চিরদিন রাখবে মনে এমন সময় কারও নেই, এতো কারও অপরাধ নয়, কালের খেলায় হল এই। এ জীবনে সত্য যেটা মেনে নিতে দোষ কি সেটা.....
আর মাত্র তিন ঘণ্টা আমার ফ্লাইট। প্রায় ৮ বছর আবার আমি আমার প্রিয় দেশে ফিরছি। এয়ারপোর্ট এ বসে আমার কল্পনার মানস্পটে ভেসে উঠছে সেই সুখস্মৃতি গুলো। আমার প্রিয় আম বাগান, যার ছায়ায় কেটেছে আমার শৈশব, বাড়ির পাশে কুলু কুলু শব্দে বয়ে চলা নদী,যে আমাকে শিখিয়েছে জীবনের হাল ধরা।
সেই রেল লাইন, যার প্রতিটি স্লিপারে জড়িয়ে আছে আমার পদচিহ্ন। সেই বিশাল ফাঁকা মাঠ, যেখানে ছিল আমার অবাধ বিচরণ। কত মধুর ছিল আমার সেই সোনাঝরা দিন গুলি। ইশ আবার যদি ফিরে পেতাম!
এই বিদেশ বিভুয়ে আজ ৮ বছর ধরে আমি খুঁজে ফিরি সেই আমরা আমিকে। নানা অপরিচিত জনের মাঝে চলে পরিচিত মুখ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা।
কিন্তু সময়ের আবর্তনে সেদিনের সেই অপরিচিত মানুশ গুলই কেন জানি আজ অনেক আপন। কি অদ্ভুত এই মানুশ নামের প্রানি গুলো, তাইনা। আজ এখানে তো কাল ওখনে। কিন্তু সবার জন্য সবার কত টান। এই প্রানের টানেই আজ পাড়ি জমাচ্ছি দেশের উদ্দেশ্য।
আমার জন্মের কয়েক মাস পরেই আমার মা মারা যান। সবাই বলে তিনি নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন। মানুশ আত্মহত্যা করে বাঁচার জন্য, মৃত্যুর চেয়েও কঠিন হচ্ছে জীবন। দুঃখ-কষ্ট জীবনে ভোগ করতে হয়,আর মৃত্যু তা থেকে মুক্তি দেয়। আমার মা হয়ত মুক্তির জন্য মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন।
আমার বাবা একজন অনেক বড় ব্যাবসায়ী। সারা দিন কাজ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কিছু বোঝেন না। সংসার সম্পর্কে তার মত উদাসীন মানুশ আমি আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আমার মায়ের মৃত্যুর কারনটা বোধহয় অনেকটা এটাই। মায়ের অনেক অভিমান ছিল বাবার উপর।
আর হয়ত সেই অভিমান বয়ে নিয়ে আসল আমার জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের।
মায়ের মৃত্যুর পর বাবা পাড়ি জমালেন বিদেশে। আর ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন ব্যাবসা নিয়ে। তার কাজের উদ্দীপনা দেখে মনে হত মা মারা গেছে বলে ভালই হয়েছে, মায়ের জন্যই এতদিন কিছু করতে পারছিলেন না। আর আমাকে তিনি ফেলে আসেন খালার কাছে।
খালার সংশারে আমি যখন আসি তখন আমার বয়স এক কি দেড় বছর। এই খালাই আমাকে তার নিজের সন্তানের মত করে মানুশ করেছেন। ভুলিয়ে দিয়েছিলেন আমার মা-বাবা হারানোর কষ্ট। সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে পুর্ন করেছেন আমার সকল শুন্যতা। আমার খালুও খুব ভাল মানুস, তার কাছে কোনোদিন কিছু চেয়ে আমি খালি হাতে ফিরিনি, সেটা যাই হোক না কেন।
আমার খুব মনে পড়ে, তখন আমি মাত্র ৭/৮ বছরের দুরন্ত বালক, আমাদের পাশের বাড়ির এক লোক ঘোড়া কিনে আনলেন আর তাই দেখে আমার খুব শখ হল আমিও ঘোড়া কিনব, সারাদিন সেই ঘোড়ার পিঠে ঘুরে বেড়াব সারা গ্রাম। যেমন ভাবা তেমন কাজ। গিয়ে ধরলাম খালাকে, জানালাম আমার ঘোড়া রোগের কথা। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি তার দু’দিন পর সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম উঠানে ঘোড়া বাধা। আমার আনন্দ দেখে কে।
কিন্তু আমি তো আর ঘোড়ায় চড়তে পারিনা আর ঘোড়াও আমাকে দেখলে কেমন জানি করে। অতঃপর খালুই ভরসা। সেদিন সেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ালাম সারা গ্রাম। সেদিনের মত আনন্দ আমি আজও কোন কিছুতে পাইনি।
এরই মাঝে সময় পেরিয়ে চলছে, আস্তে আস্তে একটি একটি করে বসন্ত পেরিয়ে আমিও বড় হচ্ছি।
কিন্তু আমি কখনই ভাবতে পারিনি আমার এই সোনালি দিনের সুর্য ডুবতে বসেছে। একদিন স্কুল থেকে এসে দেখি আমার ঘরে একটি লোক দাঁড়িয়ে আমার ছবির অ্যালবাম, ডায়েরি এগুলো দেখছে। সাধারণত এগুলো আমি কাউকে দেখতে দিই না। কারন এর মাঝে জড়িয়ে আছে আমার মায়ের সৃতি। হঠাত তাকে এটা দেখতে দেখে আমি বলে উঠলাম, আপনি কে? অনুমতি ছাড়া অন্যর জিনিস দেখা উচিত না এটা কি আপনি জানেন না? আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন, ছেলের জিনিস বাবা দেখবে তাও আবার অনুমতি নিতে হবে? আমি অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকি।
এই সেই আমার বাবা, যে আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন, এক মুহুর্তের জন্যও ভাবেননি আমার কি হবে। এই সেই লোক যার জন্য আমি হারিয়েছি আমার মাকে! বাবা দেখতে এমন হয়! হঠাত কেমন যেন বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল মন, বলেই ফেললাম কেমন বাবা আপনি যে নিজের সন্তান কে ফেলে চলে যায় দূর দেশে, কোনো দিন খোঁজ নেবার প্রয়োজন বোধ করেননি। আর আজ এসেছেন পিতৃতের দাবি নিয়ে?
যাই হোক কিছুদিন পর জানতে পারলাম এই বাবা নামের অদ্ভুত লোকটি নাকি আমাকে নিয়ে যেতে চান। যেদিন শুনলাম সেদিন থেকে আমার সব কিছু বন্ধ হয়ে গেল। কারন আমার নিজের জন্মদাতা আমার জন্য যা করেননি, আমার খালা-খালু নিজের সব কিছু বিসর্জন দিয়েছেন আমার জন্য।
আমি কিভাবে তাদের ছেড়ে থাকব? নিয়তির নির্মম পরিহাসে আমাকে পাড়ি জমাতে হল এই দূর পরবাসে। এখানে এসে কিছুই ভাল লাগেনা। এখানে নেই সেই অবারিত খোলা প্রান্তর, শুনতে পাই না সন্ধ্যার আঁধারে ঝি ঝি পোকার ডাক……………।
সময়ের সাথে সাথে হয়ত সবাই বদলে যায়। আমিও বদলাতে থাকি আস্তে আস্তে করে।
এত দিন পর দেশে জাচ্ছি, মনটা ভাল থাকার কথা, কিন্তু তা না, জানতে পারলাম আমার সেই খালা যাকে আমি আমার মা বলে জানি তিনি খুব অসুস্থ। লিউকেমিয়া নামক জটিল দুরারোগ্য বাধ্যি কুরে কুরে নিঃশেস করে দিয়েছে তার প্রতিটি রক্তকণা। যে রক্তকনায় মিশে আছে আমার জীবন, এই জটিল রোগ আজ তা বিষিয়ে দিয়েছে। আর তাইতো সকল বন্ধন ছিন্ন করে ছুটে চলেছি আমার সেই জনম দুঃখী মায়ের কাছে। মা………. তুমি অপেক্ষা করো আমি আসছি।
ছোট বেলায় লুকোচুরি খেলতে খেলতে হঠাত হারিয়ে যাবার মত আমার জীবন থেকে তুমি হারিয়ে যেও না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।