আমরা শুধু আপন মানুষ খুঁজি, আপন মানুষদের খুঁজতে হয় না, তারা পাশেই থাকে !! আজ বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের ১১৩ তম জন্মদিন।
বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত তথা সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণপুরুষ কবি নজরুল। প্রেমের কবি, সাম্যের কবি ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুলের লেখনী ধুমকেতুর মত আঘাত হেনে আমাদের জাগিয়ে তুলেছিল। তাঁর জীবনের জানা ও অজানা কিছু তথ্য দিয়ে এই রচনা লিখছি।
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯ - ১৯৭৬)
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ২৪শে মে ১৮৯৯ সালে কাজী নজরুলের জন্ম গ্রহণ করেন।
পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ ও মাতার নাম জাহেদা খাতুন। নজরুলের ছেলেবেলার ডাকনাম ছিল দুখু। নজরুলের যখন নয় বছর বয়স তখন তাঁর পিতা মারা যান। আর্থিক কারণেই সে লেখাপড়ার সুযোগ না পেয়ে বাড়ির পাশেই অবস্থিত এক মাজারে খাদেম ও মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেছেন কিছুদিন। ছোটবেলা থেকেই নজরুলের মন ছিল গানবাজনার দিকে।
তাই সে লেটোরদল নামে পরিচিত এক যাত্রা দলে মাত্র ১২ বছর বয়সে হাসির নাটক ও গান রচনা করে খুব সুনাম অর্জন করেন। এভাবেই শুরু হয়েছিল কাজী নজরুলের সাহিত্যজীবন। লেটোর দলে শিশু নজরুলের কৌতুক-রচনা,
রবনা কৈলাসপুর, আই এম ক্যালকাটা গোইং
যত সব ইংলিস ফেসেন, আহা মরি কি লাইটনিং।
ইংলিস ফেসেন সবি তার, মরি কি সুন্দর বাহার।
দেখলে বন্ধু দেয় চেয়ার, কাম অন ডিয়ার গুড মনিং।
ছোটবেলা থেকে নজরুল ভরঘুরে ছিল এজন্য কোন স্কুলেই দীর্ঘসময় নিয়ে লেখাপড়া করেনি। চার-পাঁচটা স্কুলের নাম আমরা জানতে পারি। দশমশ্রেণীতেই কবির স্কুলজীবন শেষ হয়। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল, বৃটিশ সরকার বাঙ্গালীদের নিয়ে ব্যাংগল রেজিমেন্ট নামে একটা সেনাদল গঠণ করলে ১৯১৭ সালে কাজী নজরুল সেখানে যোগ দেন। সেখানে থাকা অবস্থায় রাশিয়ার বিপ্লব ও লেনিনের লালফৌজের সমর্থনে অনেক কবিতা লিখেছিলেন কিন্তু বিধিনিষেধ থাকায় খবরের কাগজে ছাপানো সম্ভব হয়নি।
কবি নজরুল দুই বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন।
১৯২০ সালে কলিকাতা থেকে নবযুগ নামে একটি বামপন্থি পত্রিকা বেড় হলে কবি নজরুল সেখানে সহকারী সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকার অফিসেই থাকার জায়গা হয়েছিল। ১৯২১ সালে মোজাফফর আহমদের সাথে কমউনিস্ট পার্টি গঠনের কাজে সাহায্য করেছেন। হিন্দুদেবতার নামে গান কবিতা লিখতেন এইজন্য নজরুলকে ইসলামের শত্রু বা কাফেরকবি বলে অনেকে ডাকতো।
কাজী নজরুল লিখেছেন -
মৌ-লোভী যত মৌলবী আর মোল্লারা কন হাত নেড়ে,
দেব দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।
ফতোয়া দিলাম কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও।
বাংলা সাহিত্যে আরবি ও পার্শীশব্দের ব্যবহার তিনিই প্রথম করেছিলেন এজন্য অনেক হিন্দুলেখক নজরুলকে পছন্দ করতেন না।
১৯২১ সালের জুন মাসে নার্গিস খাতুনের সাথে বিবাহ ঠিক হয় কিন্তু কাবিন নামায় ঘরজামাইয়ের কথা থাকায় নজরুল রাগ ও অপমানে বিয়ের আসর থেকে রাতেই কুমিল্লায় চলে আসেন। এই শহরে ইনদ্র কুমার সেনগুপ্তের পরিবারের সাথে নজরুলের খুব ভাল সম্পর্ক ছিল।
সেই পরিবারে বিরজাদেবীকে তিনি মা ডাকতেন। সেই পরিবারের মেয়ে আশালতা বা প্রমীলাকে(২৫শে এপ্রিল ১৯২৪)কাজী নজরুল বিয়ে করেন।
কাজী নজরুলের চার ছেলে ছিল প্রথম ছেলে কৃষ্ণ মুহম্মদ খুব ছোট বয়সেই মারা যায়। দ্বিতীয় ছেলে অরিন্দম বুলবুল মাত্র চার বছর বয়সে বসন্ত রোগে মারা যায়। এরপর আরও দুই ছেলে যাদের নাম কাজী সব্যসাচী (১৯২৯-৭৯)ও কাজী অনুরুদ্ধ (১৯৩২-৭৪) খুব অল্প বয়সেই মারা যায়।
কবির স্ত্রী প্রমীলা ৫৪ বছর বয়সে (১৯৬২) মারা যান। পশ্চীমবাংলার বর্ধমান জেলায় কবির নিজের গ্রাম চুরুলিয়ায় প্রমীলার সমাধি আছে।
কাজী নজরুলের সাহিত্যজীবন খুব লম্বা ছিল না, তিনি বাংলাসাহিত্যের আকাশে ঝড়ের বেগে এসেছিলেন প্রেম আর বিদ্রোহের গান গেয়ে। প্রায় তিন হাজার গান ও কবিতা রচনা করেছেন। কয়েকটা বইয়ের নাম এখানে উল্লেখ করলাম ব্যথার দান, অগ্নিবীণা, বিষের বাশীঁ, ভাঙ্গার গান, ছায়ানট, ফণি মনসা, সঞ্চিতা।
১৯২২ সালে ধুমকেতু নামে একটা পত্রিকায় ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে কাজী নজরুল লিখেছিলেন। এই অপরাধে ১৩ মাস জেলে থাকতে হয়েছিল। জেলে থাকা অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ বসন্ত নামে একটা নাটক নজরুলের নামে নিবেদন করেন।
যেদিন রবীন্দ্রনাথ মারা যান সেদিন নজরুল লিখলেন - বিশ্বের কবি,ভারতের রবি,শ্যামলবাংলার হৃদয়ের ছবি,তুমি চলে গেলে, তোমাকে নিয়ে কত গর্ব করেছি, ভগবান তোমাকে পাঠিয়েছিল আবার ফিরিয়ে নিল কেন? বিদায়ের সময় তোমার পায়ে আমার চুম্বন নিয়ে যাও। কথা দাও যেখানেই থাক এই হতভাগ্য বাঙ্গালী জাতিকে মনে রাখিও।
নজরুল রবীন্দ্রনাথকে কতটাশ্রদ্ধা করতেন তার প্রমাণ পাই।
কাজী নজরুলের সংসারজীবন খুব আর্থিক কষ্টে কাটে। তারঁ জীবনের শেষ ভাষণে আমি আনন্দের গান গেয়ে যাব। আমি প্রেম ভালবাসা দিতেই পৃথিবীতে এসেছিলাম, কোন নেতা ও কবি হতে আসি নাই।
১৯৪২ সালের ৯ই জুলাই সন্ধ্যায় কলিকাতা বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান চলার সময় কাজী নজরুলের স্ট্রোক (মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ)হয়, কথা বলার শক্তি হারান।
বিদেশে ডাক্তার দেখানো হলেও তেমন উন্নতি হয়নি। এইভাবে তিনি প্রায় ৩৪ বছর বেচেঁ ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম জীবনের শেষ চার বছর ঢাকায় কাটান। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট ঢাকায় তিনি মারা যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের কাছে কবির সমাধি আছে।
তিনি আমাদের জাতীয় কবি। তারঁ ভাষায় -
মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত
যবে উতপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না
মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত।
সূত্রঃ কাজী নজরুল ইসলাম-জীবন ও কবিতা লেখক রফিকুল ইসলাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।