এবারের ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরের বাজেটের কথা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যে যে স্থানে মাননীয় অর্থ-মন্ত্রীর একটু বিবেচনা করা দরকার, তাই উল্লেখ করব। বাজেটের কি ভাল হয়েছে, তা বলা বা পড়ার সময় নেই, সেটা চাটুকারদের জন্য তোলা থাক।
আগামী ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার ব্যয় প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর মধ্যে এক লাখ ৪৫ হাজার ৭১৪ কোটি টাকার আয় বা রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা রয়েছে। ঘাটতি রয়েছে ৪৬ হাজার ২৪ কোটি টাকার।
যা মোট ব্যয়ের ২৪ শতাংশ (৪৬০২৪/১৯১৭৩৮=০.২৪=২৪%)। এই ঘাটতি টাকা উনি কোথা থেকে জোগাড় করবেন, আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। বিদেশী অনুদান বাদ দিলে ঘাটতি গিয়ে পৌঁছাবে ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে সরকারের মরিয়া হয়ে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ গ্রহণ ও টাকা ছাপানোর মাধ্যমে মুদ্রার যোগান বৃদ্ধি মুল্যস্ফীতি বাড়ানো ও সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য খুবই খারাপ ছিল। বিদেশি ঋণ এর অর্থ প্রাপ্তিতেও বিভিন্ন জটিলতা ছিল।
ফলে, এবার টার্গেট অনুযায়ী বিদেশী ঋণ পাওয়া সম্ভব হবে কিনা, তা দেখার বিষয়।
বাজেটে পদ্মা সেতুর মত বিশাল বাজেটের অর্থের সংস্থান কোথা থেকে হবে, সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। ৩ বছর ধরে পিপিপির কথা শুনে আসলেও এখনো এ ধরণের কোন প্রজেক্ট শুরু হয়নি।
আর্টিকেল ১৩৮-এ, সড়ক ব্যবহার ফি চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। জনগণ ফি দেবে, উনারা রাস্তা কাটার টেন্ডারে ভাল ইনকাম করবেন আর সেবা দেবার বেলায় ঠনঠন হলেতো সমস্যা।
বিদ্যুত ও জ্বালানীর মুল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে করা হবে। ফলাফল, বিদ্যুত ও জ্বালানীর মুল্য-বৃদ্ধি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ানো। আর, বিদ্যুত ও জ্বালানীর মুল্য-বৃদ্ধির সাথে পণ্যের উতপাদন জড়িত। ফলাফল, মুল্যস্ফীতি। আবার বিদ্যুত উতপাদনের জন্য গ্যাসের প্রয়োজন ও গভীর সমুদ্রে কনোকো-ফিলিপসকে গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব প্রদান।
পরে ওদের কাছ থেকে সাঙ্গুর মত ডলারে গ্যাস কিনতে গেলে ডলারের যে সংকট সৃষ্টি হবে, সে ব্যাপারে কোন চিন্তা-ভাবনা নেই। কুইক রেন্টালের মত আরো একটি আত্ম-ঘাতী সিদ্ধান্ত। উচিত ছিল বাপেক্সকে শক্তিশালী করে তোলা। সমুদ্র সম্পর্কিত রায়ের পরেই যেন বাপেক্স কাজ শুরু করে দিতে পারে। কুইক রেন্টালের ব্যাপার বিজ্ঞ জনের জন্যই তোলা থাক।
নয়ত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার হুমকি সত্যি হতে পারে।
চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য অর্থমন্ত্রীর পরিকল্পনায় অবাক। আর্টিকেল ২৭৮-এ উনি বিদ্যমান ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছেন। আর্টিকেল ২৪৬-এ উনি সিনেপ্লেক্স নির্মাণের জন্য প্রণোদনা দিতে মনস্থ করেছেন। আর্টিকেল ২৬৬-তে সিনেমা হল ও সিনেপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ৫ থেকে ৭ বছরের কর অবকাশ প্রস্তাব করেছেন।
আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ স্টুডিও নির্মাণের জন্য বরাদ্দ না থাকলেও আমদানী করা হিন্দী সিনেমা বিদ্যমান ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ছাড়াই যেন সারাদেশে সিনেপ্লেক্স ও প্রেক্ষাগৃহে চলতে পারে, তার সুবন্দোবস্থ করা হয়েছে।
রেলওয়ে স্লিপারের উপর শুল্ক ৫% থেকে বাড়িয়ে ১২% করা হয়েছে। এ দিয়ে সরকার কি অর্জন করতে চায়, পরিস্কার নয়। এটিতো সরকারী রেলওয়ে ছাড়া আর কারো ব্যবহার ও আমদানী করার কথা নয়।
আর্টিকেল ২৬১-এ, পুঁজি বাজারে প্রণোদনা দেবার ফাঁকা বুলি আওড়ে মার্চেন্ট ব্যাংকের আয়করের হার ৪২.৫% থেকে কমিয়ে ৩৭.৫% করায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্যতো কিছু পাচ্ছিনা।
এইসব ব্যাংকের মালিক বড় বড় ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের জন্য এতবড় ঘাটতি বাজেটে এই উপহার অর্থমন্ত্রীর তরফ থেকে।
আর্টিকেল ২৬২ সারণী ২-এ, ৫০ হাজার টাকার অধিক অর্থ লেনদেনে ব্যাংকিং চ্যানেলে করতে হবে। না হলে খরচ হিসেবে বিবেচিত হবেনা। আজাইরা এইসব ঝামেলা বাড়িয়ে পাবলিকের দুর্ভোগ বাড়ানো।
আর্টিকেল ২৬৮ সারণী ৩-এ, সকল ধরণের রপ্তানির ক্ষেত্রে সোর্সে করের হার ০.৬০% এবং ০.৭০% থেকে বাড়িয়ে ১.২০% করা হয়েছে।
এমনিতেই ডলার সংকট ও আমদানী নির্ভর অর্থনীতি। রপ্তানী বৃদ্ধি করা খুবই জরুরী। তার পরেও এ খাতে কর বৃদ্ধি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও দেশীয় শিল্পের বিকাশের জন্য প্রতিকূল।
আর্টিকেল ২৭৬-এ, বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম ৩%, খুচরা ও পাইকারী ব্যবসায়ীর ২%, যোগানদার ব্যবসায়ীর ৪% বাতিল করে সকল ক্ষেত্রে ৪% প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে, ব্যবসায়ীরা মূল্য বৃদ্ধির লাইসেন্স পেয়ে গেলেন।
কারণ সকল ট্যাক্সের টাকা ভোক্তার পকেট থেকেই আসে। এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই বাজারে আবার জিনিষপত্রের দাম বৃদ্ধি। এই করে অর্থমন্ত্রী কি করে মূল্যস্ফীতি কমাবেন, খোদাই জানেন।
আর্টিকেল ২৭৭-এ, মোটরসাইকেল আমদানীর উপর ২০% রেগুলেটরী শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঢাকার ফুটপাথে বেয়াদব মোটর সাইকেল চালকদের জন্য হাঁটার উপায় নেই।
ভারতীয় মোটর সাইকেলে দেশ সয়লাব। ডলার সংকট, উচ্চ মুল্যের জ্বালানীতে উচ্চ ভর্তুকি। যন্ত্রাংশ সংযোজন করে দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বদলে এইরকম আমদানী করতে দেওয়াটাকে বলব, একটা ভাল সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
Nutritional Supplement এর শুল্কহার কমিয়ে একে উতসাহিত করে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোকে মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। বিশাল জনসংখ্যার এদেশ সবসময়ই এইসব কৃত্রিম ভিটামিন-মিনারেল ব্যবসায়ীর নজরে ছিল।
উন্নত বিশ্বে স্বাস্থ-বিভাগের মত নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিঙে দিন দিন এদের ব্যবসা সংকুচিত হয়ে আসায় এরা এখন তৃতীয় বিশ্বের বাজারে অধিক মনোযোগ দিচ্ছে যেখানে মনিটরিং খুবই সামান্য এবং ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই আপামর জনসাধারণ অনিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম ভিটামিন-মিনারেল গ্রহণ করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
আর্টিকেল ৬১-এ, বিগত ৩ বছরে ২২ হাজার ৮৫৭ কিলোমিটার নতুন বিদ্যুতের বিতরণ লাইন স্থাপন হয়েছে। খাম্বা বাণিজ্য তাহলে ভালোই হচ্ছে।
মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যে বই বিতরণ করতে গিয়ে প্রকাশনার কাজ ভারত থেকে করিয়ে আনা মুল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়। এটা দেশে করানো হলে কর্মসংস্থানের সাথে সাথে দেশীয় প্রকাশনা শিল্পের উন্নতি হত।
বাজেটে প্রকাশনা শিল্পের ব্যাপারে কিছু খুঁজে পেলামনা। যেমন পেলামনা সর্বনিম মজুরীর ব্যাপারে কিছু। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি যাতে আনুমানিক ৩৬ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে। ২০১০ সালে সরকার সর্বনিম্ন মজুরী নির্ধারণ করে ৩০০০ টাকা বা তখনকার ৪৩ মার্কিন ডলার। শ্রমিকদের দাবী অনুযায়ী সর্বনিম্ন ৫০০০ টাকার মজুরী করা হলে নাকি অনেক গার্মেন্টস মালিকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।
এত মুদ্রাস্ফীতির পর এখন ২০১২ সালে শ্রমিকেরা কি অবস্থায় আছে, জানতে ইচ্ছে করে। বাংলাদেশ গত বছর ২য় সর্বোচ্চ পোষাক রপ্তানীকারক ছিল যার পরিমাণ আনুমানিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর, এখনকার শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরী কত? ৩০০০ টাকা বা ৩৬ মার্কিন ডলার। তাহলে, এই মজুরীতে গার্মেন্টস মালিকদের শুধু শ্রমিকদের ঠকিয়ে কত লাভ হচ্ছে? (৪৩-৩৬=৭; ৭*১২*৩৬,০০,০০০=৩০২৪,০০,০০০) ৩০ কোটি ২৪ মক্ষ ডলার বা আড়াই হাজার কোটি টাকা। এরপরেও বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রীর সাথে মিটিং করেছেন উনারা, আরো সুযোগ-সুবিধা দরকার।
আর, সেদিন এক শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া গেল। এ নিয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বিভিন্ন আশংকার কথা শোনাচ্ছেন।
সবসময় নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতায় শোনা জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে কোন পরিসংখ্যান নেই। যদিও মুল্যস্ফীতি ও ইউটিলিটিজের মুল্য-বৃদ্ধি উল্লেখ আছে। এছাড়াও কর্মসংস্থান ও বেকার জনগোষ্ঠির পরিসংখ্যান এবং এ ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপের ব্যাপারে কোন আশার আলো নেই।
সার্বিক ভাবে এই বাজেট দেখে একটা কথা বলেই শেষ করছি, সুবহে সাদেকের এখনো দেরী আছে।
স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।