একমাত্র সত্য ও সুন্দরের জন্য চাকরি আছে, কিন্তু বেতন নেই’—চমকে দেয়ার মতো এমন অভিনব খবর সত্যিই বিরল। দেশের প্রায় সব এলাকা থেকে সরকার দ্বারা ‘নিয়োগকৃত’ সহস্রাধিক ‘স্বেচ্ছাসেবী’রয়েছেন। ১৯৭৫-৭৬ সালে সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দেশে কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ফিল্ড এসিস্টেন্ট আর্টিফিসিয়াল ইনসেমিনেশন (এফ.এ.—এ.আই) পদবী দিয়ে নতুন জনবল নিয়োগ দিয়েছিল। পাঁচ বছর পেরোতে না পেরোতে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই কার্যক্রম ব্যাপক সফলতা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং তা আরো সম্প্রসারিত করা জরুরি হয়ে উঠেছে। এই উপলব্দির ভিত্তিতে ১৯৮০-৮১ অর্থ বছরে এই ধারায় সরকারি কার্যক্রম প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে ৪২৮টি পদ সৃষ্টি করে ৩ মাসের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সে কাজে নতুন জনবল যুক্ত করা হয়।
এবার ফিল্ড এসিস্টেন্টদেরকে গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ বাজারসমূহ ও কিছু কিছু ইউনিয়নেও পোস্টিং দেয়া হয়। এই কার্যক্রমের দ্বারা গো-সম্পদসহ দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক সফলতা আসায় প্রকল্পের অধীনে নিযুক্ত ফিল্ড এসিস্টেন্টদের চাকরিকে রাজস্ব খাতের আওতায় স্থানান্তর করা হয়। এই পদে এখন দেশে ৯৫৭ জন নিয়োগপ্রাপ্ত আছেন। তারা যথারীতি মাসিক ১৩ থেকে ২২ হাজার টাকা করে বেতন পাচ্ছেন।
এরপরেই ঘটে একটি ভিন্নপথে যাত্রার সূচনা।
দিন দিন কৃত্রিম প্রজননের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় আরো লোকবলের প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই তীব্র হতে থাকে। এই বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য ১৯৯৫-৯৬ সালে ফিল্ড এসিস্টেন্টের সংখ্যা বাড়ানোর বদলে সরকার আরেকটি ভিন্নধর্মী প্রকল্পের অধীনে লোকবল নিয়োগ করা শুরু করে। এই প্রকল্পের অধীনে ‘বিনা বেতনের স্বেচ্ছাসেবক’ হিসাবে ‘সেবাকর্মী’ পরিচয়ে ৪৫০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রতি থানা বা উপজেলা থেকে এইচ.এস.সি পাস করা একজন করে নিয়ে, তাদেরকে ৩ মাসের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দিয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই কৃত্রিম প্রজনন কাজে লাগানো হয়। আরো পরে, ইউনিয়ন পর্যায়ে এই কাজ অতিরিক্তভাবে সম্প্রসারণের জন্য এবার এস.এস.সি পাস করা ব্যক্তিদের একই ধরনের ৩ মাসের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘স্বেচ্ছাসেবক’ নামে নিয়োগ দেয়া হয়।
সারাদেশে এদের সংখ্যা বর্তমানে ২০৭০ জন।
এসব ‘সেবাকর্মী’ বা ‘স্বেচ্ছাসেবক’ সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত। তৃণমূলের সরকারি দপ্তরে বসে তারা কাজ করে। সে হিসাবে তারা সবাই ‘সরকারি কাজে’ নিযুক্ত লোক। অথচ সরকার তাদেরকে কোনো বেতন-ভাতা দেয় না।
ফিল্ড এসিস্টেন্টদের মতো সমদক্ষতার ও সমপর্যায়ে কাজ করা সত্ত্বেও তারা আসলে হয়ে আছে ‘বেতনবিহীন সরকারি চাকরিজীবী’। তারা নাকি ‘স্বেচ্ছাসেবক’! স্বেচ্ছাসেবকদের আবার বেতন কি? তাদেরকে একথাই বলা হয়েছে যে, সেবা বিক্রি করে তার বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে তাদেরকে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। নিয়ম করা হয়েছে যে, একটি গাভী প্রজননের জন্য ৭০/- টাকা নেয়া যাবে। তার মধ্যে ৪০/- টাকা স্বেচ্ছাসেবী নিজের জন্য রেখে ৩০/- টাকা সরকারি রাজস্বে জমা দিতে হবে। বেতন পাওয়ার তো প্রশ্নই নেই, উল্টা পাবলিকের কাছ থেকে টাকা তুলে তাদেরকে তা সরকারকে দিতে হবে! গত বছর তারা মোট ১০ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা এভাবে সরকারের জন্য আয় এনে দিয়েছে।
অথচ পাবলিককে অতি গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদানের জন্য সরকার তাদেরকে এক পয়সাও দেয়নি। যুক্তি হলো, তারা তো ‘স্বেচ্ছাসেবক’! ‘স্বেচ্ছাসেবকের’ আবার বেতন কি?
জনগণকে পণ্য ও সেবা প্রদান করাই হলো একটি সরকারের কর্তব্য। জনগণকে উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় সেবা ও পণ্য যাতে ঠিকমতো পৌঁছে দিতে পারে, সেজন্যই সরকার জনগণের কাছ থেকে কর খাজনা-ট্যাক্স-কর আদায় করে তার তহবিল তৈরি করে। সরকারের টাকা তো আসলে পাবলিকের টাকা। এই টাকার বেশিরভাগই আসে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পরোক্ষ কর হিসাবে।
সামান্যই আসে প্রত্যক্ষ কর হিসেবে বড়লোকের কাছ থেকে। তাই সরকারের টাকা ব্যয় করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত সেই সেবা ও পণ্য যেটা ব্যাপক দেশবাসীর বর্তমান ও ভবিষ্যত্ স্বার্থ রক্ষার্থে সবচেয়ে উপকারী। দেশের মানুষের জন্য অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর সাথে সাথে পর্যাপ্ত প্রাণিজযারা জনগণকে সেবা প্রদান করবে তাদের ক্ষেত্রে দু’ভাবে তাদের পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক হলো, রাষ্ট্রীয়ভাবে তার বেতন-মজুরি-ভাতার ব্যবস্থা করা। অন্যটি হলো, পাবলিকের কাছে সেবা বিক্রি করে সেই বিক্রির টাকায় সেবা প্রদানকারীদেরকে তাদের পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে নিতে বলে দেয়া।
এক্ষেত্রে উচিত সবাইকেই ‘স্বেচ্ছাসেবক’ হিসেবে গণ্য করা। যদি দ্বিতীয়টিকেই নীতি হিসেবে সব ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় তাহলে মন্ত্রী, এমপি, সচিব, সেনা সদস্য, পুলিশ ইত্যাদি সকলকেই নিজ নিজ সেবা পাবলিকের কাছে বিক্রি করে তা দিয়ে চলতে বলে দেয়া উচিত নয় কি? আর যদি একথা বলা হয় যে বেশি জরুরি সেবা কার্যক্রমের দায়িত্ব সরকার নিবে, কিন্তু অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ সেবা সরবরাহের কাজ খোলা বাজারের ক্রয়-বিক্রয়ের নিয়মে চলবে, —তাহলে কি এটা দাবি করা যায় না যে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য কৃত্রিম প্রজননের কাজে নিয়োজিতরা ‘প্রতিরক্ষা’, ‘আমলাতন্ত্র’ ইত্যাদির চেয়ে কোনোভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে না। মন্ত্রী, ডিসি, সচিব, সেনা সদস্য, পুলিশ সবাই সেবা প্রদান করার বিনিময়ে যদি রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত বেতনের দাবিদার হতে পারে। তাহলে প্রাণিসম্পদ স্বেচ্ছাসেবীরা তা পাবে না কেন? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।