আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জিয়ার স্মৃতিঘেরা সেই বাড়িটি এখন...

অনুতাপ নিপীড়িত ব্যাথিত জনের শক্তিধরে অস্ত্রধারী শত সিপাহের জিয়ার স্মৃতিঘেরা সেই বাড়িটি এখন... নাছির উদ্দিন শোয়েব দীর্ঘ আটত্রিশ বছর ধরে তিনি এখানে থেকেছেন। সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ স্বামী জিয়াউর রহমানের সঙ্গে নিছক গৃহবধূ হিসেবে পা রেখেছিলেন বাড়িটিতে। তারপর স্বামী হারিয়েছেন। গৃহবধূ থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু বাড়িটি ছাড়তে পারেননি।

এখানে যে গড়ে উঠেছে তার স্মৃতির মিনার। এটিকে তিনি করেছিলেন নিজগৃহ। এই বাড়িতেই তিনি স্বামীর কফিন ধরে অজস্র ধারায় কেঁদেছেন। আবার ছেলেদের বিয়ে দিয়েছেন। পরিবারে নতুন অতিথি (নাতনি) আসায় তিনি আনন্দে ভেসেছেন।

এসব সুখ-দুঃখের স্মৃতি দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে খালেদা জিয়াকে এই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বর্তমান মহাজোট সরকারের সিদ্ধান্তে র্যাব-পুলিশ এবং সাদা পোশাকের সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা দল এই উচ্ছেদ অভিযান চালায়। কত শত স্মৃতির ধারক এই বাড়িটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বেগম খালেদা জিয়া কেঁদেছেন। কিন্তু এই কান্নার শব্দ ফ্যাসিস্টদের কানে পৌঁছেনি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের পরপরই দ্রুততার সঙ্গে ভেঙে ফেলা হয় বাড়িটি।

এই বাড়িটির এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। ক্যান্টনমেন্টর শহীদ মইনুল রোডের মাথায় দাঁড়ালেই দেখা যায় ১৬ তলা একটি সুউচ্চ ভবন। সদ্যনির্মিত ভবনের বাইরের অংশে আস্তরের কাজ চলছে। ভবনের ভেতরে প্রায় সব কাজই সম্পন্ন। পাশেই আরও দুটি ভবনের কাজ চলছে।

নির্মাণকর্মীরা কাজ করে যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে ভাঙা ইটের স্তূপ। কোথাও কোনো গাছপালা-ফুলের বাগান কিছুই নেই। যেন সবকিছু খা-খা করছে। সেখানে যে এত দিন গাছগাছালি ঘেরা একটি তিনতলা বাড়ি ছিল, তা আর বোঝার উপায় নেই।

মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস (এমইএস) বাড়িটি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। উচ্ছেদের প্রায় দেড় সপ্তাহের মধ্যেই ভেঙে চুরমার করা হয় মইনুল রোডের ৬ নম্বর বাড়িটি। মনেই হয় না, এখানেই একদিন স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা ও আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ছিল। যে বাড়িটি ছিল জিয়া পরিবারের ঠিকানা। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া দীর্ঘ প্রায় ৩৮ বছর ধরে এ বাড়িতেই ছিলেন।

শেখ হাসিনার সরকার তাকে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর এ বাড়ি থেকে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে বের করে দিয়েছে। দীর্ঘদিনের স্মৃতিঘেরা স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আবেগ-ভালবাসা জড়িত বাড়ি থেকে জোর করে বের করে দেয়ার পর খালেদা জিয়া কেঁদেছেন। তিনি ব্যথিত হয়েছেন। বুকফাটা কষ্ট এখনো জড়িয়ে আছে তাকে। জানা গেছে, বেগম খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের পর অল্প সময়ের মধ্যেই সেই বাড়িটি ভেঙে চুরমার করা হয়েছে।

সেখানে এখন গড়ে উঠছে চার ইউনিটের ১৬তলা ভবন। ওই জমির ওপর গড়ে উঠবে এমনি ধরনের ৬টি উচ্চ ভবন। একটির কাজ কেবল সম্পন্ন হয়েছে। আরও দু‘টি ১৬তলা ভবন অল্প সময়ের মধ্যেই নির্মিত হবে। বাকি তিনটি ভবনের কাজ শুরু হবে বর্তমান বাজেট অধিবেশনে পাস হওয়ার পর।

বাজেটে বরাদ্দ না থাকায় ওই তিনটি ভবনের কাজ শুরু করা যায়নি। নির্মিত ১৬তলা ভবনের চারটি ইউনিট। ভবনটিতে রয়েছে ৫৬টি ফ্ল্যাট। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রয়েছে দু‘টি গ্যারেজ। প্রতিটি ভবন একই আদলে নির্মাণ করা হবে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি সূত্র জানায়, ৭/৮ মাসের মধ্যেই দু‘টি ভবনের কাজ শেষ হবে। সূত্রটি জানায়, মইনুল রোডের সেই জমিতে পুরনো কোনো স্মৃতি নেই। সবকিছুই ভেঙে চুরমার করা হয়েছে। বেগম জিয়া যে বাড়িতে ছিলেন সেটি ভাঙা হয়েছে সর্বপ্রথম। ওই বাড়িটির জমির ওপরেই গড়ে উঠছে প্রথম ভবনটি।

মইনুল রোডের প্রবেশদ্বারে রস্তার দু‘পাশে ইট, সুরকি ছড়ানো ছিটানো। সড়কের প্রবেশমুখে কড়া নিরাপত্তা। সেখানে সাধারণের প্রবেশের কোনো সুযোগই নেই। নাম প্রকাশ না করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, পূর্বের স্মৃতি বলতে রয়েছে দু‘টি সেগুন গাছ। এই বাড়ির বাসিন্দারাও হয়তো এখন এখানে এসে অবাক হয়ে যাবেন।

বেগম জিয়ার দুই সন্তানের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির অবয়ব পুরোটাই বদলে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করার পরই সেনাসদর ওই বাড়ি ভেঙে সেখানে সেনা কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পায়। সূত্র জানায়, ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হলে সেখানে মেজর থেকে লে. কর্নেল পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তারা পরিবারসহ বসবাসের সুযোগ পাবেন। বাড়িটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আগ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার নিজগৃহ বলতে স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটিকেই জেনে এসেছেন। ছেলেদের বিয়ে হয়েছে নাতনিরা কোলজুড়ে এসেছে।

২০০৭ সালে মার্কিন-ভারত যৌথ প্রযোজনায় এক-এগারো বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপেছে। মইন-মাসুদের সেনারা চোখের সামনে থেকে দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। তারপর একদিন তিনিও গ্রেফতার হয়ে সাবজেলে গেছেন। এর মধ্যে মৃত্যু মিছিলে মা যুক্ত হয়েছেন, তারও লাশ এসেছে শহীদ মইনুল রোডের ওই ছয় নম্বর বাড়িতেই। সংসদ এলাকার সাবজেলে থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মৃত মায়ের মুখ শেষবারের মতো দেখার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে চেনা ঠিকানায়।

প্রথমবার স্বামীর কফিন জড়িয়ে ধরে কান্না আর এবার মায়ের মুখ দেখে কান্না। সেই বাড়ি থেকেই ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের নির্দেশে র্যাব-পুলিশ এবং সাদা পোশাকের গোয়েন্দা দল কত শত স্মৃতিতে পূর্ণ সেই গৃহ থেকে বড় করুণভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করে। প্রশ্নাতীত সততা ও দেশপ্রেমই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে দিয়েছিল অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা। তার শাহাদাতের পর জানাজায় ভেঙে পড়েছিল সর্বস্তরের লাখ লাখ মানুষ। অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনকারী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর তার নিঃস্ব পরিবারের মাথা গেঁজারা ঠাঁই করে দেয়া হয় মইনুল রোডের বাড়িটি।

জিয়ার প্রতি গণমানুষের ভালোবাসা ও আবেগ-অনুভূতিতে শ্রদ্ধাবনত হয়ে সে সময়কার সরকারকে এ পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। জানা গেছে, স্বাধীনতার পর কুমিল্লায় পোস্টিং হয় জিয়াউর রহমানের। সেখান থেকে ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর ৬ নম্বর শহীদ মইনুল হোসেন সড়কের এ বাড়িতে সপরিবারে ওঠেন জিয়াউর রহমান। সেনাপ্রধান হওয়ার পরও এ বাড়িতেই ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। এ বাড়ি ছেড়ে সেনাপ্রধানের বাড়িতে ওঠেননি তিনি।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্যর্থ সামরিক অভ্যুথানে এ বাড়িতেই বন্দি করা হয় জেনারেল জিয়াকে। ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে ওই বাড়ি থেকেই বন্দিত্বমুক্ত হন জিয়াউর রহমান। এরপর রাষ্ট্রপতি থাকাকালে আমৃত্যু এ বাড়িতেই বসবাস করেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও উন্নয়ন-উত্পাদনের রাজনীতির প্রবর্তক জিয়াউর রহমান। তিনি রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন বঙ্গভবনে কখনও ওঠেননি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে কতিপয় বিপথগামী সেনাকর্মকর্তার হাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে শাহাদাতবরণের পর লাশ হয়ে শেষবারের মতো তিনি ফিরে আসেন এ বাড়িতেই।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নন্দিত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শাহাদাতবরণের পর তার স্মৃতিবিজড়িত মইনুল রোডের বাড়িটি ২ দশমিক ৭২ একর জমিসহ ১ টাকা প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বার্ষিক ১ টাকা হারে খাজনা প্রদানের শর্তে তার পরিবারকে বরাদ্দ দেয়া হয়। তত্কালীন সংসদের অধিবেশনে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হওয়ার পর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বাড়িটি বরাদ্দ করে। শহীদ জিয়ার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে এ বাড়িতে বসবাস করছিলেন তার পরিবার। যে কারণে জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েও প্রধানমন্ত্রী ভবনে না উঠে স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত এ বাড়িতেই বসবাস করছেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় এ বাড়িতেই বেগম জিয়াকে ৭ বার অন্তরীণ রাখা হয়।

বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবেও বেগম জিয়া এ বাড়িতেই বসবাস করছিলেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তথাকথিত ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে এ বাড়ি থেকে বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের আগে এ বাড়িতে তাকে দীর্ঘদিন গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। শহীদ জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকেও এ বাড়ি থেকেই গ্রেফতার করা হয় জরুরি সরকারের আমলে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পরও বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া মইনুল রোডের বাড়িটিতে অবস্থান করছিলেন।

কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তিনদফায় তাকে নোটিশ দিয়ে উচ্ছেদের চেষ্টা চালায়। সর্বশেষ খালেদা জিয়া সরকারি উদ্যোগ ঠেকাতে আইনের আশ্রয় নিলে আদালত তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের নোটিশের কার্যকারিতা সাময়িকভাবে স্থগিত করেন। সে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে রিট খারিজ করে দিলে স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে সরকার অত্যন্ত করুণভাবে উচ্ছেদ করে বেগম খালেদা জিয়াকে। Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.