আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুজিব দর্শন ও বাঙালি মানবতাবাদ

মাজহার সরকার সেই জ্যোতির্ময়ী বছর একাত্তরে যখন আমরা সত্যিই মানুষ ছিলাম,তখন এক বিশাল মিছিল হয়েছিল,মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের মতো সেই জ্যোতির্ময় পুরুষটি। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে স্লোগানে মুখর ছিল এ বাংলার জনপদ। ওই একাত্তরেই রমনার প্রান্তরে পড়ন্ত বিকেলে তিনি প্রদর্শন করেছিলেন সেই ঐতিহাসিক তর্জনী। বাঙালির সুদীর্ঘ সময়ের মুক্তি আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সবচেয়ে সফল স্বপ্নদ্রষ্টা পুরুষ। ইতিহাসের আলোকে বিচার করলে দেখা যাবে এ-সময় বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব ছিল সেই প্রথম দিনের সূর্যের মতো।

যিনি সত্তার নতুন আবির্ভাবে জেগে ওঠে প্রশ্ন করেছিলেন,কে তুমি?জবাব ছিল, বাঙ্গালি। ঠিকানা ­­– পদ্মা,মেঘনা,যমুনা। বাংলার জনগণের মুক্তি-সংগ্রাম ইতিহাসের স্বরূপ ধরেই স্বাধিকার,স্বাধীনতা ও শোষণমুক্ত সমাজের পথে মোড় নেয়। আর সেই –পথেই অগ্রনায়ক শেখ মুজিব তাঁর শোষিত,নির্যাতিত জনগণের সংগ্রাম-আন্দোলনের অগ্নিপরীক্ষার ভেতর দিয়ে ডাক দিয়েছেন স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের। বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদ অর্থ,অস্ত্র নিয়ে এগিয়ে এসেছে সকল সময়েই।

বাংলাদেশের সময়েও তাঁর ব্যত্যয় ঘটেনি। শেখ মুজিব তাঁর জনগণকে নিয়ে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের এদেশীয় দালাল আমলা মুৎসুদ্দি ও পুঁজিবাদী ক্রীড়নক শক্তির বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিনের খণ্ডখণ্ড বিক্ষিপ্ত অগভীর বিদ্রোহ ও সংগ্রামকে বঙ্গবন্ধু যৌথ সমন্বিত, সুস্পষ্ট রূপ দান করেন স্বাধীনতার আপোষহীন লড়াইয়ে। স্বাধীনতা এসেছে এক রক্তক্ষয়ী পথে;শেখ মুজিবের উত্তাল ডাকে,নেতৃত্রে। আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ জাতির স্বাধীনতার ও মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে শুরু করে অবিরাম চক্রান্ত।

যুদ্ধোত্তর দেশে এ সবই চলালো সাম্রাজ্যবাদ তথাকথিত বৈজ্ঞানিক প্রগতিশীলতার নামে,চৈনিক সমাজতন্ত্রের নামে,পাকিস্তানি দালাল ও সাম্রাজ্যবাদের প্ররোচিত মোশতাকচক্রের গোপন কার্যকলাপের মাধ্যমে। জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি,অনৈক্য পথ তৈরি আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারনা সৃষ্টিতে এরা মত্ত হয়ে উঠে। স্বাধীনতা-উত্তর এই নাজুক পরিস্থিতিতে জনগণের মধ্যে একটা হতাশার সৃষ্টি হলো। সমাজ জীবনে নিয়ে এল লক্ষ্যহীনতা। তখন প্রয়োজন হয়ে পড়ল সৎ,সচেতন,ত্যাগী,দেশপ্রেমিক ও সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষের।

ইতিহাস,জীবন ও সমাজ প্রক্রিয়ায় এক দীর্ঘ পথ মাড়িয়ে বাঙালি জাতি তার শ্রেষ্ঠ প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবের হাত ধরে এক যুগ-সন্ধিক্ষনে এসে দাঁড়াল শাশ্বত সংস্কৃতির পথে,রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তর ঘটিয়ে একটি শোষণমুক্ত নতুন সমাজ তৈরির প্রত্যাশায়। বঙ্গবন্ধু শোষণহীন সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামান্তবাদী ব্যবস্থার সর্বশেষাংশ নির্মূল,অসাধু পুঁজির বিকাশকে খর্ব,সাম্রাজ্যবাদী শোষণের পথকে রুদ্ধ করে সমাজতন্ত্র উত্তরনের আশু পদক্ষেপ গ্রহন করেন। বঙ্গবন্ধুর নানা শ্রেণীর শত্রু ছিল — ১৯৭১ পূর্ব সব ধরনের পাকিস্তানী সরকার ও তাদের পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ছিল তার শত্রু নম্বর এক। তিনটি উদাহরণ দিই: আইউব শাহীর সামরিকতন্ত্র কর্তৃক তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা দায়ের যা কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। এই মামলায় পাক-সরকার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয় তা হল “গোপনসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের অনুসরণে এমন একটি ষড়যন্ত্র উদঘাটন করা হয় যার মাধ্যমে ভারত কর্ত্তৃক প্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও অর্থ ব্যবহার করে পাকিস্তানের একাংশে সামরিক বিদ্রোহের দ্বারা ভারতের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি স্বাধীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত থাকার দায়ে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কতিপয় ব্যক্তিকে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা আইনের আওতায় এবং কতিপয় ব্যক্তিকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চাকরির সাথে সম্পৃক্ত আইনের আওতায় গ্রেফতার করা হয়। ” অভিযুক্তদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে ১নং আসামী এবং কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে ২নং আসামী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। শেখ সাহেবের পরিচয় হিসেবে লেখা হয়: মি: শেখ মুজিবুর রহমান পি: মৌ: শেখ লুৎফর রহমান গ্রাম টুঙ্গীপাড়া,গোপালগঞ্জ,ফরিদপুর ২৫শে কালরাত্রির পরদিন ২৬শে মার্চ (১৯৭১) সন্ধ্যেবেলায় পাকিস্তানে বেতারে সামরিক জান্তা প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা ছিল: Sheikh Mujibur Rahman’s action of starting non-cooperation movement is an act of reason. He and his parts defied the lawful authorities…have tried to run parallel government….The man and his party are enemies of Pakistan, …he has attacked the soliderity of Pakistan. …this crime will not go unpunished.” ইয়াহিয়ার সাধ কিন্তু অপূর্ণ থাকেনি। রণক্ষেত্রে বাংলার সৈনিকদের বিজয় ঘটলেও – পাকিস্তানী আদর্শে উজ্জীবিত ও সেনাপতি ইয়াহিয়ার আদর্শিক এতদ্দেশীয় অনুচররা সেই কাজ সমাধা করে ১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) সকালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। সেদিনও মোস্তাকের সূর্যসন্তানদের এক সন্তান মেজর ডালিম বাংলাদেশ বেতারে ঘোষণা দিয়েছিলেন : “স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।

তাঁর স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটেছে। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। ” অনেকে বিষয়টির গভীরে না গিয়ে বলে থাকেন শেখ মুজিব ও তাঁর সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে অপশাসন ও দুর্নীতির কারণে। কিন্তু তা ঠিক নয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় তাঁর আদর্শের জন্য যে আদর্শ বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্র কে তুলে ধরেছে। অন্যদিকে তাঁর হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পুরানো পাকিস্তানী ধ্যানধারণায় প্রবর্তন এবং বাংলাদেশকে একটি ধর্মতাত্ত্বিক স্টেটে রূপান্তরিত করা এবং সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্থলে ‘মুসলিম বাংলা’ নামের আদর্শভিত্তিক ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন।

স্বঘোষিত হত্যাকারীদের একজন হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক কর্ণেল ফারুখ একটি সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন- “শেখ মুজিবকে অবশ্যই মৃত্যুবরণ করতে হত। কারণ ঐ ব্যক্তিটি তার ধর্ম ইসলামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে — যে বিশ্বাস আমার (ফারুখ) জনগণের ধর্ম…। ”(১৯৭১)। হত্যাকাণ্ডের আর একজন নায়ক মেজর রশীদের ভাষ্যমতে ‘১৯৭৪’ এর গ্রীষ্মকালে ফারুখ ও রশীদ মুজিবকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা শুরু করে — যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ধর্মভিত্তিক ‘ইসলামিক রিপাবলিক রাষ্ট্রে পরিণত করা। ’ পরবর্তীকালে ৭ই নভেম্বরে (১৯৭৫) ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ১৯৭২ সালের গণতন্ত্রের লিপিবদ্ধ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্যগুলিকে নস্যাৎ করতে।

তিনি সামরিক ক্ষমতাবলে জনমত বা গণতান্ত্রিক বিধির তোয়াক্কা না রেখে তাঁর নিজস্ব চারনীতি প্রবর্তন করলেন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ১৯৭৬ সালের এক ঘোষণার মাধ্যমে, যেমন : ‘ আল্লাহ’র উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, স্বনির্ভরতা, এবং সকল শ্রেণীর মানুষের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত প্রশাসন এবং ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদ। ’ লক্ষ্যণীয় যে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিস্থাপন করলেন ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’, এবং সমাজতন্ত্রের নিজস্ব ব্যাখ্যা দিলেন ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার’! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরকাল আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করে এসেছেন। কিন্তু কি তাঁর আদর্শ ছিল ? কয়েকটি বৈশিষ্ট্য অবশ্য সাদা চোখেই চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত: জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা। এই জনগণ ছিল ১৯৪৭ উত্তর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল যা তখন পূর্ববাংলা নামে পরিচিত ছিল সেই অঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দ।

এই জনগণের কথা তিনি প্রায়শ: একটি বাক্যে প্রকাশ করতেন – ‘বিশ্ব আজ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত,- শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের দলে। ’ দ্বিতীয়ত: বাঙালী জাতীয়তাবাদ। পূর্ববাংলার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকেই তাঁর চিন্তাচেতনায় ‘বাঙালী’ জাতীয়তাবাদের ধারণা ক্রমশ: দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়। আর এ ধারণা থেকেই পূর্বপাকিস্তানকে ষাটের দশক থেকে ‘বাংলা’ বা বাংলাদেশ নামে অভিহিত করতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর একটি ঐতিহাসিক উক্তির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি: “এক সময়ে এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।

জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি — আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ (হইবে)। ” হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির মৃত্যুবার্ষিকীতে ৫। ১২। ৬৬ তারিখে প্রদত্ত ভাষণ। (দ্রষ্টব্য ‘বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, বঙ্গবন্ধু গবেষণাকেন্দ্র প্রকাশনা, ঢাকা, ১৯৯৩) এরও আগে ২৫।

৮। ৫৫ তারিখে তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদের স্পীকারকে উদ্দেশ্য করে যে বক্তৃতা করেছিলেন তার ঐতিহাসিকমূল্য আজও নি:শেষ হয়নি। এর অংশবিশেষ হল: Sir, you will see that they want to place the words ‘East Pakistan’ instead of ‘East Bengal’. We have demanded so many times that you should name it Bengal (Pakistan). The word ‘Bengal’ has a history, has a tradition of its own. অভিযোগ করা হয় শেখ মুজিব প্রথম জীবনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, পাকিস্তান-আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন ভারতীয় মুসলিমলীগের ছাত্রকর্মী হিসেবে। তথ্য হিসেবে ঘটনাটি সত্য। কিন্তু এটাও ছিল ব্রিটিশ যুগে অবহেলিত বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠীর কল্যাণচেতনা থেকে উদ্ভূত।

অনেকের মতে তখন তাঁরও মনে হয়েছিল পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠা হয়তো, বিশেষ করে, পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গীয় সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ১৯৪৮ থেকেই গণবিরোধী মুসলিম লীগ শাসকদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানীদের আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নিতে থাকেন — সেটি বিস্তৃত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবী আদায়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, মুসলিম লীগের বিপরীতে জনতার লীগ ‘আওয়ামী মুসলিম’ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সক্রিয় ও অগ্রগামী ভূমিকার কথা নতুন করে বলবার প্রয়োজন নেই। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা। ছাত্রাবস্থায় মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ততা থাকলেও তাঁর রাজনৈতিক চেতনা উদার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উন্নীত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে পরিণত করায় তাঁর ভূমিকা ছিল দৃঢ় ও সক্রিয়।

এর ফলে আওয়ামীলীগের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালীর জন্য। দেশে সেক্যুলার রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাতাবরণ শুরু হল। এরই পথ ধরে জন্ম নিল মৌওলানা ভাসানী মিঞা ইফ্তেকার, সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি প্রভৃতি উদারপন্থী সেক্যুলার রাজনৈতিক দল সমূহ। এর আগে যুবকদের সংগঠন অসাম্প্রদায়িক যুবলীগ এবং পরে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ছাত্রলীগের চরিত্রও বদলে গেল অসাম্প্রদায়িক বাঙালী চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি নতুন দলে রূপান্তরিত হল — যাদের ঠিকানা হয়ে দাড়াল “পদ্মা-মেঘনা-যমুনা”।

১৯৭৩,১৯ অগাস্ট শেখ মুজিব বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে বলেছিলেন,”ছাত্র ভাইয়েরা আমার,দেশের যে দিকে তাকাই সে দিকেই চোর দেখি। চোরের জ্বালায় আমি অস্থির। যার উপর কোন কাজের ভার দেই সে-ই চুরি করে,বিলেত চলে যায়। সেইজন্যেই বলেছিলাম,সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ দরকার। তা না হলে শেখ মুজিব কে বেটে খাওয়ালেও পারা যাবে না।

আফসোস তো সেইখানেই। কিছুসংখ্যক লোক আছে যেখানে পায় সেখানে চাড়া দেয়। এখন প্রয়োজন জনমত সৃষ্টি করা। বাংলার ছাত্র সমাজ,একাজ তোমরা পারো। তোমাদেরই নিয়ে আমি স্বাধীনতা সংগ্রাম আরম্ভ করেছিলাম।

যারা আগে ছাত্র লীগ করতো তারা জানতো যে। আমি কি চাই?তাদের সঙ্গে নানা পরামর্শ করে আন্দোলন করতাম। তাই বলি,এখনও সংগ্রাম শেষ হয় নাই। শুরু হয়েছে মাত্র। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শৃঙ্খলার প্রয়োজন।

“বঙ্গবন্ধু আরো বলেন,”অনেকে বলে বঙ্গবন্ধু তুমি কঠোর হও। কিন্তু কঠোর হওয়ার পরিবর্তে আমি ক্ষমা করেছি। যদি এটা অন্যায় হয়ে থাকে তবে তাঁর প্রতিবিধান আমাকে করতে হবে। এরা বাংলার মানুষ বলেই ক্ষমা করেছি। স্বাধীনতার পর আর রক্তপাত আমি দেখতে চাই নাই।

“ শেখ মুজিবের এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাই তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ১৯৬৪ সালে তদকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের ইঙ্গিতে সৃষ্ট হিন্দু বিরোধী সেই ঐতিহাসিক সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে “পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও”। শেখ মুজিবের জনগণের অধিকার আদায় বিশেষ করে পূর্ববঙ্গবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় স্বাধীকার আন্দোলনের পথ ধরেই এল ঐতিহাসিক ৬ দফার দাবী,—শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন ‘আমাদের বাঁচার দাবী। এর চুম্বক কথাগুলো হল পাকিস্তানে ফেডারেল ধাঁচের রাষ্ট্র কাঠামো,এর ভিত্তি হবে জনগণের গণতন্ত্র,— সরকার হবে সংসদীয়, নির্বাচন পদ্ধতি সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটার ভিত্তিক; ফেডারেল সরকার কেবল দেখাশুনা করবে ‘প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়; বাংলাদেশ অঞ্চলে বাঙালীদের নিয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী মিলিশিয়া থাকবে যার দায়িত্ব হবে পূর্ববাংলায় প্রতিরক্ষা। কতিপয় বিশেষ মহল ব্যতিরেকে এই দাবী বাঙালীদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যার ফলে আইউব সরকার সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু এই কর্মসূচীকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ব্যাপী জনসংযোগ-সভা-সমিতি করেন; তাঁর নিজের ভাষাতেই বলা যায়:“….. চোঙামুখে দিয়ে রাজনীতি করেছি।

…বাংলাদেশের এমন কোন থানা নেই যেখানে আমি যাই নি। ” আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব, বিশেষ করে শেখ মুজিবের ওপর নেমে আসে নানা ধরনের জুলুম ও নিপীড়ন। শঙ্কিত প্রেসিডেন্ট আইউব শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সতর্কবলী উচ্চারণ করলেন: “…বর্তমান সরকারের আমলে পূর্ব পাকিস্তান পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন ভোগ করিতেছে। …যাহারা প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে চেঁচামেচি করিতেছে তাহারা প্রকৃতপক্ষে দেশের দুইটি অংশের বিচ্ছিন্নতা করিতেছে। ”(২৯শে মার্চ,১৯৬৭) এই ৬ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের পথ ধরেই এল জনগণের স্বাধিকার আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন যার চূড়ান্ত পরিণতি বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ।

বাঙালীর নিজস্ব রাষ্ট্র – একটি পতাকা। এই অর্জনের পশ্চাতে যার সবচাইতে বড় অবদান তাঁর নাম:বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান — একটি নতুন রাষ্ট্রের স্থপতি – যার নাম ‘বাংলাদেশ’ -একটি নতুন জাতির জনক, যে জাতির নাম ‘বাঙালী’ জাতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের আর একটি স্তম্ভ হল পশ্চিমী ধাচের উদারনৈতিক গণতন্ত্র। সেই সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ বেয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনে পরিবর্তন আসে ধাপে ধাপে এরই চূড়ান্ত পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতা থেকে উত্তীর্ণ হলেন বাংলাদেশের অসংবাদিত জাতীয় নেতায়। আবির্ভূত হলেন পরিপূরক রাষ্ট্র নেতায় যে স্তরে অন্যকোন রাজনৈতিক নেতা উঠে আসতে পারেন নি।

পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু স্থান করে নিলেন গান্ধী, নেহেরু, মাও সে তুং, সুকর্ণ, হোচি-মিন, নাসের-টিটো, মান্দেলা, ফিডেল ক্যাস্ট্রো প্রমুখ নেতাদের পংক্তিতে। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনে শেষ পর্যায়ে, যখন তিনি উন্নীত হয়েছেন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে, যুক্ত হয়েছে ‘সমাজতন্ত্র’। তাঁর এই সমাজতন্ত্র কিন্তু কট্টর মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র নয়। এই সমাজতন্ত্র মিশ্র অর্থনৈতিক — এখানে স্থান পাবে রাষ্ট্রিয় আর্থ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান —পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পূরক সহাবস্থান। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সামরিকতন্ত্রের কোন স্থান ছিল না তিনি বিশ্বাস করতেন না বাংলাদেশের মত অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ও অর্থ সম্পদে দুর্বল একটি রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন ব্যয়বহুল শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী।

এছাড়া শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী সবসময় দেশের গণতন্ত্রের সুষ্ঠুবিকাশের জন্য, বিশেষ করে, পশ্চাৎপদ উন্নয়নশীল দেশে- সবসময় হুমকি স্বরূপ। তিনি মনে করতেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত জনগণই বাংলাদেশের আসল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা — এছাড়া দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করবে আমাদের সুরক্ষায়। তার এই আদর্শই ডেকে আনে নিজের সর্বনাশ — সেনাবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট একটি অংশ তার হত্যার সাথে যুক্ত হওয়া কোন আকস্মিক ঘটনা হতে পারে না। বাকশাল এর পূর্ণ নাম বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীবলে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং দেশের সমগ্র রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল নামক এই একক রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী উত্থাপন করেন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে প্রচলিত সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করে বাকশাল ব্যবস্থা চালু করা হয়। সংসদে উত্থাপনের মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে এই বিল সংসদে পাশ হয়। বাকশাল ব্যবস্থা ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা। ৪/৭/২০০৯ তারিখের সমকালে মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার বাকশাল সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, সমাজে সুষম বণ্টন নেই।

গ্রাম ও শহরের জীবন ব্যবস্থায় আকাশ-পাতাল ফারাক। জাতীয় সংসদে ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সব শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব নেই। এমনকি আমাদের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছিল যে কৃষক ও শ্রমিক তাদেরও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে কোনো অংশগ্রহণ না থাকায় তারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যাতে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করতেই বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছিলেন। বাকশাল কর্মসূচির কয়েকটি প্রধান উদ্দেশ্য এখানে তুলে ধরা হলো।

এক. জনগণের জন্য পাঁচ মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা নিশ্চিত করা; দুই. গ্রাম পর্যায়ে বিদ্যুতায়ন ও দ্রুত যোগাযোগের ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে সব শ্রেণীর মানুষ নূন্যতম সুবিধাটুকু পেতে পারে। বঙ্গবন্ধু জানতেন, পানি বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে যথেষ্ট পানি বাংলাদেশ পাবে না। সেক্ষেত্রে কৃষক বৈদ্যুতিক সেচব্যবস্থা ব্যবহার করবে। পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষাবাদ করলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।

তিন. তিন কোটি টাকার ওপরে কোনো শিল্পের মালিক কেউ হতে পারবে না। এ যুক্তিতেই বড় বড় শিল্পকারখানা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছিল, যাতে শ্রমিক তার ন্যায্য হিস্যা পায়। তৎকালীন সময়ে তিন কোটি টাকা কি অনেক বেশি ছিল না? এ পরিমাণ অর্থ কি আসলে একজন মানুষের প্রয়োজন আছে? যেখানে দেশের অধিকাংশ মানুষই ঠিকমতো খেতে পায় না। লাগামহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যে দুর্গতি বয়ে আনে আমেরিকাসহ বিশ্বের অর্থনৈতিক ধস তারই প্রমাণ। চার. বাকশাল কর্মসূচির সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল সমাজ থেকে দুর্নীতি, শোষণ চিরতরে দূর করা।

এখন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা, নির্বাচন কমিশন সারাক্ষণ চেঁচাচ্ছেন সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার জন্য। সংবিধানের মৌল-কাঠামো জাতীয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র,গনতন্ত্র,ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব নতুন দেশের রাষ্ট্রনীতি গ্রহন করেন। বাকশাল সমাজতন্ত্রে উত্তরনের সবচেয়ে বলিষ্ঠ পদখেপ,এ-দেশের সমাজ,সংস্কৃতি অর্থনীতির ভিত্তিকে সামনে রেখে মৌলিক রূপান্তরের কাঠামোটি এই কর্মসূচিতে ছিল সুস্পস্ট,রাজনৈতিক ও সাঙ্গঠনিক,সামাজিক-অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক এই চারটি অংশেই তিনি গ্রহন করলেন নতুন পদক্ষেপ,ডাক দিলেন বিপ্লবের। নির্বাচন যাতে অবাধ-নিরপেক্ষ হয়, কালো টাকার প্রভাবমুক্ত হয়, সন্ত্রাসীরা যাতে প্রভাব ফেলতে না পারে, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি যাতে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারে সে জন্যই বাকশালী ব্যবস্থায় নির্বাচন পদ্ধতিতে সাময়িক পরিবর্তন আনা হয়েছিল। পরিবর্তনটা ছিল, যারা প্রার্থী হবেন তাদের সব নির্বাচনী খরচ সরকার বহন করবে নিরপেক্ষভাবে।

সভা-সমাবেশ একই মঞ্চ ও ময়দানে হবে। প্রার্থীরা ভোট চাইতে বাড়ি বাড়ি যেতে পারবেন। এভাবে দুটি উপনির্বাচন হয়। একজন স্কুল শিক্ষক কিশোরগঞ্জে নির্বাচিত হন উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাইকে হারিয়ে। ক্ষমতার প্রভাব থাকলে বা কারচুপি হলে এমনটা হতো না।

বঙ্গবন্ধু বাকস্বাধীনতা বা গণতন্ত্রকে রুখবার জন্য বাকশাল প্রবর্তন করেননি। সবার জন্য বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করাই ছিল তার লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন জার্মানি বা সুইজারল্যান্ডের আদলে এক দেশ। তিনি বলেছিলেন, 'আমি বেঁচে থাকলে বাংলাদেশকে তৃতীয় বিশ্বের সুইজারল্যান্ড বানিয়ে ছাড়ব। ' বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতারা একেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন যে নেতৃত্ব তৃণমূল পর্যায় থেকে গড়ে উঠবে।

যে কারণে বলা হয়েছে যে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান কৃষক, শ্রমিক ও নারীদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হবে। আর সেই সঙ্গে হবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এখানে বঙ্গবন্ধু যে বাকশাল ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন তার মূল লক্ষ্য ছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় নেতৃত্বর উত্থান। স্থানীয় যোগাযোগবিহীন ঢাকা মুখীন রাষ্ট দিয়ে কতোটা কল্যাণ হবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বাকশাল ব্যবস্থায় জেলাপ্রধানের নাম দেয়া হয়েছিল গভর্নর।

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে জনগনের দোড়গোড়ায় পৌছে দিতে এর দ্বারা এটা পরিষ্কার বঙ্গবন্ধু জেলার স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠানকে কতোটা শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। প্রতিটি থানাতে থানা প্রশাসকের পদ সৃষ্টির কথা ছিল। শেষ পর্যায়ে ছিল গ্রাম সমবায়। একজন অতিরিক্ত সচিবকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল গ্রাম সমবায়ের কার্যক্রম মনিটর করার জন্য। জেনারেল জিয়ার গ্রাম সরকার কিংবা এরশাদের উপজেলা পদ্ধতি এসবের ধারণা নেয়া হয়েছিল বাকশালের থেকে।

তারা বাকশালের সমালোচনা করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছেন, কিন্তু ধারণা চুরি করেছেন বাকশাল থেকে। ১৯৭৫ কে এদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে watershed বলা হয়, কারণ এর পরই এদেশের অর্থনীতি থেকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে 180 Degree About Turn নিয়ে পুঁজিবাদের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু এই পুঁজিবাদীব্যবস্থায় দেশের উন্নয়ন আজও সাধিত হয়নি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ এখনও দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের চরমতম সাফল্য অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি স্বাধিকার আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসেন বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলন।

তাই বাঙালীর দাবী একদফার কেন্দ্রীভূত হল — “বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। ” ১৯৭১ সালের ১লা মার্চের ইয়াহিয়ার ঘোষণার জবাব দিলেন বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে — বাঙালীর অন্তরের কামনাকে ভাষা দিলেন : এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমাদের ভবিষ্যত রণসঙ্গীতের বাণী রচিত হয়ে গেল ৭ই মার্চে (১৯৭১)। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি আজও আমাদের রোমাঞ্চিত করে। তিনি মুজিব,ইতিহাসের মহানায়ক।

সেই মুহূর্তগুলি কবি নির্মলেন্দু গুনের ভাষায় বলি: একটি কবিতা লেখা হবে/তার জন্যে অপেক্ষা উত্তেজনা নিয়ে/লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা/বসে আছে/ ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে/কখন আসবে কবি। …. …. …./শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। …. …. …./গণসূর্যের মঞ্চ কাপিয়ে কবি/শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি —“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ”/সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের। কিন্তু আমরা অকৃতজ্ঞ বাংলার মানুষ স্বাধীনতার সেই অমর কবিকে হত্যা করলাম ‘নিস্কম্প্র’ হাতে।

চাইলাম ‘বঙ্গবন্ধু’-‘বাংলাদেশ’ ‘বাঙালী’ এই শব্দগুলিকে বাংলাদেশের হৃদয় হতে চিরতরে মুছে দিতে। তাই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতেও স্তব্ধ হলাম না — যেখানেই বঙ্গবন্ধুর নাম, যেখানেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, ভাস্কর্য —তার নামে প্রতিষ্ঠান সব ভেঙে দিতে চাইলাম উন্মত্ত হয়ে — কুৎসিত পন্থায়। অশালীন অশ্রাব্য ভাষায় তাঁকে অব্যাহতভাবে আক্রমণ করে চলেছে মুস্তাক আহমেদের সূর্যসন্তানের দল আর জিয়ার আদর্শের সৈনিকরা। কিন্তু তবুও কি বাংলাদেশের স্থপতির নাম মুছে ফেলা যাবে — দীর্ঘকায় মানুষটিকে খর্বকায় বামনে রূপান্তর করা যাবে! কঙ্গোর লুমুম্বা আমেরিকাকে বিশ্বাস করে ক্ষমতায় বসেই নিউইয়র্কে ছুটেছিলেন সাহায্যের আশায়। আমেরিকা ও বেলজিয়ামের চক্রান্তেই মবুতুর ঘাতকদের হাতে জাতিসংঘের পাহারায় তাকে প্রান দিতে হয়।

ভারতও এই খেলা খেলে নেহেরু নিহত হন নি;কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেন নি। কিউবার ক্যাস্ট্রোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। তিনি এখনো টিকে আছেন। তিনি সেই ভুল করেন নি। লুমুম্বা,এনক্রুমা,সুকর্ন,আলেন্দে যা পারেন নি;শেখ মুজিব তা পারতেন এমন অসম্ভব কথা বলি কেমন করে?সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো পাল্টা সুপার পাওয়ারের পেটের ভেতরই যেখানে গরবাচেভ,ইয়েলেৎসিনের মতো ‘ট্টোজান হর্স’ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে,সেখানে কঙ্গো,বাংলাদেশের মতো দেশগুলিতে মবুতু,মোশতাক তৈরি করা এমন কি অসম্ভব কাজ?বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন বাঙালীর হৃদয়ে — বাংলার সাধারণ মানুষের ভালবাসায়।

আমাদের সেই মর্মবেদনাকেই ভাষা দিয়েছেন প্রয়াত কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ঃ যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা/গৌরী যমুনা বহমান/ততদিন রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান/দিকে দিকে আজ রক্তগঙ্গা অশ্রুগঙ্গা বহমান/তবু নাহি ভয় হবে হবে জয়/জয় মুজিবুর রহমান। শোকাহত কবি মুহ্যমান বাঙালী সত্ত্বাকে আহ্বান জানিয়েছেন এই বলেঃ বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকো না নীরব দর্শক ধিক্কারে মুখর হও। হাত ধুয়ে এড়াও নরক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও তার সহায়ক শক্তি মূলত এদেশের সমাজতন্ত্রের উত্তরণের পথ অবরদ্ধ করে। কিসিঞ্জারের তালিকায় সবচেয়ে ঘৃণিত তিনটি নামের একটি ছিল বঙ্গবন্ধু।

সাম্রাজ্যবাদ বাকি দু’জনকেও হত্যা করেছে। এটি সাম্রাজ্যবাদের একটি ঘৃণ্য চক্রান্তের ফসল-লরেন্স লিপসুজের Bangladesh:the unfinished revolution নামক বইটিতে এর বিস্তৃত প্রামাণ্য বিবরণ রয়েছে। তাকে ভয় পাবার কারন ছিল লক্ষ লক্ষ মানুষকে আকর্ষন করতে পারেন সমাবেশে এবং আবেগময় বাগ্মিতার তরঙ্গে তাদেরকে সম্মোহিত করে রাখতে পারেন মুজিব। বাঙ্গালিদের তুলনায় মুজিব লম্বা (উচ্চতায় ৫ ফুট ১১ ইঞ্ছি),চুলের এক গুচ্ছে পাক ধরেছে,ঘন গোফ,সতর্ক দু’টি কালো চোখ। একজন কূটনীতিবিদ বলেছেনঃ’একাকী তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময়েও মনে হয় তিনি যেন ৬০,০০০ লোককে সম্বোধন করে বক্তৃতা দিচ্ছেন।

‘উর্দু,বাংলা ও ইংরেজি-পাকিস্তানের তিনটি ভাষায় তাঁর পটুত্ব আছে। নিজেকে মৌলিক চিন্তাবিদ বলে ভান করেন না মুজিব। তিনি রাজনীতির কবি-প্রকৌশলী নন;তবে বাঙ্গালিরা যত না প্রয়োগিক,তার চেয়ে শৈল্পিক বেশি। কাজেই,এই অঞ্চলের সকল শ্রেনী ও মতাদর্শকে ঐক্যবদ্ধ করতে যা প্রয়োজন,তাঁর রীতিতে হয়তো ঠিক তাই আছে। ১৯৮২ সালে মার্কিন সাপ্তাহিক ‘টাইম’ পত্রিকায় বলা হয়,স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশ বছরের মধ্যে মুজিবর রহমানের আমল ছিল সর্বপ্রথম এবং দীর্ঘতম গনতান্ত্রিক আমল।

শেখ মুজিবকে হত্যার পর হঠাৎ গনতান্ত্রিক আমলের অবসান ঘতে। (‘টাইম’ম্যাগাজিন,৫এপ্রিল,১৯৮২)। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়ঃ”শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারবর্গের মৃত্যুসংবাদ যদি সমর্থিত হয় তাহলে এদেশে তা ব্যাপকভাবে দুঃখজনক বলে বিবেচিত হবে। মুজিব বহুল পরিচিত এবং শ্রদ্ধেয় ‘স্টেটম্যান’(রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তি)ছিলেন। (দি গার্ডিয়ান,লন্ডন,১৬ আগস্ট,১৯৭৫)।

‘দি গার্ডিয়ান’ এর সংবাদদাতা টমাস মুর কর্তৃক ঢাকা থেকে প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়ঃ”খোন্দকার মোশতাকের অধীনে যারা বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন হয়েছে,তারা এখন নিহত শেখ মুজিবের রক্তের দাগ মুছতে গিয়ে(শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের চরিত্র)লেডি ম্যাকবেথের দুঃস্বপ্নের দৃশ্য পুনরাভিনয় করছে বলে মনে হয়। “ নোবেল ও লেনিন শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সন ম্যাকব্রাইড বলেন,শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন,স্বাধীনতা শুধু পতাকা পরিবর্তন অথবা দেশের নতুন নাম বুঝায় না। তাঁর দৃষ্টিতে স্বাধীনতার অর্থ হলো সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও আদর্শবাদ। ইতিহাসের সন্তান ইতিহাসকে পুননির্মান করেছেন। এইখানেই তাঁর নেতৃত্বের ঐতিহাসিকতা।

লেনিনের মৃত্যুর সংবাদ শুনে Geroge Bernod Shaw বলেছিলেন,Humanity has gone shorter by a man.জাতির জনকের মৃত্যুর পর বাংলার কবি মহাদেব সাহা লিখেছেন,”সারা বাংলায় তোমার সমান উচ্চতার আর কোনো লোক দেখি নি আমি”। বঙ্গবন্ধুর মানবতাবাদের প্রশস্তি কবি নির্মলেন্দু গুনের চেয়ে সুন্দর ভাষায় প্রকাশ আর কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। তাই তাঁর কথায় বলছি,’তোমার পা একবারও টলে উঠল না,চোখ কাঁপলো না। তোমার বুক প্রসারিত হলো অভ্যূত্থানের গুলির অপচয় বন্ধ করতে,কেননা তুমিতো জানো একটি গুলির মূল্য/একজন কৃষকের একবেলার অন্নের চেয়ে বেশি/কেননা তুমিতো জানো একটি গুলির মূল্য/একজন শ্রমিকের একবেলার সিনেমা দেখার আনন্দের চেয়ে বেশি/ মূল্যহীন শুধু তোমার জীবন শুধু,তোমার জীবন পিতা/তুমি হাত উঁচু করে দারালে,বুক প্রসারিত করে কি আশ্চর্য/আহ্ববান জানালে আমাদের। ‘ কবি শামসুর রাহমান ইলেকট্রার গানে লিখেছেন,”যতদিন আমি এই পৃথিবীর প্রত্যহ ভোরে/মেলবো দু’চোখ,দেখবো নিয়ত রৌদ্র-ছায়ার খেলা/যতদিন পাবো বাতাসের চুমো দেখবো তরুণ/হরিনের লাফ,ততদিন আমি লালন করব শোক।

“ গণমানুষ মুজিবকে তাদেরই লোক বলে জেনেছিল,যেমন জেনেছিল মাওলানা ভাসানী এবং শেরেবাংলা এ কে ফাজলুল হককে। বঙ্গবন্ধু বাঙালির সবচেয়ে বড় আয়ুধ। কারন মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়েও শক্তিশালী। লেখকঃমাজহার সরকার ,সহ-সভাপতি,জহুরুল হক হল ছাত্রলীগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তথ্যসূত্রঃ ১।

এম, এম আকাশ, ২০০৪, বাংলাদেশের অর্থনীতি- অতীত বর্তমান ভবিষ্যত, প্যাপিরাস, ঢাকা। ২। Asiatic Society, History of Bangladesh, Vol-2, Dhaka ৩। আবীর আহাদ, ১৯৯১, বঙ্গবন্ধুঃ দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনৈতিক দর্শণ, জনতা প্রেস, ঢাকা। ৪।

বাংলাদেশ তথ্য মন্ত্রনালয়,স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল-পত্র,বিভিন্ন খন্ড,ঢাকা,১৯৮২ ৫। A.M.A.Muhith,Bangladesh:Emergence of a nation,University Press Limited,Dhaka 1978 ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.