আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সব্যসাচী নায়লা বারীর নৃতাত্বিক স্বপ্ন

নারী দিবস এবং একজন নায়লা বারীর নৃতাত্বিক স্বপ্ন || সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: বাংলাদেশের সুরমা পাড়ের একটি শ্যামলা মেয়ে, যে সুরমার জলে সাঁতার কাটতো, সে একদিন স্বপ্নের ডালা মেলে উড়ে গেলো অন্য আকাশে। অন্য দেশে আমাদের সুরমা পাড়ের সেই রুশনারা নামের শ্যামলা মেয়েটি আজ রূপকথার গল্পকে হার মানিয়ে বৃটিশ প্রতিদ্বন্দীকে পরাজিত করে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে প্রমাণ করলো- আমারা সেরা, আমারা পারি। তাই আজ তিনি বৃটিশ পার্লামেন্টে একজন বাঙালি নারী প্রতিনিধির গর্বিত প্রতীক হিসেবে জ্বলজ্বল করছে। আসলে এ কথা সত্য, বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ শীর্ষে। প্রধান মন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রী, সংসদ নেত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, কৃষি মন্ত্রীর মতো রাষ্ট্রের প্রায় সব ক’টি গুরুত্ত্বপূর্ণ পদে নারীরাই অধীষ্টিত।

শুধু নারীর ক্ষমতায়নেই নয়, নারী উন্নয়নেও বাংলাদেশের উগ্রগতির কথা নবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমত্য সেনও দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন। কারণ, আজ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের নারীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি গর্ব করার মতো। ধরা যাক, বিদেশে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল আর দেশের ভেতরে রন্ধন শিল্পী সিদ্দিকা কবীরের কথাই। সিদ্দিকা কবীরের পড়াশোনা করেছেন দেশের বাইরে। আজ তিনি নেই।

কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে, সৃষ্টিতে তিনি আছেন। রান্না-বান্নার বিষয়টি রসুই ঘরের চার দেয়ালের বাইরে এনে শিল্পের মর্যাদা দিতে দেশে যে ক’জন মানুষের অনন্য অবদান রয়েছে, গুণী রন্ধনশিল্পী ও বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ সিদ্দিকা কবীর তাদের অন্যতম। টেলিভিশনে রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে তিনি নিজে যেমন জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনি আমাদের দেশে জনপ্রিয় করেছেন রন্ধন শিল্পকে। আমাদের রন্ধনকে তিনি যে ভাবে শিল্পের মাত্রা দিয়ে যে জায়গায় রেখে গেছেন, সেখান থেকেই নতুন মাত্রায় নতুন ভাবে যাত্রা করতে চান এক স্বপ্ন বিলাসী তরুণ। এ প্রসঙ্গে কবি সৈয়দ আলী আহসানের কথা মনেপড়লো।

তিনি এক বার বলেছিলেন, ‘…তরুণদের কাছে পরাজিত হতে গ্লানি নেই। কারণ এরাই প্রবাহমান ধারাকে অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে, সুন্দর ও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়’। (তবু কেউ কারো নই কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উনুষ্ঠানে ভাষণ। সেপ্টেম্বর ০৬, ১৯৮৫, জাতীয় দৈনিকসমূহ, ঢাকা)। একথা যেনো পুষ্টিবিদ নায়লা মমতাজ বারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

কারণ, নায়লা একক ভাবেই নিজের প্রাণপণ চেষ্টায় আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী হারানো খাদ্য এবং ভিন্ন আঙ্গিকে খাদ্য-বিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের সমন্নয়ে গবেষণা করছেন। শুধু বাঙালিদের খাবারি নয়, আমাদের আদিবাসীদের বিচিত্র খাবার নিয়েও নিরলস কাজ করছেন। মাঠ পর্যায় গিয়ে গবেষণা করছেন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে। খাদ্য-সংস্কৃতি, খাদ্যের ধর্মীয় বিশ্বাস, ভৌগলিক অবস্থান, সামাজিক মূল্যবোধ, বাজারজাতকরণ, অর্থনীতি ভাবনা নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন চাকমা কিংবা খাসিয়া অথবা মনিপুরীদের রান্নাঘরে। নিজের নোট খাতায় লিখে নিচ্ছেন- কোন খাবারে কি গুরুত্ত্ব, কোন খাবারে কি পুষ্টি, কোন খারাব তাদের প্রিয় বা আপ্যায়নের জন্য ঐতিহ্য বহন করছে এবং এখন তা অভাবের তাড়নায় বা আধুনিকতার আড়ালে বিলুপ্ত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

যা সংগ্রহ করা হচ্ছে না জাতীয় পর্যায়ে। ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের নায়লা সেই পুরোনো দিনের নানান বাহারী খাবারের নানা দিক নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাই তাঁর রঙিন স্বপ্ন- আবহমান বাংলার খাদ্য, খাদ্যভাস, খাদ্যের উৎপাদন, খাদ্যের পুষ্টি, খাদ্যের গুণাবলি, প্রভৃতি নিয়ে মগ্ন। সেই সাথে নৃ-গোষ্ঠীর বাসস্থান, বনভূমি এবং তাদের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়-আসয়। সব্যসাচী নায়লা বারী সুন্দর কবিতা লিখেন, চমৎকার ছবি আঁকেন, মিষ্টি গলায় গান করেন. চাকরি করেন, আবার করেন পড়াশোনা ও পাশাপাশি গবেষণা।

এক সময় বিটিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। তারুণ্যদীপ্ত নায়লা তার স্বপ্নের মাধ্যমে বাংলাদেশের হারানো-পুরনো ঐতিহ্যবাহী খাবারের সাথে সমন্বয় করে আধুনিক খাবারকেও বিশ্বের দরবারে নান্দনিক ভাবে তুলে ধরতে চান। তার এই স্বপ্ন কি বাস্তবায়ন হবে? নায়লা খুবই আশাবাদী। তিনিও বিবি রাসেলের ভাষায় বলেন- প্রতিদিনই নারী দিবস। তাই প্রতিদিনই আমরা আমাদের নিয়ে সচেতন।

গত মাসে নায়লা বারী তার গবেষণা কর্ম উপস্থাপনা করে তাক লাগিয়ে দিলেন বিদেশিদেরকে। ভারতের অরুণাচল প্রদেশে অবস্থানরত “অরূনাচল ইন্সটিঊট অফ ট্রাইবাল স্টাডিস”-এর ক্যম্পাসে রাজিব গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয় এক আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করেছিলো গত ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি। প্রায় দু’শটি গবেষণা কার্যক্রম নিয়ে তিন দিনের সেশন হয়েছিলো। দেশ বিদেশের বহু সমাজতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, অর্থনীতিবীদ এবং সুধী ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে উপস্থাপন করা হয়েছিলো পৃথিবীতে অবস্থানরত আদিবাসিদের জ্ঞানচর্চা ও তার গুরুত্ব ।

তাদের নিজেদের রাজনৈতিক জীবন ধারা এবং রাজনীতি সম্পর্কে ধারনা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছিলো। আবহাওয়া এবং পরিবেশের পরিবর্তনের ফলে নৃ-গোষ্ঠির জীবন-ধারার যে পরিবর্তন হচ্ছে তা পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিলো। সেখানে বাঘের দাঁত হারানোর মতো একটি গবেষণা প্রকাশ করা হয়েছে যেখানে আদিবাসীরাই মূলত দায়ী। এছাড়া নৃ-গোষ্ঠীদের বাসস্থান, বনভূমি এবং তাদের অধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের গবেষণা এবং তার প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন পুষ্টিবিদ নায়লা মমতাজ বারী এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর একেএম মাজহারুল ইসলাম।

নায়লা মমতাজ বারী সম্পুর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে খাদ্য-বিজ্ঞান এবং নৃবিজ্ঞানের সমন্নয়ে একটি গবেষণা উপস্থাপন করেন। যার মূল বক্তব্য ছিলো- খাদ্য হলো জীবের মৌলিক অধিকারের মধ্যে একটি। একটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সম্বলিত খাবার তার সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপুর্ণ অংশ। এই বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বাংলাদশে সিলেট অঞ্চলে বসবাসরত মনিপুরী এবং খাসিয়া গোষ্ঠীর জীবন-ধারা এবং তাদের খাদ্য আচরণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে শ্রোতাদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠে আসে যার মাঝে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো বাংলাদেশে কেন মনিপুরিদের নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে ঊল্লেখ করা হচ্ছে, কারণ ভারতের ইম্ফলে তাদেরকে মূল জন-গোষ্ঠীর একটি অংশ রূপে প্রকাশ করা হয়।

এর জবাব দিতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন তাদের জন-গোষ্ঠী কমে যাওয়ার হার। নায়লা মমতাজ বারী তাঁর গবেষণায় খাদ্যাভ্যাস এর ধরণ এবং প্রকারভেদ এর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বিভিন্ন কারন উল্লেখ করেছেন। তার মাঝে সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, ভৌগলিক অবস্থান, সামাজিক মূল্যবোধ, বাজারজাতকরণ, অর্থনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয় তিনি এমন কিছু সবজির নাম উল্লেখ করেন যা কিনা দেশের অন্য কোন স্থানে পাওয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, এই গবেষণাটি মাত্র শুরু করা হয়েছে।

এটি নিয়ে আরো কাজ করা সম্ভব এবং এই গবেষণাটি দ্বারা হয়তো এমন কোন খাবারের সন্ধান পাওয়া সম্ভব; যা ক্যন্সার, ডায়াবেটিকস, উচ্চ-রক্তচাপ জাতীয় শারীরিক সমস্যার সমাধান করা যাবে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এ কে এম মাঝহারুল ইসলাম তাঁর গবেষণায় বাংলাদেশের খাসিয়া জনগোষ্ঠীর পান-সুপারী চাষের ব্যাপারে বেশী উৎসাহী হওয়ার কারণ হিসেবে বংশ পরম্পরায় তাদের বিশ্বাসকে গুরূত্ব দেন। প্রাতরাশের সময় নিজেদের গবেষণার বিষয় নিয়ে কথার সময় আলোচনায় উঠে আসে- বর্তমান গবেষণাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তত্ত্ব এবং ল্যাবটারির উপর নির্ভরশীল। যা তথাকথিত দৃষ্টিতে সহজ হলেও তার সামাজিকভাবে খুব বেশী গুরূত্ব রাখে না। সাস্থ্য সম্পর্কিত গবেষণা বলতে সকলেই হাসপাতালের কেবিন এবং প্যাথলজি বোঝে কিন্তু নৃ-তত্ত্বর একটি গুরুত্বপুর্ণ অংশ খাদ্যাভাস।

জার্মানির নৃতত্ত্ববিদ ড. সাবিন জেল বাহিলসেন তার গবেষণার বিবরণ দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন, আফ্রিকার পাপুয়া নিউ-গিনিতে স্বর্ণ সন্ত্রাস এবং নারীদের উন্নয়ন। তিনি বলেন, নারীদের নিজের পায়ে নিজে দাড়ানোর জন্য সংস্কৃতির চেয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বেশী জরুরী। নাইজেরিয়ার শিক্ষাবিদ আল্কানে ফ্লোরেন্স তার গবেষনায় বলতে চান অর্থনৈতিক মন্দা লাঘবের জন্য নাইজেরিয়াতে নিজের ব্যবসা বাণিজ্যই উন্নয়নের চাবি-কাঠি হতে পারে। আমাদের বাংলাদেশে জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই নারী দিবসে একজন নায়লা বারীর স্বপ্ন তুলে ধলাম।

কারণ, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.