ছিলেন ফুটবল খেলোয়ার হলেন রাজনীতিবিদ। জীবনে কোনো নির্বাচনে হারেননি আব্দুর রাজ্জাক, তবে প্রকৃতির নিয়মে মৃত্যুর কাছে হার মেনে গত শুক্রবার চলে গেলেন তিনি, অবসান ঘটলো ৫০ বছরের উজ্জ্বল এক রাজনৈতিক জীবনের। ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রাজনৈতিক নেতা, যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির আন্দোলনের সংগঠক, মন্ত্রী- এসব পরিচয় ছাপিয়ে রাজ্জাকের চরিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য ছিলো সব সময় গণমানুষের সঙ্গে থাকা। বলা যায়, ব্রিটিশবিরোধী লড়াই থেকে শুরু করে এই অঞ্চলে রাজনীতিবিদদের জীবনাচারণ এখন হারিয়ে যেতে বসলেও তা ধরে রেখেছিলেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।
তাই তার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি ছিলেন ভোট ও ভাতের অধিকারের লড়াইয়ের অগ্রণী সৈনিক।
দল ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুন রাজ্জাকের বাড়িতে সকাল থেকে দেখা যেত সাধারণ মানুষের ভিড়। আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি নানা সমস্যায় তাকে সব সময় পাশে পেয়েছে সাধারণ মানুষ। রাজ্জাককে হারানোর প্রতিক্রিয়া তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ জানালেন এভাবে- “তিনি ছিলেন আমার নেতা। আজ আমি শূন্য হয়ে গেলাম। অর্ধশতকের বেশি সময়ের রাজনৈতিক জীবনে রাজ্জাক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন দুই বার, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এক বার, দীর্ঘদিন ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য।
স্বাধীনতার পর যতবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন, কোনো বারই এলাকার মানুষ তার থেকে মুখ ফেরায়নি। তোফায়েল বলেন, “তিনি কখনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। ”
১৯৯১ সালে যখন দুটি আসনে রাজ্জাক বিজয়ী হয়েছিলেন, তখন তিনি আওয়ামী লীগে নন, বাকশালের সভাপতি। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর সম্মেলনে মতানৈক্য নিয়ে আওয়ামী লীগ ছেড়েছিলেন তিনি। ’৯০ এর দশকে বাকশাল হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগে একীভূত হলে সভাপতিম-লীতে স্থান পান রাজ্জাক।
তবে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থায় দলের সংস্কারের প্রস্তাব তুলে তিনি আবার শেখ হাসিনাবিরোধী নেতাদের কাতারে চলে যান। এরপর হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারে ঠাঁই হয়নি তার। হারান দলে নীতি-নির্ধারণী ভূমিকাও। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন রাজ্জাক। ১৯৯৬ সালের পানিসম্পদমন্ত্রী রাজ্জাক এবার দায়িত্ব পান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির।
শোকাহত তোফায়েল জানান, লন্ডনের হাসপাতালে রাজ্জাকের সঙ্গে দেখা করার সময় তিনি তাকে বলেছিলেন, “ইচ্ছে ছিলো দেশের মানুষের জন্য কিছু করার। মনে হয় তা আর হবে না। ”
“অনেক কষ্ট নিয়ে চলে গেলেন তিনি,” বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ তার। রাজ্জাকের রাজনৈতিক শিষ্য শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন তোতা মাঝির কণ্ঠে ক্ষোভ, “জীবদ্দশায় আমাদের গুরুর যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। ” শরীয়তপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের এক পরিবারের সবার ছোট রাজ্জাকের জাতীয় রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে ঢাকায় পড়তে এসে।
বাষট্টির শিক্ষা অন্দোলন, চৌষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান ৩০ বছর পেরোনোর আগেই রাজ্জাককে পরিণত জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক হিসেবে।
দুই বার ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পর ’৬৯ সালে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হন রাজ্জাক। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনীর অন্যতম পুরোধাও ছিলেন তিনি। “আব্দুর রাজ্জাকের মতো দক্ষ রাজনৈতিক সংগঠক আর সৃষ্টি হবে না,” বলেন তোফায়েল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘৭২ থেকে তিন বছর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন রাজ্জাক।
বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করে রাজ্জাককেই দিয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব।
’৭৫ এ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর কারাগারে যেতে হয় তাকেও। একই সময়ে কারাভোগকারী তোফায়েল জানান, ওই সময় তিন বছর জেল খেটেছেন রাজ্জাক। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের ভোট দিয়ে শুরু হয়ে তার নির্বাচনী জয়যাত্রা। এরপর ২০০৮ পর্যন্ত যতবার ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিলেন, একবারও তাতে ছেদ পড়েনি।
তোফায়েল বলেন, “রাজ্জাক ছিলেন দলের সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্য। তিনি খুব সহজেই কর্মীদের আপন করে নিতে পারতেন। ” একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে থাকা রাজ্জাকের নেতার প্রতি নিষ্ঠা ছিলো জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। তোফায়েল বলেন, “১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে চেন্নাই হাসপাতাল থেকে দেশে আসেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার এতো গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিলো যে তিনি ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে তার প্রতিকৃতিতে ফুল দিতে আসেন।
” সেদিন বঙ্গবন্ধু ভবনেই অসুস্থ হয়ে পড়ে যান রাজ্জাক, এরপরই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয়তার জন্য ১৯৬৫-৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন প্রয়াত এই নেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সম্মানসহ এমএ ডিগ্রি নেওয়ার পর এলএলবি ডিগ্রিও নেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে রাজ্জাক ইন্টারমিডিয়েটের পাঠ নিয়েছিলেন ঢাকা কলেজে। ডামুড্যা মুসলিম পাইলট হাইস্কুল থেকে ’৫৮ সালে মেট্রিক পাস করে এই কলেজে ভর্তি হন তিনি।
১৯৯৬ এর রাজ্জাক পানিসম্পদমন্ত্রী থাকার সময়ই বাংলাদেশ-ভারত গঙ্গা চুক্তি হয়। ’৯০ এর দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সূচিত আন্দোলনের সংগঠক এবং গণআদালতের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতিও ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে বিয়ে করেন রাজ্জাক। মৃত্যুর সময় স্ত্রী ফরিদা রাজ্জাক, দুই ছেলে নাহিম রাজ্জাক ও ফাহিম রাজ্জাককে রেখে গেছেন তিনি।
তার একমাত্র মেয়ে রুম্পা আট বছর বয়সে ব্লাড ক্যান্সারে মারা যায়। ১৯৪২ এর ২ মে শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার দক্ষিণ ডামুড্যা গ্রামে ইমাম উদ্দিন ও আখফাতুননেসার ঘরে জন্ম নেওয়া রাজ্জাকের শেষ জীবন কেটেছে ঢাকার গুলশানে। গুলশান-২ এর ৭৬ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়িটি ছিলো তার ঢাকার ঠিকানা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।