আমি সত্য জানতে চাই
এ দেশের মাটি ও মানুষের মূল ধারার সাহিত্যিক, বিরল প্রতিভার অধিকারী পাবনার কৃতী সন্তান কবি বন্দে আলী মিয়া। কবি বন্দে আলী মিয়া ছিলেন একাধারে গীতিকার, উপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ও অসংখ্য শিশুতোষ সাহিত্যের এক অনন্য প্রতিভাধর। সেই সাথে কবি ছিলেন জীবনীকার ও স্মৃতিকথার কুশলী লেখক। চিত্রশিল্পেও তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কবি বন্দে আলী মিয়া সমস্ত জীবন বাংলা সাহিত্যের ভূবনে আচ্ছাদিত ছিলেন।
তাঁর অসাধারণ লেখনীর মাঝে তুলে ধরেছেন সমাজের কথা সেই সাথে দেশের কথা। তিনি আর্থিক দৈনদশায় নিমজ্জিত ছিলেন এমন সময় তাঁর গেছে। তার পরেও তিনি বাংলার প্রকৃতি, মাটি ও মানুষকে আপন করে এই সমাজেই প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে চালিয়ে গেছেন। কবি বন্দে আলী মিয়া রচিত শিশুতোষ সাহিত্য ছড়া ও গান এদেশের মানুষের মাঝে এখনও সচলতার পরিচয় বহন করে। বিরল প্রতিভার অধিকারী কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন মৃত্যুবরণ করেন।
সব্যসাচী কবির মৃত্যুদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারী পাবনা জেলার রাধানগর গ্রামে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম উমেদ আলী মিয়া ও মাতা নেকজান নেছা। পিতা-মাতার একমাত্র আদরের সন্তান ছিলেন তিনি। তাঁর শৈশব এবং কৈশোর কেঁটেছে এই পাবনাতেই।
অতি অল্প বয়সে পিতা তাকে বাড়ির নিকটবর্তী মজুমদার একাডেমীতে ভর্তি করে দেন। লেখাপড়ার দিকে যত খেয়াল, তার চেয়ে বেশি ঝোঁক ছবি আঁকার দিকে। পরবর্তীতে ছবি আঁকার কাজে যতটা না তিনি পরিচিত হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেছেন কবি হিসেবে। বেশি সুনামের অধিকারী হয়েছেন শিশুসাহিত্য রচনা করে। কবি বন্দে আলী মিয়া পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমী হতে ১৯২৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
কবি বন্দে আলী মিয়া পাবনার মজুমদার একাডেমী থেকে ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কলকাতা আর্ট একাডেমীতে ভর্তি হন এবং ১৯২৭ সালে তিনি ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমী থেকে চিত্রকলায় ১ম বিভাগে ডিগ্রী অর্জন করেন।
১৯২৫-এ ইসলাম দর্শন পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে কর্ম জীবন শুরু করেন কবি বন্দে আলী মিয়া। এর পর ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি কলকাতা জীবনে রবীন্দ্র-নজরুলের সান্নিধ্য লাভ করেন। তখন তাঁর প্রায় ২০০ খানা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
সে সময় বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানীতে তাঁর রচিত পালাগান ও নাটিকা রের্কড আকারে কলকাতার বাজারে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৬৪-র পর প্রথমে ঢাকা বেতারে ও পরে রাজশাহী বেতারে চাকরি করেন। কবির জীবনকালে নানা সমস্যার-জটিলতার সন্মুখীন হয়েছেন। সুখ যেমন তাঁর সাথী ছিল তেমনি দুঃখও ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুখে ছিল শান্তি আর দুঃখে ছিল নির্মমতা ও অস্থিরতা।
জীবন যুদ্ধে তিনি বার বার পরাভূত হয়েও জয়ী হয়েছেন। জানা যায় যে আর্থিক টানা পড়েনে কবি মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে প্রকাশকের কাছে বই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। তার অনেক রচনাবলী এখনো বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাঁর রচিত এমন অনেক গুলো বই রয়েছে যে তার একটি কপিও তার কাছে ছিল না। কবি বন্দে আলী মিয়া দুঃখকে আকড়ে ধরে ধৈর্যের সাথে প্রবহমান সময় অতিবাহিত করলেও কখনো সাহিত্য চর্চায় পিছুটান হননি।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী কবি বন্দে আলী মিয়া ব্যক্তিজীবনে ছিলেন প্রকৃতির মতই সহজ সরল। সাহিত্যের সব শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন। সাহিত্য ভুবনে কবি বন্দে আলী মিয়া ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, সব্যসাচী লেখক। প্রকৃতির রূপ বর্ণনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কবি বন্দে আলী মিয়া তাঁর কবিতায় পল্লী প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনায় নৈপুন্যের পরিচয় প্রদান করেছেন।
জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অসংখ্য গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৯ খানা কাব্য ১০ খানা উপন্যাস, ৩ খানা ছোট গল্প, ১১ খানা নাটক এবং সঙ্গীত ভিত্তিক ২ খানা রচনা রয়েছে। এ ছাড়া তার “জীবনের দিনগুলি’’ একটি বিশেষ রচনা। কবি বন্দেআলী মিয়ার সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য কাব্য গ্রন্থ 'ময়নামতির চর'।
ময়নামতির চর কাব্য গ্রন্থে খুব সহজেই বাংলার শাশ্বত সৌন্দর্যকে ভাষার ব্যঞ্জনায় চিত্রায়িত করেছিলেন। যা কবিকে বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিল। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহঃ ১। ময়নামতির চর, ২। অরণ্য, ৩।
গোধূলী, ৪। ঝড়ের সংকেত, ৫। নীড়ভ্রষ্ট, ৬। জীবনের দিনগুলো ৭। অনুরাগ ইত্যাদি।
শিশুতোষ রচনায়ও কবি বন্দে আলী মিয়া কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। বাংলা শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে কবি বন্দে আলী মিয়ারই বইয়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শ্রম, নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, সাধনা ও অনলস চর্চার জন্য তিনি আমাদের শিশুসাহিত্যে এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। কঠিন ও গম্ভীর জিনিসকে সহজ ও সরলভাবে প্রকাশ ও পরিবেশনের জন্যও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কবি বন্দে আলী মিয়ার শিশুসাত্যে সবচেয়ে বড় অবদান হলো ছোটদের উপযোগী জীবনীগ্রন্থ।
মহত্ লোকদের জীবনী যে মানুসের চরিত্র ও মনুষ্যত্ব অর্জনে বড় অবলম্বন তা হয়তো বন্দে আলী মিয়া বিশেষভাবে অনুধাবন করেছিলেন। তাই তিনি ইতিহাস থেকে বিখ্যাত মনীষী, মহামানব, কবি-সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ প্রভৃতির জীবনতথ্য অবলম্বনে প্রচুর শিশুতোষ জীবনী লিখেছেন।
কবি বন্দে আলী মিয়া ইতিহাসের বিষয়, উপাদান ও ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি রচনা করেছেন অনেকগুলো গ্রন্থ। তার মধ্যে 'কোহিনূর', 'ছোটদের বিষাদ সিন্ধু', 'ছোটদের মীর কাসিম', 'তাহমহল', 'কারবালার কাহিনী' প্রভৃতি গ্রন্থে শিক্ষণীয় দিক তুলে ধরা হয়েছে। তিনি কোরান, হাদিস ও গুলিস্তাঁর গল্প লিখেছেন।
আরো লিখেছেন 'ইরান-তুরানের গল্প', 'ঈশপের গল্প', 'দেশ বিদেশের গল্প', 'শাহনামার গল্প'। তিনি লোককাহিনী, রোমাঞ্চকর ও রূপকথার কাহিনী অবলম্বনে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তেমনি বাস্তব সংসার সমস্যা নিয়েও শিশু উপযোগী বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত শিশুতোষ গ্রন্থ আজও অমর হয়ে আছে।
তার রচিত শিশুতোষ গ্রন্থঃ ১।
চোর জামাই (১৯২৭), ২। মেঘকুমারী(১৯৩২), ৩। মৃগপরী(১৯৩৭), ৪। বোকা জামাই(১৯৩৭), ৫। কামাল আতার্তুক (১৯৪০), ৬।
ডাইনী বউ(১৯৫৯), ৭। রূপকথা(১৯৬০), ৮। কুঁচবরণ কন্যা(১৯৬০), ৯। ছোটদের নজরুল(১৯৬০), ১০। শিয়াল পন্ডিতের পাঠশালা(১৯৬৩), ১১।
বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা উল্লেখযোগ্য।
বন্দে আলী মিয়ার অবদানের স্বীকৃতি ও সম্মান জানানোর জন্য ১৯৬২ সালে শিশুসাহিত্যে তাকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৬৫ সালে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন সাহিত্য- সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে পুরস্কার ও সম্বর্ধনা জানানো হয়। ১৯৮৮ সালে কবিকে মরনোত্তর একুশে এবং ও ১৯৯০সালে স্বাধীনতা পদকে সম্মানিত করা হয়।
জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি রাজশাহীতে অবস্থান করছিলেন এবং রাজশাহী রেডিওর সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৭ সালে নাটোর টেলিভিশন উপকেন্দ্রের তিনি উদ্বোধন করেন।
বাংলা সাহিত্যের এই শক্তিমান কবি ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন সকাল ১১.২০ মিনিটের সময় রাজশাহীর কাজীহাটার বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরন করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
পাঠকদের জন্য আমার ভালো লাগা ও ছোট বেলার পাঠ্য বন্দে আলী মিয়ার কবিতা যেখানে তিনি স্বপ্নলোকের কথা, গাঁয়ের মেঠোপথে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন।
'আমাদের গ্রাম"
বন্দে আলী মিয়া
আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর৷
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,
এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই৷
আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ৷
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি৷
আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন,
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন৷
সকালে সোনার রবি পুব দিকে ওঠে,
পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে৷ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।