নিজের ভাবনা অন্যকে জানাতে ভালো লাগে। গত দুইদিন ধরে ঢাকার আশুলিয়ায় আবার শুরু হয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক বিদ্রোহ। এবারও বিদ্রোহের কারণ বকেয়া বেতন ও মুজুরি বৃদ্ধি। বরাবরের মতো শ্রমিক পক্ষ এবং মালিক পক্ষ থেকে আসছে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য। যদিও এখানে শ্রমিকের কণ্ঠস্বর অতিক্ষীণ, কারণ শ্রমিকের কথা ব্যথা-যন্ত্রনা তুলে ধরার মতো কোন মিড়িয়া নেই।
অপরপে সমস্ত বুর্জোয়া মিড়িয়াই আদপে মালিকের স্বার্থের পাহারাদার। এই বুর্জোয়া মিড়িয়াই শ্রম শোষণকারি মালিক পরে বক্তব্য, শ্রমিক বিদ্রোহকে তৃতীয় পক্ষের উসকানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াসি হয়েছে। এই পর্যন্ত যতবারই শ্রমিক তাদের ন্যায্য দাবিদাবা নিয়ে মাঠে নেমেছে মালিক, সরকার আর তাদের স্বার্থের পাহারাদার বুর্জোয়া মিড়িয়া একই সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রচার চালিয়েছে, তৃতীয় পক্ষের উসকানি হিসেবে। যে কোন আন্দোলন-সংগ্রামেই অংশ গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি একধরণের উসকানি বোধ করে। এই উসকানিই ব্যক্তিকে আদর্শের বলে বলিয়ান করে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি শহীদ নুর হোসেনের নাম, স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের একনায়ক শাসনই এই মহান মানুষটাকে সংগ্রামে নামতে বাধ্য করেছিল। যে সংগ্রাম তাঁর কাছে ছিল জীবনের থেকেও বেশি কিছু। যে কারণে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও নুর হোসেন বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাক যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে রাজপথে নেমেছিলেন। এমন কোন মহান চেতনায় যদি ২৫ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিককে সংগঠিত করা যেত তবে এটা হতো সমগ্র জাতির শ্রম দাসত্বের কবল থেকে মুক্তির সোপান। শ্রমিকরা এখনও শ্রমিক শ্রেণীর চেতনার স্পর্শ পাননি।
তাদেরকে মাঠে নামিয়েছে অস্তিত্বের সংকট। এখন পর্যন্ত এই আন্দোলন অর্থনৈতিক আন্দোলন, মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন। (বলে রাখা ভাল যে, এদেশের শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির নয় আদপে মজুরি রক্ষার আন্দোলন করছে। পাকিস্তান আমলে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন দিয়ে পাঁচমন চাল পাওয়া যেত, আর এখন একজন শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন দিয়ে দুইমন চাল পাওয়াটাও মুসকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে) তাবত পুঁজিবাদী দেশেই এই আন্দোলন স্বীকৃত। এই স্বীকৃতি মালিকরা শ্রমিকে দয়া করে দেয় নাই, দিয়েছে কৌশল হিসেবে।
কারণ অর্থনৈতিক আন্দোলন করে শ্রমিকরা যাতে শ্রেণী চেতনা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখে। শ্রমিকরা যে সংগঠনের মধ্যদিয়ে তাদের সুবিধা নিয়ে মালিকের সাথে দর কষাকষি করবে তার নাম ট্রেড ইউনিয়ন। আমাদের দেশের অতি মোনাফাখোরি মালিক শ্রেণী কখনো তাদের কারখানায় শ্রমিকদের এই অধিকার দেয় নাই। দেয় নাই এই কারণেই যে, আমাদের দেশের লুটেরা মালিক শ্রেণী তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের উপর কায়েম করেছে মধ্যযুগিয় দাসত্ব। পৃথিবীর আর কোথাও কোন দেশের কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানে, এত কম মুজুরি, এত বেশি শ্রম, এত শোষণের অস্তিত্ব নেই।
যে শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি, তাদের কোন নিয়োগ পত্র নেই, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সুযোগ সুবিধা নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই। ভয়ানক শ্রম শোষণের পাশাপাশি আছে শারীরিক নির্যাতন এবং নারী শ্রমিকদের যৌন নিপীড়ন। পুঁজিবাদী শাসক মানেই হচ্ছে মালিক শ্রেণীর স্বার্থের পাহারাদার। তদুপি নির্বাচনি রাজনীতির কারণে হলেও সরকার শ্রমিকের জন্য কিছুটা ভূমিকা রাখে। এটা সে রাখতে বাদ্য হয় যাতে শাসনের বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ সৃষ্টি না হয় সেই কারণে।
অথচ আজ আমাদের দেশের শাসক এবং মালিক এক ও অভিন্ন সত্ত্বায় পরিণত হয়েছে। কারণ, এখন আর কোন বুর্জোয়া নেতার হাতেই রাজনীতি নেই। রাজনীতি চলে গেছে, গার্মেন্টস মালিক, কালোবাজারি, ডাকাত সর্দার কিংবা সামরিক বেসামরিক আমলাদের হাতে। যে কোন গার্মেন্টেসের মালিক সেই আবার আওয়মীলীগ বিএনপির নেতা। একই ভাবে যে মজুদদার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি করছে তার বেলায়ও খাটে।
তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে। নব্যযুগের কসাই বাড়িঅলার অতি মোনাফা লোভ। এক টাকা বিদ্যুৎ বিল বাড়লে ১০০টাকা বাড়িভাড়া বাড়ে। শ্রমিকরা যে বস্তিতে থাকে এবং যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে সেই সাথে মাস শেষে যে পরিমাণ ভাড়া তাকে পরিশোধ করতে হয়, এটা যদি আমরা ফার এসকোয়ার ফুটে হিসেব করি এই ভাড়ার মূল্য গুলশান বারিধরা, কিংবা খুলশি এলাকা থেকে কম করে হলেও চারগুণ বেশি। পাঠক এখন আপনারাই বলুন কে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিদ্রোহের উসকানি দিচ্ছে? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।