কোন একটি ছোটগল্পের জেন্ডার সংবেদনশীলতার ঝোঁক যাচাই এবং পুণঃনির্মানের উদ্দেশ্যে আমি ‘অপূর্ব ক্ষমা’ গল্পটি নির্বাচন করেছি। ‘অপূর্ব ক্ষমা’ গল্পাংশটি মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘বিষাদসিন্ধু’ গ্রন্থের মহরম পর্বের ষোড়শ প্রবাহ থেকে সংকলন করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্য গল্পটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে।
আমার অবস্থান ব্যক্ত করার নিমিত্তে স্পষ্ট বলে রাখছি, কারও ধর্মানূভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য আমি গল্পটি নির্বাচন করি নি। বরং গল্পটি নির্বাচনের পক্ষে আমার যুক্তি হল, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্কক বোর্ডের নবম-দশম শ্রেণীর পাঠ্য হিসাবে গল্পাংশটি আমরা অনেকেই পড়েছি, এখনো শিক্ষার্থীরা পড়ছে।
ফলে গল্পটি কারও অজানা নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, গল্পের কথাশৈলী, ভাষার সাবলীলতা ও ঘটনার গতিময়তা সাহিত্যিক মানদন্ডে অসাধারন। আমি বিশ্বাস করি, মীর মশাররফ হোসেন এর মত জনপ্রিয় একজন সাহিত্যিকের গল্পে লৈঙ্গিক ত্র“টি ও লৈঙ্গিক সংবেদনশীলতা চিহ্নিত করে তা পুণঃনির্মান করা, আমার মত ক্ষুদে শিক্ষার্থীর জন্য দৃষ্টতাই বটে। কিন্তু তারপরেও আমার অর্জিত জ্ঞান, একান্ত— ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আমি শুধুমাত্র একাডেমিক কায্রক্রমের অংশ হিসাবে বিষয়টিতে হাত দিয়েছি। আশা করি, আমার এহেন দৃষ্টতা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
গল্পের মূলবক্তব্য
পুরো গল্পটির মূলবক্তব্য সং¶িপ্তাকারে সাজানোর চেষ্টা করলে আমরা দেখতে পাই, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অন্যতম দৌহিত্র ইমাম হাসান ষড়যন্ত্রে পড়ে বিষ প্রয়োগে নিহত হওযার সময় বিষপ্রদানকারী জাএদাকে (ইমাম হাসানের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী) ক্ষমা করে অর্পূব মহত্তে¡র যে পরিচয় দিলেন তা বর্ণিত হয়েছে এ গল্পে। ইমাম হাসান মৃত্যু শয্যায় নিজের মৃত্যুর কারন অবহিত হয়েও যে সংযম ও উদরতার পরিচয় দিয়েছেন তার তুলনা নেই। জাএদা ( ইমাম হাসানের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী) শত্র“ কর্তৃক প্ররোচিত হয়ে ¯স্মামীকে বিষ প্রয়োগ করে অমার্জনীয় অপরাধ করেন। ইমাম হাসান (রা) তা জানতে পারেন। তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ না করে জাএদাকে ক্ষমা করেন এবং অন্যদের কাছে নাম প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন।
এমনকি ছোট ভাই ইমাম হোসেনকে (রা) অনুরোধ করেন, বিষ প্রয়োগকারীকে শনাক্ত করতে পারলেও যাতে ক্ষমা করেন। জীবনের শেষ মুহুর্তে ক্ষমার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত— স্থাপন করে ইমাম হাসান মারা যান। মদিনায় খিলাফত নিয়ে হযরত আলী (রা) ও মুয়াবিয়ার মধ্যে যে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছিল তার পরিণতি হিসাবে পরবর্তীকালে ইমাম হাসান বিষ প্রয়োগে মারা যান এবং ইমাম হোসেন কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে এজিদ সৈন্যদের দ্বারা নিহত হন।
আমার সমালোচনাত্নক দৃষ্টিভঙ্গি
পুরো গল্পটিতে জেন্ডার সংবেদনশীলতার ঝোঁক যাচাই করতে গিয়ে শব্দগত বা জেন্ডার সংবেদনশীল শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করলে, এরকম শব্দ খুব বেশি পাওয়া যায় না। এদিক থেকে লেখক অনেক বেশি সর্তক ছিলেন।
কিন্তু, আমার দৃষ্টি অন্যদিকে। শব্দগত বা ভাষাগত ত্র“টি চিহ্নিত করা না গেলেও গল্পটিকে ভাবগত দিকে থেকে পুণ:ভাবনার প্রয়োজন আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। বিষয়টাকে আরো একটু পরিস্কার করা যেতে পারে। পুরো গল্পজুড়ে ইমাম হাসান ও জাএদার চরিত্র বিশেষণ করলে পাঠকের কাছে যে সব চারিত্রিক গুণাবলী ফুটে ওঠে-
ইমাম হাসান চরিত্র-
ভ্রাতৃপ্রেম ,পরলোকে বিশ্বাসী , বিচ¶ণ ব্যক্তিত্য , আলাহর বিচারে অস্থাশীল , স্ত্রীর মর্যাদায় বিশ্বাসী ,ক্ষমাশীল , পুত্রবৎসল , সুবিবেচক ও মহানুভব
জাএদা চরিত্র-
লোভী, পাপী, ছলনাময়ী, প্রতারক, ¯^ামীর মর্যাদায় বিশ্বাসী নন, অকৃতজ্ঞ, পুত্রবৎসল নন, অবিবেচক ও পাপাত্না
গল্পের শেষ অংশে লেখক লিখলেন, “... ... ... শেষকথা বলিয়াই ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে দয়াময় ইমাম হাসান সর্বসমক্ষে প্রানত্যাগ করিলেন। হাসনেবানু, জয়নাব, কাসেম ও আর সকলে হাসানের পদলুন্ঠিত হইয়া মাথা ভাঙিয়া কাঁিদতে লাগিলেন, জাএদা কাঁদিয়াছিল কিনা, তাহা কেহ লক্ষ্য করে নাই।
”আমার অভিযোগের জায়গাটা ঠিক এই বাক্যগুলোর মধ্যে।
লেখক খুব সর্তকতার সাথে জাএদা’র মর্মব্যাথাকে পাঠকের কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। প্রিয়তম স্বামীর মৃত্যুতে জাএদা ঁেকদেছিল কি কাঁদে নি- লেখক একবারও লিখলেন না, কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন ( নারীর কান্না জেন্ডার গবেষণার উপাদেয় উপাদান !!!!!!)
আমি মনে করি, বিষদানকারীর ও আত্ন-মর্মপীড়া আছে। বিষদানকারী লোভী, পাপী, প্রতারক, অকৃতজ্ঞ যা-ই হোন না কেন, নিজের স্বামীকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করার পর তাঁর ভিতরও একটা গ্লানী ও অনুশোচনাবোধ কাজ করবে। এটাই স্বাভাবিক।
যদি লেকক এই দিকটি নিয়ে সামান্যতমও আলোকপাত করতেন, তবে হয়ত গল্পের জাএদা চরিত্রটি প্রচলিত আর দশটি ‘নারী’ চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে ‘মানুষ’ হিসাবে গল্পে স্থান লাভ করত। [ প্রচলিত নারী চরিত্র = নারীর লোভী, পাপী, প্রতারক, ছলনাময়ী ইত্যাদি সাহিত্যিক রূপ- যা বিভিন্ন সাহিত্যে যুগ যুগ ধরে বর্ণিত হয়ে আসছে]
পূর্বেই উলেখ করেছি, ‘অপূর্ব ক্ষমা’ গল্পটির একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। ইসলামের ইতিহাসে ঘটনাটি সমুজ্জল। লেখক মীর মোশাররফ গল্পটিকে বাংলা ভাষায় প্রাণবš— করে পাঠকের কাছে তোলে ধরেছেন মাত্র। এ কারণে অনেক ইসলামী ইতিহাসবিদগণ লেখকের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘বিষাদ সিন্ধু’র শুদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
সে যাই হোক। আমার দৃষ্টিভঙ্গি গল্পের সাথে ইতিহাসের শুদ্ধতা নির্ণয় নয়, বরং গল্পের চরিত্র নির্মাণে লেখকের লৈঙ্গিক উপস্থাপন পরীক্ষা করা। আমি তা- ই করতে চেষ্টা করছি।
ইতিহাসের প্রসঙ্গটা আনলাম এই কারণে যে, জাএদা কেন স্বামীকে বিষদান করল, সমস্ত গল্প জুড়ে কেন সে লোভী, পাপী, প্রতারক ও ছলনাময়ী চরিত্রটি লাভ করল সেই প্রশ্নটির উত্তর মিলবে ইতিহাসের গভীরতায়। বিষয়টা আরো পরিস্কার করা যেতে পারে।
দু;খজনক হলেও সত্যি যে, লেখক মীর মোশাররফ হোসেন এই প্রশ্নগুলোর উত্তরও আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। এবার তিঁনি কৌশলে (বক্তব্য ঘুরিয়ে) ঘটনা আড়াল করেননি, বরং পাঠককে তথ্য না দিয়ে ঘটনাটির একাংশ আড়াল করেছেন।
খিলাফত নিয়ে মুয়াবিয়ার পুত্র এজিদ ও ইমাম হাসানের ব্যক্তিগত ক্রোশ থেকেই মূলত বিষদানের ঘটনাটির উৎপত্তি। এক্ষেত্রে জাএদাকে বিষদানে প্ররোচিত করা হয়েছেমাত্র। গল্পের কোথাও এই কারণটি উল্লেখ নেই।
‘নারী মাত্রই ছলনাময়ী এবং নারী হাসতে হাসতে প্রিয়জনের বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে পারে’ - এমন প্রাগতিহাসিক প্রচলিত ধারনা থেকেই হয়ত শত্রুপক্ষ জাএদা'কে কে ব্যবহার করেছে বিষপ্রদানে। এই বিষদানের মাধ্যমে একটা বিষয় প্রচ্ছন্নভাবে বোঝা যায়। জাএদার নিজস্ব কোন স্বাধীন সত্ত্বা, বিচারিক ক্ষমতা ও বিবেক বলে কিছু নেই। সে অন্যের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে প্রিয়তম স্বামীকে ও বধ করতে পারে।
এখানে ‘জাএদা’ একটা আক্ষরিক নাম মাত্র, মূলত সে হাজার বছরের নারী চরিত্রগুলোর প্রতিফলন।
কারণ, সাহিত্যে কিংবা ইতিহাসে জাএদার মত শত শত নারীকে এভাবেই তোলে ধরছেন লেখকগণ। কখনো গল্পের প্রয়োজনে, কখনো পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য, কখনো ঘটনার সত্যতা নির্মাণের উদ্দেশ্যে। ফলে জাএদা অন্যের কথায় প্ররোচিত হবে, ¯^ামীকে বিষ দিয়ে বধ করবে, যে ¯^ামী তাকে সবচেয়ে ভালবাসত তাঁর জন্য দুফোটা চোখের জলও ফেলবে না- পাঠকের কাছে এটাই স্বাভাবিক মনে হতে পারে।
এত বক্তব্যের পরও যে প্রশ্নটির উত্তর মিলল না - জাএদা কেন স্বামীকে বিষ প্রদান করেছে? কেন সে প্ররোচিত হল? নারীর নিজ কোন স্বাধীন সত্ত্বা, বিচারিক ক্ষমতা ও বিবেক বলে কিছু নেই বলেই কি জাএদা তার প্রিয়তম স্বামীকে বিষ দিয়েছে? লেখকের বক্তব্যে প্রশ্নটির কোন উত্তর নেই। গল্পের কোথাও এই প্রশ্নে জবাব মিলবে না।
কারণ, লেখক স্বজ্ঞানে বিষয়টি আড়াল করেছেন। আর তাই ইতিহাসের দিকে আমার নজরদারি।
শুধুমাত্র এজিদের দেয়া অর্থ বিত্তের লোভ তাকে বিষদানে প্ররোচিত করে নি। আরো একটি কারণ ছিল । ইমাম হাসান জয়নব নামক তৃতীয় স্ত্রীকে বিবাহ করার পর জাএদা ঈর্ষান্তবীত হয়ে ওঠেন এবং মনে মনে ক্রুদ্ধ হন।
আমি মনে করি, জাএদার এই ক্রোধের উৎপত্তি তার অকৃত্রিম ভালবাসা। ভালবাসার মানুষটিকে হারানোর ভয়, নিজের ভালবাসাকে অন্যের সাথে ভাগাভাগি করার অভিমান ও ক্ষোভ মূলত তাকে পাগল করে তোলেছিল। এটাই স্মাবাভাবিক মানবীয় প্রবৃত্তি। আর এ পরিস্থির সুযোগ নিয়েছিল এজিদ।
গল্পের নাম ‘অপূর্ব ক্ষমা’ ।
কিন্তু গল্পের অধিকাংশজুড়েই শুধু দুই ভাইয়ের কথোপকথন। এভাবেই ঘটনা প্রবাহ এগিেেয়ছে। লেখক জাএদা-হাসান চরিত্রদ্বয় অপেক্ষা হাসান-হোসেন চারত্রদ্বয়কে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন বলে মনে হয়েছে। সামান্য একটা অংশে জাএদার সাথে ইমাম হাসানের কথোপকথন এসেছে, এ নিয়ে আমি এতটা চিন্তিত নই। কিন্তু আমার অভিযোগ অন্য জায়গায়।
ধরে নিলাম, প্রিয়তম স্কবামীকে ভাগাভাগি করার লজ্জা ও ক্রোধ থেকে কিংবা এজিদের অর্থ-প্রচুর্য্যরে লোভে সে ইমাম হাসানকে বিষ দিল। কিন্তু, তাই বলে কি তার পুত্রবৎসল মনটি ও কঠিন হয়ে যাবে? লেখক এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিত্রিত করেছেন জাএদাকে। যে কারণে ইমাম হাসান মৃত্যুশয্যায় পুত্র আবুল কাসেমকে ছোট ভাই ইমাম হোসেনের কাছে সমার্পন করেছেন। জাএদার কাছে সমার্পন করেন নি, বা তার মতামত গ্রহণের প্রয়োজন মনে করেন নি এ গল্পে।
আগেই বলেছি, এখানে জাএদা একটা আক্ষরিক নাম মাত্র, মূলত সে হাজার বছরের নারী চরিত্রগুলোর প্রতিফলন।
কারণ, সাহিত্যে কিংবা ইতিহাসে জাএদার মত শত শত নারীকে এভাবেই তোলে ধরছেন লেখকগণ। কখনো গল্পের প্রয়োজনে, কখনো পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য, কখনো ঘটনার সত্যতা নির্মাণের উদ্দেশ্যে।
তাই পুরো গল্পটির সমালোচনাকে মোটাদাগে সাজালে আমরা দেখতে পাই
-- জাএদা লোভী ও প্রতারক। আল্লাহর বিচারে তার আস্থা নেই।
- জাএদার স্বাবাধীন সত্ত্বা বা বিচারিক ক্ষমতা বলে কিছু নেই।
- জাএদা এতটাই সার্থপর ও ছলনাময়ী যে, স্নেহশীল বন্ধু ও স্বামীকে বিষ প্রয়োগে হত্যার পরও তার ভিতর কোন অনুশোচনাবোধ ও গ্লানী নেই।
- জাএদা ‘ভালো স্ত্রী’ বা ‘ভালো মা’- কোনটিই হতে পারল না।
- ক্ষমার মহৎ দৃষ্টান্তও তার ভিতরে অনুশোচনাবোধ সৃষ্টি করে নি। এই কারণে ¯^ামীর মৃত্যুতে ও সে দুফোটা চোখের জলও ফেলল না।
উপরোলিখিত প্রতিটি বিষয়কে লৈঙ্গিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুণ:ভাবনার প্রয়োজন আছে বলে আমি বিশ্বাস করি।
তাই গল্পটির পুণ:নির্মানে আমি মূলঘটনা প্রবাহকে অপরিবর্তিত রেখে উপরোলিখিত বিষয়গুলোকে পুণ:রায় সাজানোর চেষ্টা করেছি। বলাই বাহুল্য, গল্পের পুণ:নির্মাণে জাএদা সামান্যতম ‘নারী’ চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে অনেকখানি ‘মানুষ’ চরিত্র ধারন করতে পেরেছে বলে আমি বিশ্বাস করি।
গল্পের পুণ:নির্মিত অংশ পরবর্তী লেখায়... আসছে.../ চলবে.... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।