আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মায়ানমারের রোহিংগারা ( The Rohingyas Of Mayanmar)

প্রবাসী মিয়ানমার বা বার্মা আমাদের প্রতিবেশী দেশ। বৃটিশ আমলের ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বার্মা ছিল অবিভক্ত বৃটিশ ভারতবর্ষের অংশ। সে সময়ে আমাদের দেশ থেকে বা ভারতের অনান্য এলাকা থেকে ভাগ্যের সন্ধানে অনেকেই পাড়ী জমাতেন বার্মা মুলুকে। বার্মার পটভূমিতে লেখা শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের উপন্যাস “পথের দাবী” বা বার্মার পথে সমুদ্র যাত্রা নিয়ে তার লেখা গল্প “সমুদ্রে সাইক্লোন” থেকে তা্র সাক্ষ্য মেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে যখন বৃটেন এই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আরাকান প্রদেশে গড়ে ওঠে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন।

বৌদ্ধ রাখাইনরা প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন এলাকার দাবী জানায় এবং রোহিংগারা রোহিংগা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট গড়ে ইসলামী রাজ্যের দাবী জানায়। ১৯৪৮ সালে বৃটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর মায়ানমারে গনতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়, বহুদলীয় নির্বাচনও হয়। আউং সান (সু’ চী’র পিতা) ছিলেন অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং জাতির পিতা হিসেবে সমাদৃত। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয় । জেনারেল নে উইন শাসন করেন ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত।

গন আন্দোলনের মুখে নে উইন সরে দাড়ালেও ক্ষমতা থেকে যায় সেনাবাহিনীর হাতে। সেনাবাহিনী State Law and Order Restoration council (SLORC ) নামে দেশ শাসন চালিয়ে যায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৮০% এর ও বেশী ভোট পেয়ে বিজয়ী হন National League for Democracy(NLD)নেত্রী আউং সান সু চি। সেনবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে সু চী কে গৃহবন্দী করে তার শাসন চালিয়ে যায়। এই দীর্ঘ সময়ে বার্মা ছিল অনেকটাই বিচ্ছিন্ন দেশ।

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্যাবসা বানিজ্য ছিল না বললেই চলে। এক সময়ে ধারনা করা হত বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন হবে এই এলাকার প্রধান সমুদ্রবন্দর , এখনকার সিঙ্গাপুরের মত নগরী। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, সব দিক থেকেই ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ে বার্মা এখন এই এলাকার পশ্চাৎপদ গরীব দেশ। মাথাপিছু জি,ডি,পি- ১,৩২৪ ডলার আর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে অবস্থান নীচের দিকে(১৪৯ তম), যা বাংলাদেশের জন্য হল ১,৬৯২ ডলার এবং হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইন্ডেক্স- ১৪৬ অর্থাৎ বাংলাদেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বড় এবং স্বল্পজনবসতি পূর্ন দেশ মায়ানমারের সার্বিক অবস্থা আমাদের থেকে নীচের দিকেই। এদের মানবাধিকারের রেকর্ড ন্যাক্কারজনক।

প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর মায়ানমারে তেল, গ্যাস, টিন ইত্যাদি খনিজ পদার্থের পাশাপাশি আছে উর্বর জমি। এক সময় ধান উৎপাদনে ছিল প্রথম সারির দেশ। বার্মা টীক বা কাঠের সুনাম পৃথিবী জোড়া। মূল্যবান পাথর যেমন রুবী, স্যাফায়ার, জেড, ইত্যাদি বার্মা্র অন্যতম উৎপাদিত পন্য। পৃথিবীর ৯০% রুবী পাথরের জোগানদাতা মায়ানমার।

মায়ানমার সরকারের জাতিগত ও ধর্মীয় সঙ্খ্যালঘুদের উপর নীপিড়ন নীতির বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, যেমন কারেন বিদ্রোহীরা, শান, রোহিংগা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট ইত্যাদি। মাদক চোরাচালানী এবং উৎপাদন কারী এলাকা গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল ও এখানে । ২০১১ সালে বহুদলীয় নির্বাচন হয় এবং প্রথম বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন থিন সেইন। তবুও সেনাবাহিনী সরকারের গুরুত্বপূর্ন নীতি নির্ধারকের পদ এখনও দখল করে বসে আছে। বাংলাদেশ থেকে প্রায় পাঁচগুন বড় ২লক্ষ ৬০ হাজার বর্গমাইল আয়তনের এই দেশের লোক সংখ্যা আনুমানিক ৬ কোটী(২০১০) বার্মার অধিবাসীরা জাতিগত এবং ধর্মীয় দিক দিয়ে মিশ্র।

ধর্মীয় দিক থেকে ৮৯% বৌদ্ধ, ৪% মুসলমান এবং ৪% খৃস্টান, বাকী অনান্য। জাতিগত দিকে দিয়ে তারা, বার্মিজ-(৬৮%), শান-(৯%),কারেন-(৭%), চীনা,ভারতীয় প্রভৃতি। দেশটির উত্তর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর তীরে ৪টি জেলা নিয়ে গঠিত রাখাইন (আরাকান) প্রদেশে রোহীংগাদের বাস। বাংলাদেশের সাথে মায়ানমারের প্রায় ২০০ কিলোমিটার সীমান্ত। রোহিংগা- রোহিংগা শব্দের উৎপত্তি নিয়ে দ্বিমত আছে।

অনেকের মতে আরবী শব্দ “রহম” থেকে এসেছে কথাটা, আরব ব্যাবসায়ীরা তাদের জাহাজডুবীর পর বার্মার উপকুলে আশ্রয় নেন। তারা তখন আল্লাহ’র দয়া বা “রহম” কামনা করতেন, সেখান থেকেই “রোহিংগা”র উতপত্তি। অপর ভিন্ন মত হল এই যে আরাকান রাজ্যের পূরনো নাম ম্রোহাউং থেকে রোহাং এবং তারই অপভ্রংশ হল রোহিঙ্গা শব্দ। বাংলাদেশ সংলগ্ন পশ্চিম বার্মার রাজ্য হল আরাকান বা রাখাইন। এরাজ্যের রাজধানী হল সিত্তওয়ে।

সপ্তম শতাব্দীতে আরব মুসলমান সওদাগরেরা বার্মায় বসতি স্থাপন শুরু করেন। তারপর ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এবং বৃটিশ শাসন কালে সবচে বেশী সংখ্যক এসে বসতি গড়েন এখানে আরাকান বা রাখাইন রাজ্যে। পৃথিবীর মধ্যে সবচে নিগৃহীত হল রোহিংগারা। প্রায় ৮ লক্ষ রোহিংগার বাস আরাকানে। শিক্ষাদীক্ষা , অর্থনীতি সব দিকে দিয়ে পিছিয়ে পড়া এই জন গোষ্ঠীর নিজস্ব কোন দেশ নেই।

রোহিংগাদের বলা হয়ে থাকে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার ফিলিস্তিনী। মায়ানমারের কর্তৃপক্ষ তাদেরকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে ফেরত পাঠাতে চায় বাংলাদেশে। ৮ম শতাব্দি থেকে এই অঞ্চলে রোহিংগারা বসবাস করে আসলেও মিয়ানমার সরকার, রোহিঙ্গাদেরকে সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। এর একটা বড় কারন হল ধর্মীয় এবং জাতিগত। রোহিংগারা ধর্মীয় দিক দিয়ে মুসলমান এবং জাতিগত দিক থেকে আমাদের বাংলাদেশীদের মতই, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ বার্মিজ মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক।

কঠোর সামরিক শাসনের অধীনে রোহিংগারা ছিল মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। চিকিৎসার সুযোগ নেই, বিয়ে এবং ২ টির বেশী বাচ্চার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন পড়ত। নিজেদের এলাকার বাইরে যাওয়ার ও অনুমতি নেই এদের, উপরন্তু বিনা পারিশ্রমিকে জোর পুর্বক কাজ করানো, লুটপাট রাহাজানি, ধর্ষন ইত্যাদি নিত্ত নৈমিত্তিক ব্যাপার। রোহিংগারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলাতেই কথা বলে। ১৯৭০ এর দশকে রোহিংগা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট এবং আরাকান রোহিংগা ইসলামী ফ্রন্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র আন্দোলন শুর করলে সামরিক জান্তা তা নির্মমভাবে দমন করে এবং রোহিঙ্গাদের আকিয়াব নদীর পূবে বার্মার অন্য এলাকায় যাওয়া নিষিদ্ধ করে।

১৯৮২ সালে আইন করে রোহিংগাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার উপায় বন্ধ করা হয়। রোহিংগা শরনার্থীদের ব্যাপক হারে বাঙ্গলাদেশে অনুপ্রবেশের ঘটনার শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। সে বছর বার্মার সামরিক জান্তা আদম শুমারীর নামে শুরু করে “নাগা মিন” বা অপারেশান ড্রাগন কিং । আরাকানে বিদ্রোহ দমনের নামে সেনাবাহিনী যে অভিযান শুরু করে তা ছিল প্রকৃত পক্ষে রোহিঙ্গাদের লুটপাট, ধর্ষন, খুন, ঘরবাড়ী পোড়ানো ইত্যাদি। ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসের মধ্যে প্রায় দুই লক্ষ রোহিংগা বাংলাদেশ আশ্রয় নেয়।

এই সময় শরনার্থী শিবিরে প্রায় ১০,০০০ শরনার্থী খাদ্যভাব এবং রোগে শোকে মৃত্যুবরন করে। ১৯৯১ সালের সাধারন নির্বাচনে রোহিংগারা সু’ চী’ র ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রাসি দলকে ভোট দেয়। ১৯৯১ -৯২ সালে দ্বিতীয় দফা অত্যাচার শুরু হয় রোহিংগাদের উপর। ইতিমধ্যে প্রায় ৩ লক্ষ রোহিংগা শরনার্থী রয়েছে বাংলাদেশে। ১৯৯২ সাল থেকে দুটো শরনার্থী শিবিরে বাস করে প্রায় ৩০,০০০ শরনার্থী, যারা শরনার্থী হিসেবে স্বীকৃত এবং খাদ্য বাসস্থান ইত্যাদি পেয়ে থাকে জাতিসঙ্ঘের শরনার্থী সংগঠন ইউ এন এইচ সি আর এর কাছ থেকে।

বাদবাকীদের কোন হিসেব নেই, নেই থাকা বা খাদ্যের নিশ্চয়তা। সর্বশেষ গত ২৮শে মে একজন বৌদ্ধ মহিলা ধর্ষনের শিকার হয়ে খুন হন। অভিযোগ ওঠে তিনজন মুসলিম যুবকের বিরুদ্ধে। ৩ জনকে ধর্ষন ও খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। গত ৪ঠা জুন বাস থামিয়ে তাউঙ্গুপ ( Taungup ) জেলায় রাখাইন জনতা ধর্ষনের অভিযুক্ত সন্দেহে বাস থামিয়ে ১০ জন বাসযাত্রীকে হত্যা করে।

শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর মংডু তে নামাজীরা সমবেত হয়ে বিক্ষোভের এক পর্যায়ে , “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি দিয়ে আশে পাশের বাড়ী ঘরদোরে হামলা শুরু করে। উল্লেখ্য যে মংডু হল মুসলিম প্রধান এলাকা। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে। এরপর শুরু হয় বৌদ্ধ রাখাইনদের হামলা, ঘরবাড়ী জ্বালানো পোড়ানো। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে অনান্য এলাকাতেও।

রাখাইন বনাম রোহিঙ্গা দাঙ্গাতে এ পর্যন্ত ৫০ কারো কারো মতে শতাধিক লোকের মৃত্য হয়েছে এবং দুই হাজারের বেশী ঘরবাড়ি জ্বালানো হয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষীরাও ক্ষেত্র বিশেষে শরীক হচ্ছে লুটপাটে, রোহিংগা নিধনে। ঘরবাড়ী হারিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়ছে। কিন্তু কোথায় নিরাপদ আশ্রয়? নিকটবর্তী বাংলাদেশ গ্রহন করছে না শরনার্থীদের। বাংলাদেশ নিজেই সমস্যায় জর্জরিত গরীব দেশ।

রোহিনাগারা বোঝার উপর শাকের আটির মত। ইতিপূর্বে টেকনাফ এবং উখিয়া তে আশ্রয় নেওয়া রোহিংগারা চাইছে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে থেকে যেতে। বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। অনেকে অসাধু বাংলাদেশি দালালদের সহায়তায় বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চাকরীও করছে। কিছু রোহিংগা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল থাইল্যান্ডে।

থাইল্যান্ড ও তাদের আশ্রয় দিতে রাজী নয়। ২০০৯ সালে রোহিঙ্গা শরনার্থী বোঝাই নৌকাকে পাকড়াও করে তা গভীর সমুদ্রে টেনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে এসেছিল থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ। । প্রায় ৩০,০০০ রোহিঙ্গা বাস করছে মালয়েশিয়াতে। সেখানেও তারা অবৈধ অভিবাসী।

অনিশ্চিত ভবিষ্যত, অনিশ্চিত জীবন, ঘরবাড়ীহীন নাগরিকত্বহীন রোহিঙ্গারা জাতসংঘের ভাষায় অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী(Most persecuted Minority) । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।