ইউরোপীয় দেশগুলোতে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের করুণ পরিণতি হিসেবে এসব দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থিক সংকটে পতিত সবগুলো ইউরোপীয় দেশে বেকারত্ব কম বেশি বেড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্ভরযোগ্য সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, এসব দেশে বর্তমানে গড় বেকারত্বের হার ১০.৮ শতাংশ। ইউরোপের গত দু'দশকের ইতিহাসে এ হার নজীরবিহীন। এখানো আমরা এ সম্পর্কে খানিকটা আলোচনার প্রয়াস পাবো।
পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকরা চলতি বছর অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে বিশ্ব শ্রমিক দিবস পালন করেছে। এ সব দেশের অর্থনৈতিক সংকট আর্থিক বাজারকে ছাপিয়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করেছে। বেকারত্বের হার বেড়েছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে এবং বাজারে জিনিসপত্রের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে ২০০৭ সালে বেকারত্বের হার ছিল শতকরা ৭ ভাগের কম। তখন থেকে প্রতি বছর এ হার শুন্য দশমিক পাঁচ ভাগ হারে বেড়েছে এবং চলতি বছরে তা প্রায় ১১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে স্পেনের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত মার্চ মাসে সেদেশে বেকারত্বের হার ছিল ২৪.৪ শতাংশ। দেশটিতে বর্তমানে কর্মক্ষম বেকার ব্যক্তির সংখ্যা ৫৬ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০।
স্পেনে শুধুমাত্র ২০১২ সালের প্রথম তিন মাসে তিন লাখ ৬৫ হাজার ৯০০ ব্যক্তি চাকরি হারিয়েছেন। এ ধারা বজায় থাকলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ আরো ১০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়ে পথে বসবেন।
দেশটির ২৫ বছরের কম বয়সী মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ। বর্তমানে স্পেনের যুব সমাজের অর্ধেকেরও বেশি বেকার। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসে ম্যানুয়েল মারগালো তার দেশের বেকার সমস্যা সম্পর্কে বলেছেন, বেকারত্বের এ পরিসংখ্যান সরকারের জন্য একটি ভীতিকর ব্যাপার।
এইচএসবিসি ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা স্টিফেন কিং বলেছেন, স্পেনে গ্রিসের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। স্পেন সরকার অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য কয়েকটি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
সরকারি খাতের কর্মজীবী মানুষের বেতন কমিয়েছে, অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বাড়িয়েছে এবং শিক্ষা ও চিকিতসাসহ বিভিন্ন ধরনের সরকারি সেবা খাত তুলে দিয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়েছেন এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ফলে বহু কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে। কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা তরুণ সমাজের মধ্যে বেকারত্বের হার বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, বেকার তরুণদের মধ্যে এখন হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে এবং তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।
ইউরোপের প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডেভিড স্ট্যাকলার বলেছেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ার পর আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে গেছে। ইউরোনিউজ এক প্রতিবেদনে বলেছে, অর্থনৈতিক সংকট ইউরোপে আত্মহত্যার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১০ সালে গ্রিসে আত্মহত্যার হার যেখানে ছিল শতকরা ১৮ ভাগ, সেখানে ২০১১ সালে তা ২৫ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ অর্থনৈতিক সংকট শুরু হওয়ার আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে গ্রিসে আত্মহত্যার হার ছিল সবচেয়ে কম।
এথেন্সের একটি হাসপাতালের মনোরোগ চিকিতসক উরতিস জিওতাকুস বলেছেন, আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগের কখনো কোন মানসিক সমস্যা ছিল না।
এসব মানুষ জীবনে অর্থনৈতিক সংকট কাকে বলে তা জানতো না। হঠাৎ করে বেকারত্বের চাপ সহ্য করতে না পেরে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। তারা মনে করেছে, একমাত্র মৃত্যুই তাদের অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান দিতে পারে। সম্প্রতি এথেন্সে অবসর গ্রহণকারী এক বয়স্ক ব্যক্তির আত্মহত্যার পর ব্যাপক সরকার বিরোধী বিক্ষোভ হয়। ৭৭ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি একটি ওষুধের দোকানে কাজ করতেন।
তিনি এথেন্সের একটি মেট্রোরেলের স্টেশনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন, "আমি একজন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। আর সহ্য করতে পারছি না । " এর পরপরই তিনি হাতের পিস্তল নিজের মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করে দেন।
হতভাগ্য ওই ব্যক্তির কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, "৩৫ বছর বীমার অর্থ পরিশোধের পর যে পরিমাণ মাসিক ভাতা পাচ্ছি, তা দিয়ে জীবন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই ডাস্টবিনে নোংরা খাবার খোঁজার আগে সম্মানজনকভাবে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছি।
" এ সম্পর্কে রাশা টুডে নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক তেস আরসিলিয়া বলেন, এথেন্সের ওই বৃদ্ধের মতো ইউরোপজুড়ে লাখ লাখ মানুষ রয়েছেন, যারা সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে চরম দুর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছেন। ইতালির এক বৃদ্ধা দারিদ্রের অভিশাপ সইতে না পেরে তিনতলা ভবনের ব্যালকনি দিয়ে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। ইতালির দৈনিক 'ইল সুলা' এ সম্পর্কে লিখেছে, অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনের কোন সম্ভাবনা না থাকার কারণে আত্মহত্যার এ প্রবণতা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে।
অবস্থা এতটা শোচনীয় হয়ে পড়েছে যে, ইউরোপের বহু পরিবারের পক্ষে দু'বেলা দু'মুঠো অন্নের সংস্থান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী-এমনকি অনেক গৃহবধু সংসারের ভরণ-পোষণের জন্য দেহব্যবসায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন।
লঙ্গরখানাগুলোতে দিন দিন মানুষের ভিড় বাড়ছে। কিছুদিন আগে ব্রিটেনের ব্রিস্টল শহরের একটি লঙ্গরখানার পরিচালক ভবঘুরে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এক বছর আগে তার কেন্দ্রে সপ্তাহে মাত্র দু'দিন আড়াইশ' ব্যক্তিকে খাবার দেয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে প্রতিদিন খাবার তৈরি করতে হয় এবং এখন সেখানে প্রতিদিন ৪০০ ব্যক্তি খাবার খেতে আসে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।