তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে, তাঁকে এক 'মিনা' জরিমানা করা হোক। সক্রেটিসের বন্ধুরা বহু চেষ্টার পর এক মিনা থেকে তিরিশ মিনা পর্যন্ত জরিমানার প্রস্তাব করতে সক্রেটিসকে সম্মত করালেন এবং নিজেরা এই জরিমানা পরিশোধ করার জামিন থাকতে প্রস্তুত হলেন।
প্লেটো এই বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন।
সক্রেটিসের এই তিরিশ মিনা জরিমানার প্রস্তাব বিচারকদের কাছে আদালত অবমাননা বলে মনে হয়েছিলো। তারা ভীষণ ক্ষুদ্ধ হলেন। যারা সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করতে রাজি হন নাই, তাদের মধ্য থেকেও আরো আশি জন এই বার সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ডের পক্ষে যোগ দিলেন। বিপুল ভোটের ব্যবধানে সক্রেটিস মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হলেন।
জার্মান মহাত্মা হেগেলসুদ্ধ অনেক লেখক সক্রেটিসের মৃত্যুকে ট্রাজেডির মহিমা দান করেছেন। তাদের মতে সক্রেটিস রাষ্ট্রের চেয়েও অধিক শক্তিশালী বিশ্বজনীন কর্তৃত্বের দোহাই দিয়েছেন বলেই রাষ্ট্র নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সক্রেটিসকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। সে কারণেই এ মৃত্যু ট্রেজিক, নেহায়েত হত্যাকান্ড নয়। দেখা যাচ্ছে, সক্রেটিসও ট্রেজেডি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন। বলেছেন দেশের দেয়া দন্ড মাথা পেতে নেয়া ছাড়া তার অন্য কোনো পথ সামনে খোলা নাই।
এর পরের পর্বই হবে সক্রেটিসের শেষ পর্ব। আশা করি যারা পড়েছেন তাদের ভালো লাগলো। আর ভালো না লাগলেও সে কথা বলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হলো। ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।
সুন্দর থাকুন।
সক্রেটিস - পর্ব ১
সক্রেটিস - পর্ব ২
সক্রেটিস - পর্ব ৩
সক্রেটিস - পর্ব ৪ (এটাকে প্রেম পর্বও বলা যায়)
সক্রেটিস - পর্ব ৫
সক্রেটিস - পর্ব ৬
সক্রেটিস - পর্ব ৭ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।