আমি ছিলাম বাবা-মা’র অনাকাঙ্খিত সন্তান।
বাবা কিছুটা বেশি বয়সে বিয়ে করেছিলেন। মা ছিলেন তার প্রায় ২০ বছরের ছোট। তাদের দাম্পত্যের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমি কালি-ঝুলি মাখা এই দুনিয়ার আলো দেখলাম। গর্ভাবস্থায় আমার অস্তিত্বকে মুছে ফেলার একটা জোর চেষ্টা হয়েছিল।
কিন্তু কিশোরী মায়ের শরীর ওষুধের ধকলে দুর্বল হয়ে পড়ায় এবং আরো কিছু জটিলতা দেখা দেওয়ায় শেষপর্যন্ত আমি টিকে গেলাম। বাবা বাধ্য হয়ে বিষয়টা মেনে নিলেও দীর্ঘদিন তিনি আমাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। সেসময় মা’র সঙ্গেও তিনি সদয় আচরণ করেননি। এসব কথা আমি মায়ের কাছে শুনেছি। সব মিলিয়ে আমার শৈশব কেটেছে বাবার অনাদর-অবহেলায়।
মজার ব্যাপার হলো-এতসব ঘটনার পরও আমি বাবাকে খুব পছন্দ করতাম। যদিও দু’জনার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যবধান ছিল। তিনি আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। আর কোন বাবা এমনটা করেন বলে আমি শুনিনি। তবে আমিও তাকে আপনি বলতাম।
মায়ের বেলায় বিষয়টা ছিল তুমি-তুমি। বাবা খুব সাধারণ মানুষ হলেও জ্ঞানের প্রতি ছিল তার অগাধ তৃষ্ণা। ছোটবেলা থেকেই চারপাশে আমি অনেক বই দেখে বড় হয়েছি।
তখন আমার বয়স খুব সম্ভব ১১ বছর। একদিন সন্ধ্যায় বাবা-মার মধ্যে তুমুল কলহ।
এ জাতীয় কলহে বরাবর মার ভূমিকা ছিল, প্রথমে দু’-একটি কথা বলা। এরপর চুপচাপ বাবার গালাগাল ও মারধর হজম করা। একপর্যায়ে ফিঁচ-ফিঁচ করে কান্না জুড়ে দেওয়া। তার এই কান্না ছিল আমার খুবই অপছন্দের। ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে কেমন একটা বিদ্রোহী ভাব ছিল।
আমি চাইতাম, মা প্রতিবাদ করুক। বাবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াক। কিন্তু তেমনটা কখনোই হয়নি। যাহোক, সেদিনের কলহের পর হঠাৎ করেই বাবা হাওয়া হয়ে গেলেন। এ নিয়ে আমার তেমন কোন বিকার ছিল না।
কিন্তু মা যেন নি¯প্রভ হয়ে গেলেন। প্রায়ই আমাকে আড়াল করে কাঁদতেন। অথচ আমার যতদূর মনে পড়ে, সেদিনের কলহের প্রথম পর্যায়ে বাবার প্রতি মায়ের বক্তব্য ছিল-‘তুমি বাড়ী থেকে বের হয়ে যাও। আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না। ’
সেদিনের ঘটনা এত বিস্তারিত বলার পেছনে একটা উদ্দেশ্য আছে।
ওই দিনটি ছিল আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট। প্রথমে কারণ বুঝতে না পারলেও অল্পদিনেই আমি জানতে পারলাম, বাবা আরেকটি বিয়ে করেছেন। এখন তিনি আমার দ্বিতীয় মায়ের সঙ্গেই রয়েছেন। বিষয়টি আমার কাছে বেশ মজারই মনে হলো। আমার সব বন্ধুর একজন করে মা, কিন্তু আমার দু’জন! অবশ্য ভুল ভাঙতেও দেরী হলো না।
মাসখানেক পরে একদিন সকালে মা বললেন, আজ খাবার মতো কিছুই ঘরে নেই। ধীরে ধীরে তিনি ব্যাখ্যা করলেন, বাবা এক মাস ধরে কোন যোগাযোগ না করায় ধার-দেনা করে কোনরকম এ ক’দিন চলেছে। এখন আমাদের মা-ছেলের সামনে অনিশ্চিত অন্ধকার। এই প্রথম বাবার প্রতি আমার খুব অভিমান হলো। আরেকটি বিয়ে করেছে, ঠিক আছে।
তাই বলে আমাদের খাবার বন্ধ হবে কেন?
খুব দ্রুত আমি জীবনের বহুমুখী সংকটের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করলাম। তখন যে জিনিসটা আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠলো, তার নাম-ক্ষুধা। আগে মা তিনবেলা খাওয়ানোর জন্য কত সাধাসাধি করতেন। অথচ আমার খেতে ইচ্ছে করতো না। আর এখন সেই আমারই সারাক্ষন ক্ষুধা লেগে থাকে।
বিপরীতে খাবারের কোন বন্দোবস্ত নেই। এই ক্ষুধাই পরে আমার জীবনটা বদলে দিল। তখন অবশ্য ক্ষুধার ধরণটাও পাল্টে গেল।
পড়াশোনা বন্ধ করে আমাকে একটি রেস্টুরেন্টের কাজে ঢুকিয়ে দিলেন মা। আমার কাজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার করা।
পরে লোকজন খেতে বসলে গ্লাসে করে পানি দেওয়া। একটু কষ্ট হতো, কিন্তু না খেয়ে থাকার চেয়ে কাজটা ভালো মনে হলো। ওরা তিনবেলা খেতে দিত। মাঝেমধ্যে ডালপুরি-চপ-জিলিপি খাওয়ার সৌভাগ্যও হতো। রেস্টুরেন্টে অনেক রকমের মানুষের আনাগোনা দেখতেও ভালো লাগতো আমার।
এর আগে মা তো আমাকে ঘরের বাইরে যেতেই দিতেন না। দ্রুত অনেক মানুষের সঙ্গে আমার জানাশোনা হয়ে গেল। রেস্টুরেন্টের নিয়মিত খদ্দেরদের মধ্যে একজন ছিলেন রায়হান সাহেব। প্রতিদিন সকাল ঠিক আটটার দিকে মেয়েকে নিয়ে নাশতা করতে আসতেন তিনি। মেয়েটা আমার বয়সীই হবে।
এখানে আসার আগে বাপ-বেটি মিলে প্রাতঃভ্রমন সারতেন। দু’জনের পরনেই থাকতো হাঁটার পোশাক। রায়হান সাহেব এলে আমি খুব খুশি হতাম। কারণ তিনি যাওয়ার সময় আমাকে দুই টাকা করে বখশিশ দিতেন।
রেস্টুরেন্টে কাজ করেছি প্রায় দেড় বছর।
এরমধ্যে একদিন সকালে রায়হান সাহেব একা এলেন। কিছুটা বিষন্ন মনে হলো তাকে। এভাবে পরপর তিনদিন একা এলেন তিনি। কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলাম তার মেয়ের কথা। তিনি জানালেন, রাণী অসুস্থ।
তখনই প্রথম জানলাম মেয়েটির নাম রাণী। এর পরদিন সকালে তিনি আর এলেন না। সন্ধ্যায় এসে কোণার টেবিলে বসে এক কাপ চা চাইলেন। চা দেওয়াটা আমার দায়িত্ব না হলেও আমি তাকে চা দিলাম।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তিনি বললেন, আমার বাসা চেন?
আমি না-সূচক মাথা নাড়লাম।
তিনি বললেন, স্টেডিয়ামের পাশে যে বড় দোকান, তার কাছেই। দোকানে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে।
আমি বাড়ীর ঠিকানা বলার কারণ জানতে চাইলাম।
তিনি বললেন, তুমি কাল একবার আমার বাসায় এসো। রাণী তোমাকে দেখতে চেয়েছে।
এবার আমার বিস্মিত হওয়ার পালা। বললাম, কেন?
জানি না-বলেই তিনি উঠে পড়লেন। কোন বখশিশও দিলেন না। আমি ঠিক কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। রানী দেখতে বেশ মিষ্টি আর শান্ত মেয়ে।
সত্যি বলতে কী, আমি পানি দেওয়ার ছলে অনেকদিন তাকে মনযোগ দিয়ে দেখতাম। তবে কোনদিন কথা হয়নি। আর আমার মতো হোটেল বয়ের সঙ্গে তার কথা বলার কারণও নেই। সাত-পাঁচ ভেবে কোন মাথামুন্ডু না পেয়ে আবার কাজে মন দিলাম। পরদিন দুপুরে মনে পড়লো রায়হান সাহেবের বাসায় যাওয়ার কথা।
দুপুরে খাওয়ার সময়ের পর আমার দু’ ঘন্টা ছুটি থাকে। ওই সময়টায় আমি সাধারণত বাসায় যাই। কিন্তু সেদিন চলে গেলাম স্টেডিয়াম রোডে। সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল বাসা। তিনতলা ভবনের সামনে বড় লোহার গেট।
দারোয়ান জানতে চাইলো, কার কাছে যাব? বললাম রায়হান সাহেব আসতে বলেছেন। আমার পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে বোধহয় দারোয়ানের ঠিক বিশ্বাস হলো না। বললো, উনি বাড়ীতে নেই। চলে যাও।
ফিরে আসছিলাম।
এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাক দিল, অ্যাই শোন, শোন...। তাকিয়ে দেখি দোতলার বারান্দা থেকে ডাকছে রানী। সে দারোয়ানকে বলে দিল আমাকে ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। ভয়ে ভয়ে উঠলাম দোতলায়। এত বড় আর সুন্দর বাড়ীতে আমি আগে কখনও ঢুকিনি।
রাণী দরজাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। বলল-ভেতরে এসো।
ওর পিছু পিছু ঢুকলাম ঘরের ভেতর। সুসজ্জিত একটি ঘর। জানালাগুলো ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা।
মাঝ বরাবর ঝাড়বাতি ঝুলছে। তারপরও কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আছে ঘরটা। বললাম, আপনার বাবা আমাকে আসতে বলেছিলেন।
মাথা নাড়লো রাণী। হ্যাঁ, আমিই বাবাকে বলেছিলাম।
বসো।
রাজকীয় সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি নাকি অসুস্থ?
ঃ হ্যাঁ। কিন্তু তুমি আমাকে আপনি করে বলছো কেন? আমি তো একটা ছোট মেয়ে।
ঃ না মানে, সব কাস্টমারকে আপনি করে বলতে হয়।
ঃ এখন আমি তোমার কাস্টমার না।
ঃ তা ঠিক। কি হয়েছে তোমার?
ঃ ভয়ংকর অসুখ।
ঃ কী অসুখ?
ঃ নাম জানি না। খুব শক্ত একটা ইংরেজী নাম। বাবা জানে।
এরপর ফ্রিজ থেকে কয়েক পদের মিষ্টি বের করে আমাকে খেতে দিল রাণী। আমি খুব অস্বস্তি বোধ করছিলাম। সে বললো, খাও, খুব ভালো মিষ্টি। আমি খেলাম। মনের মধ্যে নানারকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমাকে কেন ডাকা হয়েছে, এই বাড়ীর আর লোকজন সব কোথায় ইত্যাদি।
বোধহয় আমার মনের কথা টের পেয়েই রানী বলল, আমাদের বাড়ীটা খুব ফাঁকা-ফাঁকা তাই না? আসলে আমাদের বাড়ীতে লোক বলতে শুধু বাবা আর আমি। আর দু’জন কাজের লোক।
ঃ কেন তোমার মা নেই? জানতে চাইলাম।
ঃ না।
আমার জন্মের সময়ই মা মারা গেছেন।
ঃ ওহ্।
ঃ তবে আমার ধারণা, মা মারা যাননি।
ঃ মানে? কিছুই বুঝতে না পেরে আমি প্রশ্ন করলাম।
ঃ মাকে মেরে ফেলা হয়েছে।
ঃ তাই নাকি? কে মেরেছে?
ঃ আমার বাবা।
আমি ভয়ানক রকম বিস্মিত হয়ে বললাম, এটা কী বলছো?
ঃ ঠিকই বলছি।
দ্বিতীয় দফা আমার কাছে সবকিছু গোলমেলে মনে হলো। বললাম, তুমি যে বললে তোমার জন্মের সময় মা মারা গেছে?
ঃ হুম, ওটা বাবার শিখিয়ে দেওয়া কথা। সবাইকে আমি তাই বলি।
আমার ভ্যাবাচাকা মুখের দিকে চেয়ে রানী বড় মানুষের মতো বলল, যাদের মা থাকে না, তারা খুব দ্রুত অনেক কিছু বুঝতে শেখে। তোমার মা আছে?
ঃ হ্যাঁ।
ঃ মা তোমাকে আদর করেন? উত্তরের অপোয় না থেকেই সে বলল, তোমাকে কেন ডেকেছি জানো?
ঃ না, কেন?
ঃ তোমাকে আমার খুব দুখী মনে হয়েছে। আমারও অনেক দুঃখ। তুমি আমার বন্ধু হবে?
ঃ আমি...তোমার বন্ধু...মানে-
ঃ বন্ধু মানে বন্ধু।
জানো আমার কোন বন্ধু নেই। বাবা আমাকে স্কুলেও যেতে দেন না।
ঃ কেন?
ঃ আরেকদিন বলবো সে কথা। তাহলে তুমি আমার বন্ধু হবে তো?
ঃ হ্যাঁ...মানে, আমি তো...
ঃ শোন, আমার বাবা একটা ভয়ংকর লোক।
আমি বোঝার ভান করে মাথা নাড়লাম।
ঃ তাকে আমি কঠিন শাস্তি দেব। তুমি আমাকে সাহায্য করবে।
ওর কথা বোঝার চেষ্টা না করেই আবারও আমি মাথা নাড়লাম।
ঃ খবরদার, বাবা যেন কিছু বুঝতে না পারে।
রাণীর কথা শেষ হতে না হতেই রায়হান সাহেব দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।
হাতে একটা চকচকে ছুরি। তার মুখের দিকে চেয়ে আমার অন্তরাত্না কেঁপে উঠলো।
এ পর্যন্ত পড়ে ডায়েরীটা বন্ধ করলেন গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর মোখলেছুর রহমান। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে সহকর্মীকে বললেন, ডায়েরীর বদলে তো এ ব্যাটা তো রীতিমতো গল্প-উপন্যাস লিখে বসে আছে। এরমধ্যে কি আসল ঘটনার কোন কু পাওয়া যাবে?
সহকর্মী সাব-ইন্সপেক্টর আব্দুল বারেক বললেন, স্যার শালা বহুত চালাক মাল।
তয় আমার মনেহয়, এই ডাইরীর মইধ্যে কিছু না কিছু পাওন যাইবো। শালা যেমনে একটার পর একটা ঘটনা লিইখ্যা গেছে। কিন্তু এইটা ঠিকই কইছেন স্যার, শালা সিনেমার গল্প লেখলেও খারাপ করতো না।
মাথা নাড়লেন ইন্সপেক্টর। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে শুধু বললেন-হুমম।
[ক্রমশঃ] ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।