খুব জানতে ইচ্ছে করে...তুমি কি সেই আগের মতনই আছো নাকি অনেকখানি বদলে গেছো... পাহাড় কেন ধ্বসে পড়ে !
হাসান কামরুল
পাহাড় ধ্বস এটা কিন্তু নতুন কোন বিষয় নয়। প্রতি বছরই আমরা এমন তীক্ষè অভিঙ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি। বছরের এ সময়টাতে পাহাড় ধ্বসের কারনে লাশের মিছিল শুরু হয়। এবার প্রায় ১০০ জনের প্রান গেল। গেলবারও ৬০ কিংবা ৬৫ জনের মৃত্যুদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল।
একই ঘটনার পুণরুাবৃত্তির পরও পাহাড়কে নিরাপদ মনে করে বসবাস করার যুক্তি কি? এমন প্রশ্ন সাধারন জনগনের মধ্যে উকিঝুকি দিচ্ছে। এর পিছনের গুঢ় রহস্য উদ্ভাবন করার কিছু নেই। প্রান্তিক জনগোষ্ঠি আরেকটু পরিস্কার করে বললে উপজাতি জনগোষ্ঠির লোকজনেরা সাধারনত পাহাড়ে বসবাস করে। সমভূমিতে বসবাস করেনা বা করতে চায়না এমন উপজাতিরও জাতভেদ রয়েছে। সাধারনত রাখাইন কিংবা সং উপজাতির লোকেরা পাহাড়ে বাস করে।
আর সাওতাল, মারমা বা মুরুং নৃগোষ্ঠির উপজাতিরা পাহাড় ও সমতল উভয় জায়গাতেই স্বাচ্ছন্দ্যের সহিত বসবাস করে। যে শিশুটি পাহাড়ের ঢালে জন্মগ্রহন করে। সে কিন্তু পাহাড়কেন্দ্রিক জীবনকে বেছে নিতেই পছন্দ করে। আরেক শ্রেনীর লোক উপজাতি না হয়েও পাহাড়ের জীবনকে বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। যাদেরকে খাটি বাংলায় বাস্তুহারা বলা হচ্ছে ।
বাস্তুহারাই বলি আর উপজাতিই বলি যারা পাহাড়ে বাস করে তাদের জীবন কিন্তু বছরের পর বছর বিপন্ন হয়ে উঠছে। কিন্তু র্দুঘটনার পর সরকার বিপন্ন মানুষদেরকে উদ্ধারে যে তৎপরতা দেখায় বছরের অন্য সময়ে এদের খবরও রাখেনা কেউ। অনেক এনজিও আছে এসব পাহাড়ি মানুষদের জীবন যাপন নিয়ে কাজ করে বাইর থেকে কোটি টাকা ফান্ড নিয়ে আসছে। কিন্তু সে ফান্ড পাহাড়ি জীবনে কোন প্রভাব ফেলেনা। কিন্তু এদেরকে পুজি করে এনজিও ওয়ালাদের জীবনে কিন্তু খুব ভালো ভাবেই স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসছে।
পাহাড় কেন ধ্বসে পড়ে? এ প্রশ্নের অনুসন্ধানে যদি ফিরি তাহলে পাহাড়ি অঞ্চলে মাটির স্তরভেদের গঠন বিন্যাসকে বিবেচনায় নিতে হয়। পৃথিবীজুড়েই তিন ধরনের পাহাড় বিদ্যমান। আগ্নেয় শিলার পাহাড়, পাললিক শিলার পাহাড় ও রুপান্তরিত শিলার পাহাড়। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির গঠন বৈচিত্র্যে পাললিক শিলার পাহাড়ের অস্তিত্ব স্পষ্ট। এ ধরনের পাহাড়ের মাটিগুলোর পারস্পরিক বন্ধন মজবুত নয়, খাটি বাংলায় বলা যায় মাটির স্তরসমুহে বন্ধনসমুহ আলগা থাকে।
অর্থাৎ এখানে কোন কঠিন শিলার উপ¯িহতি নেই। বৃষ্টি বা পাহাড়ি ঝর্নাধারায় এ ধরনের মাটি ক্রমাগত পানি চুষে ফুলে ফেপে থাকে। ফলশ্রুতিতে মাটির ভিতর ফাকা স্হানের পথ বা সুড়ঙ্গ তৈরি হয় । এবং মাটির অভ্যন্তরিন গঠনে পানির সহজ প্রবেশের কারনে মাটিগুলো নরম ও পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। ফলে যখন ভারি বর্ষন হয় মাটি বিশাল আকারে চান্ক ধরে ভেঙ্গে পড়ে।
আর ঐ চান্কে যাই ই থাকে তা বলকৃত প্রেসারে ঠেলে নিয়ে নীচে ধ্বসে পড়ে। যা জান ও মালের জন্য প্রভুত ক্ষতির কারন হয়ে দাড়ায়।
দুই, পাহাড়ে যারা বাস করে তারা সাধারনত পাহাড়ের ঢালে ঘর তৈরি করে থাকে। এর কারন হচ্ছে বন্যপ্রাণীর আক্রমন থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করা। কারন অনেক হিং¯্র প্রাণী সাধারনত ঢালু জায়গায় বিচরন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনা।
যদিও মাঝে মাঝে হাতির আক্রমনের খবর পাওয়া যায়। তবে তা সমতল জায়গার তুলনায় পাহাড়ের ঢালে কম বলেই প্রতীয়মান। পাহাড়ের ঢালে ঘর তৈরি করতে গিয়েই পাহাড়ে বসতিরা প্রথম সর্বনাশ করছে। কারন গৃহ নির্মানে পাহাড়ের সবচেয়ে শক্ত মাটির স্তর অর্থাৎ ক্লে বা কাদামাটির স্তরকে কেটে গৃহ নির্মান করা হচ্ছে। যার ফলে পুরো পাহাড়ের বিভিন্ন মাটির স্তর যার উপর দন্ডায়মান সে জায়গাটা নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে।
যা পাহাড়ি জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছে।
তিন, পাহাড়ের মাটির গুনাগুন আমলে নিলে সাধারনত দুই ধরনের মাটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বালি ও কাদা মাটি। বালির স্তর সরাসরি কাদা মাটির স্তরের উপর ভর করেই দাড়িয়ে থাকে। এ ভাবে একের পর এক বালি ও মাটির স্তরের পুর্নবিন্যাসেই পাহাড় দাড়ায় বা অস্তিত্ব স্পষ্ট হয়।
এসব স্তরের ভিতরে আবার ফল্ট লাইন বা ভূফাটল দেখা যায়। এ সকল ফাটল সৃষ্টির পিছনে পৃথিবীর আবর্তনের চিহ্ন লুকায়িত থাকে। পৃথিবীর সাব-সারফেসে পুঞ্জিভুত শক্তির বিস্ফোরনে পাহাড়ের ভূ-ফাটল কাজ করে। যা ভূমিকম্প হিসেবে সমধিক পরিচিত। শুধু প্রবল বর্ষনেই পাহাড়ি ঘর বাড়ি ধ্বসে পড়ে না, বড় কিংবা মাঝারি ধরনের ভূমিকম্পের আঘাতেও পাহাড়ের ঢালে বসবাসকারীদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে।
সিলেট ও চট্রগ্রামের পাহাড়গুলো বেশি বিপদজনক। এর কারন হচ্ছে এ পাহাড়গুলোর বেড়ে উঠার বয়স কম বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়গুলোর তুলনায়।
প্রাকৃতিক এসব কারন ছাড়াও রয়েছে মনুষ্য কর্মকান্ড। জুম চাষ পাহাড়ে জনখ্যাত ফসল হলেও জুম চাষের কারনে পাহাড়ের মাটি প্রতিনিয়ত তার শক্তি হারাচ্ছে। পাহাড়ে গড়ে উঠছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক কর্মকান্ড।
হাউজিং ব্যবসা থেকে শুরু করে লেবু বাগান ও পরিবেশ বিধ্বংসী বৃক্ষরোপন । যা পাহাড়ের আভ্যন্তরিক গঠনকে উত্ত্বপ্ত করে তুলছে।
সত্যিকার অর্থেই পাহাড়ে বাস করা কোন অংশেই যুক্তিসঙ্গত নয়। যদিও পাহাড় কেন্দ্রিক রয়েছে জাতিগত বৈচিত্র্য। তাই পরিকল্পনামাফিক বাসস্হান গড়ে তুলা অনস্বীকার্য।
পৃথিবীর অনেক দেশেই সুশৃঙ্খলভাবেই পাহাড়ে নগরায়ন করা হচ্ছে। পাহাড়ের উপর গড়ে উঠছে পরিকল্পিত বাসস্হান। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। এখানে পাহাড়ে ঘর তুলতে কারো অনুমতির প্রয়োজন হয়না। যদি পাহাড়েও কর্তৃপক্ষের ব্যবস্হা গড়ে তুলা যায়, যার কাজ হবে পাহাড়ের ঘর নির্মানের উপযোগীতা নির্নয় করে অপেক্ষাকৃত কম ঝুকিপূর্ণ স্হান চিহ্নিত করে দেয়া।
তাহলে অনভিঙ্ঞ লোকগুলোর উপর থেকে বিপর্যয়ের এ খড়গ কেটে যাবে।
হাসান কামরুল: ভূতত্ত্ববিদ ও কলামলেখক।
যধংধহশধসৎঁষমবড়ষড়মরংঃ@মসধরষ.পড়স
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।