আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সক্রেটিস

ঘটনাস্থলঃ কারাগারে মৃত্যুর দিন বন্ধুদের সঙ্গে সক্রেটিস বর্ণনাকারীঃ ফিডো সক্রেটিসঃ সুখ জিনিসটা কিরকম অদ্ভূতভাবে দুঃখের সাথে জড়িত, যদিও তারা পরস্পরের বিপরীত। যেকোন একটার কামনা করলে অন্যটা সাথে সাথে আসে। সুখ আর দুঃখ দুইটা ভিন্ন জিনিস কিন্তু একই উৎস থেকে তাদের জন্ম। আমি না ভেবে পারছি না এসপ জানতে পারলে এ নিয়ে খুবই মজার একটা গল্প লিখত কিভাবে ঈশ্বর এদের (সুখ-দুঃখ)দুজনের দ্বন্দ্ব মেটাতে গলদগর্ম হয়ে দুজনকে একসাথে গেঁথে দিলেন। এজন্য একজন আরেকজনকে অনুসরণ করে, আমার ক্ষেত্রে আনন্দ আসে যখুনি পা থেকে শেকল সরানো হয়।

পায়ের বেদনা শেকল সরালে আর থাকে না বরং আনন্দে পরিণত হয়। সিবিসঃ এসপের কথা বলায় আমার একটা প্রশ্ন মনে পড়ল যেটা কবি ইভেনাসসহ অনেকেই জানতে চেয়েছে। তুমি কেন জীবনে একলাইন কবিতাও লেখ নাই, কিন্তু এখন জেলে বসে এপোলোর সম্মানে এসপকে নিয়ে কবিতা লিখছ? সক্রেটিসঃ কবিকে বল তার প্রতিদ্বন্দিতা করার কোন ইচ্ছে আমার নাই, আমি জানি সেটা আমি পারবও না। আমি শুধু দেখতে চাচ্ছি স্বপ্নে দেখা একটা বিষয়ের দ্বন্দ্ব কাটানো যায় কি না । জীবনে আমি অনেকবার স্বপ্নে দেখেছি 'আমার গান রচনা করা উচিত'।

বারবার আমি একই স্বপ্ন দেখেছি কথাগুলো একটু এদিক-সেদিক আর কিঃ গান রচনা করো, গানের চর্চা করো। তো আমি ভাবলাম আমাকে আরও আমাকে দর্শন চর্চার জন্য বলা হচ্ছে কারণ আজীবন আমি সেটাই করে এসেছি, দর্শনই আমার জন্য মহত্তম এবং শুদ্ধতম সঙ্গীত। স্বপ্ন আমাকে তাই করতে বলছে যেটা আমি সবসময় করে আসছি যেমন রেসের ঘোড়া যখন দৌড়ায় লোকে তখনও উত্তেজিত হয়ে তাকে দৌড়াতে বলে। কিন্তু আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম না, স্বপ্ন হয়ত আমাকে সত্যি সত্যি আমরা যাকে গান বলে জানি সেটা রচনা করতে বলছে। এখন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিতাবস্থায় সময় পেয়ে যাবার আগে তাই স্বপ্নের কথা মেনে কিছু একটা করার চেষ্টা করলাম।

প্রথমে আমি উৎসবকে স্মরণ করে একটা গান লিখলাম, পরে ভাবলাম একজন সত্যিকার কবি তো শুধু শব্দের পর শব্দ গাঁথবে না তাকে একটা গল্প বলতে হবে। যেহেতু আমার কোন গল্প নাই তাই আমি এসপের কিছু গল্প যেগুলো আমি জানি সেগুলোকে কবিতা বানাতে চাইলাম। ইভেনাসকে শুভেচ্ছা দিও এবং বোলো সে যদি জড়বরৎ না হয়ে জ্ঞানী হত তবে তাকে আমি আমার পেছনে লাগতে দিতাম। এছাড়া আজকে আমাকে যেতে হবে, এথেনীয়ানরা সেরকমই বলছে। সিমিয়াসঃ কি লোকের জন্য কি বার্তা।

তার সঙ্গী হিসেবে তাকে যতদূর জানি বাধ্য না হলে সে তোমার উপদেশ গ্রহণ করবে না। সক্রেটিসঃ কেন ইভেনাস কি একজন দার্শনিক নয়? সিমিয়াসঃ আমি মনে করি সে একজন দার্শনিক। সক্রেটিসঃ তাহলে সে বা যে কারও দার্শনিকের মন আছে তাকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, যডিও সে তার নিজের জীবন নিতে পারবে না কারণ সেটা ঠিক পথ নয়। সিবিসঃ তুমি কেন এমনটা বলছ যে একজন মানুষের নিজের জীবন নেয়া ঠিক না কিন্তু একজন দার্শনিকের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত? সক্রেটিসঃ সিবিস, সিমিয়াস তোমরা কি ফিলোলাসকে এসব বলতে শোন নাই? সিবিসঃ আমি তাকে কখনও বুঝতে পারিনি। সক্রেটিসঃ আমার কথাও শুধু তার কথার প্রতিধ্বনি কিন্তু আমি যতদূর জানি বলার চেষ্টা করব, আর আমিও এখন অন্য জগতে যাচ্ছি।

আমার এখন এ যাত্রা নিয়ে চিন্তা এবং কথা বলা উচিত। সূর্যাস্তের পূর্বে আমার জন্য যেটুকু সময় বরাদ্দ আছে এরমধ্যে এরচেয়ে ভাল আমি আর কি করতে পারি? সিবিসঃ তাহলে আমাকে বল সক্রেটিস, কেন আত্মহত্যা ঠিক নয়? ফিলোলাস যখন আমাদের সাথে থীবসে ছিল তখন আমি নিশ্চিতভাবে তাকে এটা বলতে শুনেছি। অন্যেরাও এ নিয়ে বলাবলি করেছিল, কিন্তু তাদের কোন কথাই আমার কাছে বোধগম্য হয়নি। সক্রেটিসঃ তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাও একদিন ঠিকই বুঝতে পারবে। আমার মনে হয় তুমি ভাবছ, দুনিয়ার সব খারাপ জিনিসও কোন না কোন সময় সময় ভাল কিন্তু মৃত্যু কেন ব্যতিক্রম? তাহলে মৃত্যুও কি কোন কোন ক্ষেত্রে ভাল? মৃত্যু যদি ভাল হয়ে থাকে টাহলে আমরা কেন নিজের জীবন নিতে অনুমিত নই, কেন দৈবের অপেক্ষা করতে হবে।

সিবিসঃ জুপিটারের দোহাই! আমি সেটাই ভাবছিলাম। সক্রেটিসঃ আমি স্বীকার করি, আপাতদৃষ্টিতে এতে কিছুটা অসংলগ্নতা আছে, কিন্তু আসলে কোন অসংলগ্নতা থাকার কথা নাই। একটা গোপণীয় মত চালু আছে যে, মানুষ তার নিজের খাঁচায় বন্দী এবং খাঁচা খুলে বের হবার বা পালাবার তার অনুমতি নেই। এটা এমন এক রহস্য যা আমি ঠিকমত বুঝিনি। তারপরেও আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বর আমাদের অভিভাবক এবং আমরা তাদের সম্পদ।

তোমরা কি তা মান না? সিবিসঃ আমি সেটা মানি। সক্রেটিসঃ এবং তোমার কোন সম্পত্তি যেমন ষাঁড় বা গাধা যদি তোমার অজান্তে তোমার অনিচ্ছায় নিজের জীবন নেয় বা পালিয়ে যায় তাহলে তোমার রাগ হবেনা? পারলে তুমি কি তার শাস্তির ব্যবস্থা করবে না? সিবিসঃ অবশ্যই। সক্রেটিসঃ তাহলে এক থায় নিশ্চয় যুক্তি আছে যে একজন মানুষের ঈশ্বরের নির্দেশ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত, যেমন এখন আমাকে যাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিবিসঃ হ্যা সক্রেটিস ওতে যুক্তি আছে। কিন্তু তারপরেও তুমি এ দুটি বিষয় কিভাবে মেলাও, প্রথমতঃ গড আমাদের অভিভাবক আমরা তার সম্পত্তি এরসাথে দার্শনিকদের মৃত্যুর জন্য উম্মুখ থাকা উচিত? মানুষের মধ্যে যারা সবচেয়ে জ্ঞানী তাদের কেন ঈশ্বর প্রদত্ত দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাবার জন্য উম্মুখ থাকতে হবে যখন সে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ঈশ্বরের অধীনে আছে।

কারণ নিশ্চিতভাবে কোন জ্ঞানী মানুষ নিশ্চিতভাবে মনে করে না সে ঈশ্বরের চেয়ে ভালভাবে নিজের যত্ন নিতে পারবে। বোকারাই ভাবতে পারে সে তার মনিবের কাছ থেকে পালানো তার জন্য ভাল যখন তার দায়িত্ব হল চুক্তি অনুযায়ী কর্তব্য পালন করে যাওয়া। এতে আসলে কোন শুভ কিছু নেই এবং এ পালানোর কোন মানে হয় না। জ্ঞানীলোক সবসময়ই তার চেয়ে ভাল কারো সাথে থাকতে চাইবে। কিন্তু সক্রেটিস তুমি যা বললে এ তার বিপরীত।

কারণ এ মতে জ্ঞানী মৃত্যুতে শোক করা উচিত, বোকারা মৃত্যুতে আনন্দিত হওয়া উচিত। সিবিসের আগ্রহ সক্রেটিসকে প্রীত করল। সক্রেটিস বলল, এই একজন লোক যে সবসময় অনুসন্ধানে লিপ্ত এবং যেকোন যুক্তিতে খুশী হবার মত নয়। সিমিয়াসঃ তার কথায় যুক্তি আছে। কেন একজন জ্ঞানীলোক পালাতে চাইবে যখন তার প্রভু তার চেয়ে উত্তম? আমি মনে করি সিবিস তোমার কথা জানতে চাইছে, সে মনে করে তুমি আমাদের ছেড়ে যাবার জন্য খুব উদগ্রীব হয়ে আছ; এবং সেসব ঈশ্বরকেও ছেড়ে যেতে চাইছ তোমার মত যারা আমাদের জন্য ভাল শাসক।

সক্রেটিসঃ ওতে যুক্তি আছে। এবং তোমরা চাও আদালতের সওয়াল-জবাবের মত আমি তোমাদের অভিযোগ খন্ডন করি? সিমিয়াসঃ আমরা সেটাই চাই। সক্রেটিসঃ তাহলে তোমাদের উপর ভাল একটা ইম্প্রেশান করার চেষ্টা করা উচিত যেমনটা আমি আদালতে বিচারকদের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থনে করেছিলাম। সিমিয়াস এবং সিবিস আমি এটা স্বীকার করতে প্রস্তুত, আমি মৃত্যুতে শোক করতাম যদি না আমি জানতাম যে অন্যান্য ঈশ্বরের কাছে যাচ্ছি যারা জ্ঞানী এবং ভাল। এ ব্যাপারে আমি এতটা নিশ্চিত যেমনটা আমি এরকম অন্য যেকোন বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত।

মৃত্যুতে আমি মৃত অন্য মানুষদের সাথেও মিলিত হব, যদিও আমি এ বিষয়ে ততটা নিশ্চিত নই, যারা যাদের আমি ফেলে যাচ্ছি তাদের চেয়ে ভাল। সুতরাং আমি মৃত্যুতে শোক করি না কারণ আমার আশা আছে মৃতের জন্য আরও কিছু বাকি আছে। যেমন বলা আছে, ভালর জন্য মন্দ অপেক্ষা অনেক ভাল জিনিস অপেক্ষা করছে। সিমিয়াসঃ কিন্তু সক্রেটিস তুমি কি তোমার সব চিন্তা সাথে নিয়ে যেতে চাও? তুমি কি আমাদের সেসব বলবে না ? যেগুলো শেয়ার করলে আমরা উপকৃত হব। এছাড়া তুমি আমাদের বুঝাতে পারলে তোমার বিরুদ্ধে যে দন্ড তারও একটা জবাব দেয়া হবে।

সক্রেটিসঃ আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। কিন্তু আগে আমাকে শুনতে দাও ক্রিটো কি বলতে চায়। ক্রিটোঃ শুধু এটা বলতে চাই সক্রেটিস, কারারক্ষী যে তোমাকে বিষ দেবে সে আমাকে বলল যে তোমার বেশি কথা বলা উচিত নয়। বেশি কথা বললে শরীরে তাপ বাড়বে, ওতে বিষের ক্রিয়া হতে সমস্যা করে। যার শরীরকে উত্তেজিত করে তাদের অনেক সময় দু'তিনবার বিষ পান করতে হয়।

সক্রেটিসঃ তাকে তার কাজে মন দিতে বল এবং আমাকে দু'তিনবার বিষ দেবার জন্য প্রস্তুত থাকতে বল। ক্রিটোঃ আমি জানতাম তুমি এরকম বলবে, তারপরেও তাকে সন্তুষ্ট করতে তোমাকে বলা। (ক্রমশ..) প্লেটো'র Phaedo ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.