আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যীশু আর সক্রেটিস : পর্ব - ৪

'কাটায়ে উঠেছি ধর্ম আফিম নেশা/ধ্বংস করেছি ধর্ম যাজকী পেশা,/ভাংগি মন্দির ভাংগি মসজিদ/ভাংগি গীর্জা--গাহি সংগীত' - নজরুল

(পূর্ব প্রকাশের পর) : ঈশ্বর মানুষকে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদেরই নেবার ক্ষমতা দিয়েছিলেন কারন তিনি চাননি মানুষ তার হাতের পুতুল হয়ে থাকুক। তিনি চাননি মানুষ পাপ করুক। কিন্তু মানুষ যখন পাপ করল তখন তিনি হতাশ হয়ে পড়লেন। : হতাশ হবার প্রশ্নই ওঠে না, কারন তিনি মানুষের স্বভাব জানতেন। তিনি তো ক্ষমতাবান, মানুষ পাপ করুক এটা তিনিই চেয়েছিলেন।

বরং আমি বলব মানুষকে এসব আকাঙ্খা আর দুর্বলতা দিয়ে তৈরি করে তিনি মানুষকে পাপ করতে বাধ্য করেছেন। : কি সব আজেবাজে বকছ! ঈশ্বর এই পৃথিবী, গাছপালা, পশু-পাখি এসব তৈরি করেছেন শুধুমাত্র মানুষকে আনন্দ দেবার জন্য। তোমার চারপাশের এই অপরূপ পৃথিবীর দিকে তাকাও। এতকিছু তোমাকে দেবার পরও কি করে এসব বলতে পারলে? : আমি এসব বিশ্বাস করি না। আমি তো ভেবেই পাই না তার মতো একজন নিষ্ঠুর, ঘৃন্য দেবতা কিভাবে এত অপরূপ করে এই পৃথিবী তৈরি করতে পারেন।

একজন মানুষ যত খারাপই হোক না কেন সেও কিন্তু জীবনে কখনো না কখনো অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা আর আত্নত্যাগের পরিচয় দেয়, মায়া-মমতা দেখায়। আপনার ঈশ্বরের তো এগুলোর কোনটিই নেই। শুধুমাত্র তাকে শ্রদ্ধা করে না, তাকে মানে না এর জন্য কি কোন মানুষ কখনো কাউকে এরকম নির্দয়ভাবে চিরজীবন শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু আপনার এই তথাকথিত ঈশ্বর এভাবেই শয়তানকে অত্যাচার করছেন। : আমিই তো সেই পথ, সেই সত্য, সেই আলো।

পিতার কাছে আমি ছাড়া আর কেউই যেতে পারে না। আমার কথা বিশ্বাস করলে তুমি স্বর্গে চিরজীবন লাভ করবে আর যদি অবিশ্বাস কর তবে পাবে নরক যন্ত্রণা। : আপনার পদ্ধতি যদি আমি গ্রহণও করি তারপরও কিন্তু আমি শয়তানের পক্ষেই থাকব। ঈশ্বর হয়তো এজন্য আমাকে চিরদিন শাস্তি দেবেন, তারপরও আমি ঈশ্বরের বিপক্ষে। কি ভয়ানক নিষ্ঠুর আপনার ঈশ্বর! কি নিদারুন অবিচার করছেন তিনি আমাদের উপর।

আমি সমুদ্র তীরবর্তী অসভ্য বর্বর মানুষের অত্যাচারের কথা শুনেছি, কিন্ত আমি নিশ্চিত তারাও শত্রুদের এরকম আজীবন অত্যাচার করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। আমি সাইক্লপ, গর্গন, মেডুসাসের মতো দানবের অত্যাচারের কথা শুনেছি। কিন্তু তারাও আপনার ঈশ্বরের কাছে কিছুই না। আর আপনি আমাকে বলছেন তিনি দয়াবান, তিনি শান্তি চান, তিনি মাফ করে দিতে পছন্দ করেন! : আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান। তিনিই আমাদের পিতা।

তিনি কখনোই চান না আমরা পাপ করি কিন্তু যদি আমরা পাপ করি তবে অবশ্যই তিনি আমাদেরকে শাস্তি দেবেন। তিনি এমনিতে দয়ালু, তিনি আমাদেরকে শাস্তি দেবার জন্য শুধু তখনই নরকে পাঠান যখন আমরা নিজেরাই পাপ করি। যখন আমরা পাপ করি, যখন আদম আর ঈভের মতো আমরাও যৌনতার জন্য লালিত হই, লালসা করি তখন আমাদেরকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে শাস্তি দেওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় থাকে না। : আপনি বললেন আমরা তার সন্তান? আমি বলি কি জানেন তিনি আসলে একটা দানব। তার সন্তানদের তিনি নিজেই চোখ, পা আর কামনা-বাসনা দিয়েছেন আবার এগুলোর জন্যই তিনি তাদেরকে হয়রানি করছেন।

না কোন কারন, না উদ্দেশ্য, না সত্য, না দয়া, না বিচার; কোন কিছুই আমি দেখতে পাচ্ছি না। শুধু দেখতে পাচ্ছি একজন নিষ্ঠুর ব্যক্তির ক্ষমতার স্বৈরাচারী নগ্ন ব্যবহার। মানুষ যতই স্বার্থপর আর ধূর্ত হোক না কেন এসকল গুনগুলো ঈশ্বরের চেয়ে মানুষেরই বেশি আছে। : আমরা সামান্য মানবসন্তান। আমাদের কি সাধ্য যে তার এই রহস্য বুঝতে পারার।

আমাদের দায়িত্ব হল তার অনুগত হওয়া, তাকে বিশ্বাস করা, তাকে অনুসরন করা। কেন তা জানার দরকার নেই। আমাদের উচিত শুধু আমাদের কাজ করে যাওয়া আর তারপর মৃত্যু আসলে তাকে বরণ করে নেয়া। : কেন প্রশ্ন করতে পারব না? তাহলে আমাদেরকে মন দেওয়ার কি দরকার ছিল? তাহলে আমরা কিভাবে বাঁচব আর আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি তাই বা আমরা জানব কিভাবে? তাহলে এতক্ষন ধরে আমরা কি আলোচনা করছি? কেন আপনি সারাজীবন ধরে মানুষকে নীতিবাক্য শুনিয়ে যাচ্ছেন? রোমানদের আদেশ অমান্য করে কেনই বা আপনি আপনার নিজের জীবনকে বিপদে ফেলছেন? : বিশ্বাসের জোরেই তো আমরা টিকে আছি। এখানে বড়াই করার কিছু নেই।

: বিশ্বাস! আচ্ছা, আপনার কাছে বিশ্বাস মানে কি? : প্রমাণ না চেয়েই তাকে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। তার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ করা উচিত নয়। এখন যদি আমরা তাকে বিশ্বাস করি তাহলে আমরা যখন স্বর্গে যাব তখন এই যে এত কষ্ট করলাম, এত পরীক্ষা দিলাম এর জন্য তিনি আমাদের এর হাজারগুন উপহার ফিরিয়ে দেবেন। : যা বলা হবে তাই বিশ্বাস করতে বলছেন? কোন সন্দেহ করা যাবে না, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাবে না। আমরা কি এতই বোকা? যদি তাই হত, তাহলে তো আমার উচিত আমাকে লাভের প্রতিশ্রুতি দেবে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকেই বিশ্বাস করে তাদের কাছে টাকা জমা রাখা।

আপনার কথামতো চললে আমি নিজেই বোকা বনে যাব। আর এখানে আপনি টাকা চাচ্ছেন না, বরং আমি জানি না চিনি না এমন কারো কাছে আমার জীবন উৎসর্গ করতে বলছেন। ডাকাত যেমন প্রাণের ভয় দেখিয়ে টাকা নিতে চায়, তেমনি আপনি শাস্তির ভয় দেখিয়ে, স্বর্গলাভের লোভ দেখিয়ে আমার কাছ থেকে আমার জীবন নিতে চাচ্ছেন। কিন্তু আমি এত সরল নই যে আপনার এসব ফাঁকা বুলিতে বিশ্বাস করব। : যারা সোজা সরল তারাই তো পৃথিবীতে টিকে থাকবে।

: ভুল। ওরাই সবার আগে মারা পড়ে। পরাধীন দেশের নারী আর শিশুদের মতো ওদের কপালেও দাসত্বই লেখা থাকে। : ঈশ্বরকে অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ করো না। : এই ভদ্রলোকটির সাথে তো আমার কখনো দেখা হয়নি, তাই আমি তাকে সন্দেহ করছি না।

আমি সন্দেহ করছি আপনাকে-আপনিই তো নিজেকে ঈশ্বরের দূত বলে দাবি করেন, কি করা উচিত আর কি উচিত নয় তা নাকি একমাত্র আপনিই জানেন। : তোমাকে অবশ্যই বাইবেল মানতে হবে। বাইবেলেই ঈশ্বরের সব কথা লেখা আছে। কোন কিছু বুঝতে না চেয়ে, কোন প্রমাণ না চেয়েই তোমাকে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। : এ অসম্ভব।

আপনি জানেন এই পৃথিবীতে কত হাজার ধর্ম আছে? যদি আমরা শুধু অন্ধবিশ্বাসের কারনেই বিশ্বাস করি তবে তো আমাদের সবগুলো ধর্মই মানা উচিত। কিন্ত যেহেতু প্রত্যেকটি ধর্মই আলাদা তাই এটা অসম্ভব ব্যাপার, যেন অনেকটা বিশ্বাস করতে হবে যে পৃথিবীটা একই সময়ে গোল আর চ্যাপ্টা। আমি নিশ্চিত, আপনি যা কিছূ বলছেন তা আপনি নিজেও মানেন না; আপনার তো উচিত ছিল জীউশ ধর্মে বিশ্বাস করা, প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রই যে সঠিক ছিল তা মেনে নেওয়া কিন্তু আপনি তা না করে প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে যেয়ে নিজেই নতুন আরেকটি ধর্ম প্রচার করছেন। তাছাড়া যখন এথেন্সের ধর্মযাজকেরা আপনার ধর্ম প্রচার বন্ধ করার জন্য আপনাকে হুমকী দিল তখন তো আপনার উচিত ছিল অলিম্পিক দেবতাদের এই গ্রীক ধর্মই বিশ্বাস করা। গ্রীক ধর্মই তো সর্বপ্রথম ধর্ম, তাহলে যখন তারা বলল যে গ্রীক ধর্মই আসল ধর্ম, তখন আপনি তাদের কথা মেনে নেননি কেন? আপনারও তো তাদের কথা বিশ্বাস করা উচিত ছিল।

: বিশ্বাসের জোরেই এখনো আমরা টিকে আছি। : আচ্ছা, আপনাকে আরেকটা উদাহরণ দেই। ধরুন একদিন আকাশ থেকে একটা দৈববানী আসল। আমাকে বলল, "ঐ লোকটাই আমার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে হত্যার জন্য দায়ী; এখন আমি যদি তাকে না খুন করি তবে সেই আমাকে খুন করবে"। একথা শুনে ভয় পেয়ে আমি নিশ্চয়ই ঐ লোকটাকে খুন করব কিন্তু আপনিই আবার বলেছেন, হত্যা করা পাপ।

আপনি আমাকে যা বলা হবে তাই বিশ্বাস করে মেনে নিতে বলেছেন। তাহলে এখন আপনার কথা মতো ঐ দৈববানী বিশ্বাস করে আমি লোকটাকে খুন করব আবার আপনার ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস করে লোকটিকে খুন করব না। কিন্তু এ দুটি তো একে অপরের বিপরীত, তাই আমি একইসাথে লোকটিকে খুন করতে পারি না আবার লোকটিকে ছেড়ে দিতে পারি না। তার মানে দৈববানী আর ঈশ্বর এ দুটোকে একসাথে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। অর্থ্যাৎ শুধুমাত্র বিশ্বাসের জোরে কোনকিছু মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

আপনি আমি সবাই যা করি তা হল যা বিশ্বাস করি তাই সত্য বলে মেনে নেই। এক্ষেত্রে আমরা দুটো কাজ করতে পারি, হয় চিন্তা-ভাবনা করে, আলোচনা করে, সমস্যার প্রতিটি দিক ভালো করে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি অথবা শুধুমাত্র অন্ধবিশ্বাসের কারনে কোন সিদ্ধান্ত নেবার দরকার নেই ভেবে সবকিছু অস্বীকার করতে পারি। এখানে সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুবই জরুরী কেননা আমাদের তো জানা প্রয়োজন এই "জীবনের উদ্দেশ্য কি?" শুধুমাত্র এই একটি প্রশ্নের উত্তরের উপরই মানবজীবনের সবকিছু নির্ধারিত হয়। আপনার কথামতো যদি ধর্মমতেই আমাদের সব কাজ করতে হয়, তাহলে কোন ধর্ম বেছে নেবার আগে প্রয়োজন এ সম্পর্কে ভালভাবে চিন্তা করা। আপনাকে আরো একটা ছোট্ট গল্প বলব, ধরুন জীবনের তাগিদে আপনি এক শহর থেকে আরেক শহরে যাবেন, তো যাবার আগে আপনি কোন পথে যাবেন, পথে ডাকাতের ভয় আছে কিনা, কোন পথে গেলে সহজে আর নিরাপদে পৌছানো যাবে, আর সত্যিকারেই ঐরকম কোন শহরই বা আছে কিনা তা জেনে নেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে না? (আগামী পর্বে সমাপ্য)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.