আমি সত্য জানতে চাই
To me the thoughts of God and the thoughts of immortality of men are synonymous. I shall raise no objection if you call me a theist. So I am. Neither shall I object if you call me an atheist. Whether you are a theist or an atheist, a believer or not; I see no reason of conflict. My ultimate subject is human beings and human beings alone. It is the human being who is the origin of all beliefs, value and scientific intellect.
-Ahmed Sofa ['Selected Essays']
......আমার কাছে ঈশ্বর-চিন্তা আর মানুষের অমরতার চিন্তা সমার্থক। কেউ যদি আমাকে আস্তিক বলেন বিনা বাক্যে মেনে নেব। আমি আস্তিক। যদি কেউ বলেন নাস্তিক আপত্তি করব না। আস্তিক হোন, নাস্তিক হোন, ধর্মে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন,আমি কোন বিবাদের হেতু দেখতে পাইনে।
আমার অভীষ্ট বিষয় মানুষ,শুধু মানুষ। মানুষই সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত মূল্যচিন্তা, সমস্ত বিজ্ঞানবুদ্ধির উৎস।
-আহমদ ছফা [নির্বাচিত প্রবন্ধ]
আহমদ ছফা ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা লেখকদের একজন। তাঁর লেখায় বাংলাদেশী জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী মিলিয়ে তিরিশটির অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। জীবদ্দশায় আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধী, নিমোর্হ, অকপট দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য বুদ্ধিজীবি মহলে বিশেষ আলোচিত ছিলেন। তিনি ২০০২ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। আজ এই মনিষী লেখকের ১১তম মৃত্যুদিন। মৃত্যুদিনে তাঁর জন্য আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হেদায়েত আলী ওরফে ধন মিয়া। মা মরহুমা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ; একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। পরে বাংলা বিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমীর পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন।
গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্তশ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। মৌখিক পরীক্ষা হয় একুশে মার্চ। পিএইচডি সম্পন্ন করা পরে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরে ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যোটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যে জ্ঞান তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সাহস জুগিয়েছিল।
একটা কথা বলে রাখা দরকার। আহমদ ছফা যখন Sceptical Essays অনুবাদ করেন ওই সময় বার্ট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে তাঁর একটা সম্পর্কও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাসেলের সঙ্গে তাঁর পত্র যোগাযোগ ছিল। বার্ট্রান্ড রাসেলের দু’খানা চিঠি জীবদ্দশায় তাঁর কাছে ছিলো তবে তিনি মারা যাবার পর চিঠি দু’টির হদিস পাওয়া যায়নি। হয়ত বাড়ি পাল্টানোর সময় অথবা অন্য কোনো কারণে চিঠিগুলো হাতছাড়া হয়ে গেছে।
(আহমদ ছফা ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস)
বাপ-দাদার জন্মস্থান গ্রামকে দূরে ঠেলে দিয়ে ঢাকা শহরে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন আহমদ ছফা। চাকচিক্যময় ঢাকা শহরে তিনি ছিলেন একেবারে বেমানান। তাঁর চলনে-বলনে ছিল গ্রাম্যদোষ। পোশাকে-আশাকে ছিল না সাহেবিয়ানা। নামটাও ছিল গেঁয়ো প্রকৃতির।
সুযোগ পেলেই তারা তাঁর নাম সংশোধনের সুপারিশ করতেন। কিন্তু তিনি তাতে গা করতেন না। মা-বাবার দেয়া নামের প্রতি তাঁর একটা শ্রদ্ধাবোধ ক্রিয়াশীল ছিল। এই নামের প্রতি কেউ অমর্যাদা করুক তা তিনি চাইতেন না। তিনি বলতেন, এই নামের পেছনে অনেকে উঠেপড়ে লেগেছিলেন।
মা-বাবার দেয়া নামকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্য আমাকে দিনে রাতে আঠার ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হয়েছে। আহমদ ছফার মনটা ছিল সুন্দর। কথার মাধ্যমে যে কাউকে তিনি সহজে আকৃষ্ট করতে পারতেন।
(১৯৫৫ সালে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের সংগে আহমদ ছফা)
সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন আহমদ ছফা। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী, অনুবাদসহ সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রেই তাঁর অবাধ বিচরণ।
সব্যসাচী এই লেখক একাধারে দার্শনিক এবং মানবতাবাদী। অধুনালুপ্ত দৈনিক গণকন্ঠের উপদেষ্টা এবং সাপ্তাহিক উত্তরন ও উত্থান পর্বের প্রধান সম্পাদক ছিলেন তিনি। তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠা সম্পাদকও ছিলেন। তাঁর একাধিক রচনা অনুদিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। প্রচারবিমুখ এ লেখক কখনো নাম-যশ-পুরষ্কার এসবের তোয়াক্কা করেননি।
সেজন্য প্রত্যাখান করেছিলেন ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার’ এবং ‘শহীদ আখন্দ স্মৃতি পুরস্কার’। তিনি মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ লাভ করেন।
আহমদ ছফার প্রথম গ্রন্থ একটি উপন্যাস- সূর্য তুমি সাথী। প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে মুক্তধারা থেকে প্রকাশ পায় তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ জাগ্রত বাংলাদেশ।
প্রকাশকাল শ্রাবণ ১৩৭৮ বা জুলাই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। দীর্ঘকাল তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। ১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। সাতই মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধ প্রকাশ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে দাবানল নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক গণকণ্ঠ ধারাবাহিকভাবে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ রচনা প্রকাশ করেন। এর কারণে তৎকালীন সরকারের রোষে পড়তে হয় তাঁকে।
১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস গ্রন্থ প্রকাশ পায়। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। বাংলা একাডেমী থেকে বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ।
ছফা মহাকবি গ্যোতের ফাউস্ট অনুবাদ শুরু করেন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে। মুক্তধারা থেকে ফাউস্টের অনুবাদ বের হয় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ।
১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অলাতচক্র। স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতির গোপন-রহস্য, শৌর্য মৃত্যু ও কপটতার গীতিকা এই উপন্যাস। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ এবং অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী প্রকাশিত হয়। ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ পূর্বে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রাণপূর্ণিমার চান নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। জাপানী ভাষায় পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ।
পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গ ঘুরে সুশীল সমাজের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে তাঁর এই উপন্যাসে। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ও সমসাময়িক কালের বিশিষ্ট পণ্ডিত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রসঙ্গে রচিত যদ্যপি আমার গুরু প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে । তাঁর জীবদ্দশায় আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে আহমদ ছফা রচনাবলি দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ পায়। জীবিত থাকাকালীন আহমদ ছফা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন।
(আহমদ ছফা ডঃ আহমদ শরীফের সাথে)
আমরা জানি, আহমদ ছফা মুক্তিকামী লেখক ছিলেন বলে কারো অন্ধ কীর্ত্তনীয়া হতে পারেননি। একজন মানুষকে, একজন লেখককে, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আঘাত কিংবা উপো করার একমাত্র কারণ যদি হয় কোনো দল বা ব্যক্তির আজ্ঞাবাহক না হওয়া, তবে তা লজ্জাজনক। আহমদ ছফা, ফররুখ আহমদ প্রমূখের মতো যারা শেকড়বাদী জাত লেখক তাদেরকে চাইলেই পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া যায় না। আহমদ ছফা লিখেছেন আজীবন সত্যের জন্য, তিনি ছিলেন নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। আমাদের জাতীয় চিন্তা-চেতনাকে সর্বপ্রকার লাইগেশন মুক্ত করে আলোর পথে নিয়ে যেতে তিনি অকান্ত চেষ্টা করেছেন।
আহমদ ছফার অমরত্বের জন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। তিনি নিজেও এসবে আগ্রহী ছিলেন না। এমনকি রক্তমাংসের উত্তরসূরী সৃষ্টিতেও এগিয়ে যাননি তিনি। এক্ষেত্রে তিনি অনেকটা তাঁর ভাবগুরু জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে অনুসরণ করেছেন। আহমদ ছফা সমুদ্র সৈকতের ঝিনুক কুড়িয়েদের মতো, কণা কণা মুক্তা দিয়ে বাংলা সাহিত্যের শরীরে যে অলংকার দিযে গেছেন সেগুলোই তাকে অকৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখবে প্রজন্মপরাক্রমে।
সাহিত্যের পাঠক-লেখকরা নিজেদের প্রয়োজনে তাকে খুঁজে বের করবেন তাঁর সৃষ্টির উপত্যকা থেকে।
এই মনীষী লেখক ২০০১ সালের ২৮ জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবি গোরস্থানে তাঁর দাফন হয়। আজ তাঁর ১১তম মৃত্যুদিন। তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।