আজকাল সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই খবর ছাপা হয় অমুক হাসপাতালের অমুক ডাক্তার অবহেলা করে রোগী মেরে ফেলেছেন। প্রতিকারের জন্য রোগীর আত্মীয়রা কখনো ডাক্তারের ওপর চড়াও হন, কখনো হাসপাতাল ভাঙচুর করেন। আবার কেউ কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে থানায় বা কোর্টে মামলাও করেন। দু-একটি ক্ষেত্রে কোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে ডাক্তার এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ব্যাখ্যার জন্য তলব করেছেন। দু-এক ক্ষেত্রে ডাক্তার-নার্স গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
কিন্তু যখন ভাবি, স্বাস্থ্য খাতের নিয়মকানুনগুলো, বিশেষ করে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে তদারকি করার জন্য আইন দ্বারা সত্যায়িত কোনো বিধিবদ্ধ রেগুলেটরি তথা তদারকি সংস্থা নেই। তখন মনে করি, মামলা-ভাঙচুর বা চুপিসারে আপস_এসব সমস্যার কোনো সমাধান নয়। আমাদের স্বাস্থ্য খাত অনেক বড় হয়েছে। সরকারি খাত পেরিয়ে এখন বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবসা এবং এর সঙ্গে ডাক্তারদের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। বোধ করি, দেশের স্বাস্থ্য খাত অর্ধেকই প্রাইভেট সেক্টরের অধীনে।
সরকারি খাতের গ্রাহক হলো কেবল দরিদ্র রোগীরা, যারা প্রাইভেট খাত থেকে এই সেবা কিনতে অক্ষম। সরকারি খাতে বরাদ্দও হাজার হাজার কোটি টাকা। যদিও করদাতাদের দেওয়া ওই অর্থ প্রায় জলেই যাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিতে বাজার অর্থনীতি শুরু হয় আশির দশকে, পূর্ণতা পায় নব্বইয়ের দশকে। এই দুই দশকে বড়লোকদের প্রয়োজন মেটাতে শিক্ষা খাত কেবল ব্যক্তি খাতে চলে গেছে, তেমনি স্বাস্থ্য খাতও।
স্বাস্থ্য খাতে গ্রাহকের তথা রোগীর প্রয়োজন হয় তিনটি বিষয়ে। এক. ভালো হাসপাতাল, সেখানে রোগী সেবা উপযুক্ত মূল্যে কিনতে রাজি আছে, কিন্তু মানসম্পন্ন হওয়া চাই। দুই. ভালো ডাক্তার চাই, যিনি রোগীকে আশ্বস্ত করবেন এবং সঠিক রোগ নির্ধারণ করে সঠিক ওষুধ দেবেন। তিন. কী রোগ হয়েছে বা রোগের মাত্রা কতটুকু, তা জানার জন্য প্রয়োজন ল্যাব টেস্ট, যা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো করে থাকে। একটা বিষয় লক্ষণীয়, গত দুই দশকে ব্যক্তি খাতে হাসপাতাল স্থাপন তথা হাসপাতালের মাধ্যমে ব্যবসা এবং ডায়াগনস্টিক ব্যবসা বেশ এগিয়েছে।
এখন অধিকাংশ রোগী রেডিমেট ডাক্তার পাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রাইভেট হাসপাতালের দিকে ছুটে যান। তবে কোনো কোনো হাসপাতালে এখনো ৫টার আগে ভালো রেডিমেট ডাক্তার পাওয়া যায় না। রোগীকে ভালো ডাক্তার পেতে হলে ৫টার পরে যেতে হয়। দু-একটি হাসপাতাল পূর্ণ সময়ের জন্য কনসালট্যান্ট হায়ার করেছে। তাঁরা 'অধ্যাপক' না হলেও ভালো ডাক্তার বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রাইভেট হাসপাতালগুলো 'অধ্যাপক ডাক্তারদের' নিয়ে টানাটানি করছে। ফলে একজন অধ্যাপকের নাম শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন হাসপাতালে। আর অধ্যাপকরা আসেন সরকারি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে। ইদানীং ব্যক্তি খাতের কিছু উদ্যোক্তা, ব্যক্তি খাতে মেডিক্যাল কলেজও প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে অধ্যাপক-ডাক্তার তৈরি হচ্ছেন কি না জানি না।
হলে তাঁদেরও মান নিয়ে প্রশ্ন কেউ কেউ তুলতেই পারে। যা হোক, শিক্ষার ডিগ্রির এবং ডিগ্রির মানের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিএমডিসি (ইগউঈ) না হয় আছে। কিন্তু হাসপাতাল ব্যবসাকে তদারকি করার জন্য কে আছে?
কোনো দেশেই রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কের বাইরে প্রাইভেট ব্যবসা করতে দেওয়া হয় না, চাই সেটা হাসপাতালের সেবা বিক্রি অথবা ডাক্তারদের রোগী দেখার সেবা বিক্রি। আজকাল যে অহরহ শোনা যাচ্ছে অমুক ডাক্তারের 'অবহেলায়' রোগীর মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু সেটা প্রকৃত অর্থে 'অবহেলা' ছিল কি না, সেটা কে যাচাই করবে? পুলিশ কিভাবে বুঝবে, ডাক্তার সাহেব প্রকৃত অর্থে কর্তব্যে অবহেলা করেছেন। ওই কাজ অবহেলা ছিল কি না সেটা বুঝবে একই লাইনের আরেক ডাক্তার, যিনি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে কাজটাকে পরীক্ষা করবেন।
কিন্তু সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নিরপেক্ষ অবস্থানটা কে নিশ্চিত করবে? করতে পারে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোনো স্বাধীন রেগুলেটরি কমিশন। সেই কমিশনের অধীনে ল্যাব টেস্টের বিশেষজ্ঞ যেমন থাকবেন, তেমনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও থাকবেন। কেউ অভিযোগ করলে এক-দুই ঘণ্টার মধ্যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তাঁর টিমসহ হাজির হবেন কে অবহেলা করেছেন, কোথায় ত্রুটি হয়েছে ইত্যাদি দেখার জন্য। যদি এটা করা হয় তাহলে ডাক্তারও মিথ্যা অপবাদ থেকে বেঁচে যাবেন এবং রোগীর আত্মীয়রাও খুশি হবেন। এখন কোথায়ও অভিযোগের জায়গা নেই বলে আত্মীয়রা ডাক্তার ও হাসপাতালের ওপর চড়াও হন।
এটা সমস্যার কোনো সমাধান নয়। আর কয়জনই বা চড়াও হতে পারেন, নিদেনপক্ষে চেঁচামেচি করতে পারেন। অধিকাংশ লোকই সেবা না পেলেও আল্লাহর কাছে নালিশ দিয়ে, রোগীকে নিয়ে বা রোগীর লাশকে নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করে। আমি ডাক্তারি পেশার কেউ নই। তবুও বলব, ডাক্তারি পেশাকে তদারকি বা দেখাশোনা করার জন্য একটি স্বাধীন কর্তৃপক্ষ বা কমিশন গঠিত হলে ডাক্তারদেরই লাভ হবে।
তাঁরা তখন তাঁদের কর্তব্য সম্পর্কে যেমন বেশি সজাগ হবেন, অন্যদিকে মিথ্যা অপবাদ থেকেও বাঁচতে পারবেন।
জনগণের উপকারের জন্য পুরো পদ্ধতি তথা স্বাস্থ্যসেবা ক্রয়-বিক্রয়কে একটা জবাবদিহিতার মধ্যে আনার জন্য সরকারকেই একটি কর্তৃপক্ষ তথা কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার চাইলে এ ক্ষেত্রে অন্য দেশ কী করছে, তাও দেখতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সিনিয়র ডাক্তারদেরও এগিয়ে আসতে হবে। আওয়াজটা তাদের থেকে তুললে ভুল বোঝাবুঝিই কম হবে।
আমি অর্থনীতির লোক বলে এইটুকু বলতে চাই, যে সংস্থা পেশার সনদ দেয় যথা ইগউঈ, সেই সংস্থা তদারকির দায়িত্ব নিতে পারে না। সেই সংস্থা তদারকি করতে গেলে স্বার্থের সংঘাতের উদ্ভব হবে। আশা করি, আমি বিষয়টিকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। উদ্যোগটা নিতে হবে সচিব এবং মন্ত্রী পর্যায়ে। এমন একটা কর্তৃপক্ষ ক্যাবিনেটের মাধ্যমে গঠন করে পার্লামেন্ট পর্যন্ত পেঁৗছাতে পারলে কাজটি হবে।
এখন রোগ বেড়েছে অনেক; কিন্তু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাব রয়েছে।
একজন বিখ্যাত ডাক্তার বলেছিলেন, তিনিই বড় ডাক্তার, তাঁর কক্ষ থেকে বের হলে রোগী মনে করবেন তাঁর অর্ধেক রোগ ভালো হয়ে গেছে। এমন ডাক্তারের খোঁজে আজও আমরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটছি। উদ্দেশ্য একজন 'ভালো' ডাক্তার পাওয়া। সবার ভাগ্যে ভালো ডাক্তার জোটে না।
অনেকে 'ভুল' ডাক্তারের কাছে গিয়ে বেশি রোগী হয়েছেন। আমাদের সমাজে অনেক ভালো ডাক্তার ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ আজও বেঁচে আছেন। তবে রোগী দেখেন না। দেখলেও কম।
তাঁদের অনেকে 'অধ্যাপক' সাইনবোর্ডও ব্যবহার করেননি। তাঁরা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। রোগীকে ভালো করতে না পারলে অন্য সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ করে নিতেন। তাঁরা অর্থের জন্য রোগী দেখতেন না, তাঁরা শুধু রোগীকে ভালো করার জন্য দেখতেন। সেই শিক্ষক-ডাক্তারদের খোঁজে অনেকেই ছুটেন, কোথায় তাঁরা আছেন, কোথায় তাঁরা বসেন
আবু আহমেদ
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।