আমি খুবি সাধারণ পেন্সিলে আঁকা সহজ স্বপ্ন আমার । স্বপ্ন দেখতে ভুল হলে ইরেজার দিয়ে সহজে মুছে ফেলা যায় । আমার স্বপ্ন । মুসলিমদের কথা এখন আর আভাসে-ইঙ্গিতে নয়, সরাসরিই বলছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে।
এক, দলটি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের পরের পরিস্থিতির হিসাব কষছে। সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে তাদের সেক্যুলার দলগুলোর সমর্থন পেতে হবে। মুসলিমদের প্রতি কোনো বিষোদ্গার করে ফেললে তার মূল্য বিজেপিকে দিতে হবে এবং হয়তো একটি কার্যকর কোয়ালিশন গঠনে সমস্যাও হবে।
দ্বিতীয়ত, বিজেপি ভাবছে হিন্দুত্ববাদী ধ্যানধারণা মোটের ওপর বামপন্থী দলগুলোও যখন কিছুটা গ্রহণ করেছে, সে রকম একটা সময়ে তাদেরও উদার উদার ভাব দেখানো ভালো। গত কয়েক বছরে কংগ্রেসকে তার সেক্যুলার যোগ্যতা দ্রুতই খুইয়ে ফেলতে দেখা গেলেও বাস্তবতা হলো, মুসলমানেরা গড়পরতাভাবে কংগ্রেসকেই ভোট দিয়ে আসছে।
এখন মুসলমানদের সামনে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আজকের সব দলের মধ্যে কোনটি বেশি উদার, তা খুঁজে বের করা। ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের আরও র্যাডিক্যাল হয়ে ওঠায় লাভ হবে না, যদিও সেটাই হচ্ছে। মুসলমানদের এই র্যাডিক্যাল হয়ে ওঠার ঘটনাকে মুসলিম সমাজের রক্ষণশীলতার উদাহরণ হিসেবে তাদের শত্রুরা ব্যবহার করছে। মুসলমানেরা ভারতে সংখ্যায় কম হওয়ায় মুসলিম সন্ত্রাসবাদ হিন্দু সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে কোনোভাবেই পেরে উঠবে না। সুতরাং সে পথও বাতিল।
উপলব্ধি করতে পারি যে হতাশায় মরিয়া হয়ে মুসলমানদের কেউ কেউ সন্ত্রাসবাদের পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু তাদের ভাবতে হবে যে হিন্দু জঙ্গি সংগঠন তথা বজরং দল, রাম সেনা ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদও চায় যে মুসলমানেরা জঙ্গিত্বই দেখাক। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে প্রমাণিত হয়েছে যে এসব সংগঠনই জঙ্গিত্ববাদী। মালেগাও, আজমের ও হায়দরাবাদের বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে এই বজরং, রাম সেনা ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সংশ্লিষ্টতা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। যদিও প্রথম দিকে সন্দেহটা ছিল মুসলমানদের ওপর—অভ্যাসবশত পুলিশ এটাই করে থাকে।
দলে দলে মুসলমান যুবককে তখন আটক করা হয়, হায়দরাবাদে পুলিশ তাদের পেটায়। কিন্তু আরও গভীর তদন্তে দেখা গেল সন্ত্রাসের হাতগুলো ছিল হিন্দু।
বাস্তবতা, ভারতের মুসলমান সমাজের সামনে উপস্থিত হওয়া বড় সমস্যা হলো মুসলমান তরুণদের গ্রেপ্তার। হিন্দুসহ মুসলমানদের একটা প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দেখা করে এ ব্যাপারে প্রতিকার চায়। তিনি পদক্ষেপ নেবেন বলে কথা দিলে মুসলমান যুবকদের গ্রেপ্তারের সংখ্যা একটু কমে।
তার পরও এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা মোটেই সন্তুষ্ট নন। অনেক মুসলিম যুবক জেলের ভেতরে পচছে, কবে তাদের মামলার প্রথম শুনানি শুরু হবে তার জন্য অপেক্ষা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই। তাদের জীবন থেকে মূল্যবান বছরগুলো হারিয়ে যাওয়াই সবচেয়ে বড় ক্ষতি। এই বছরগুলোতে তারা উচ্চতর শিক্ষা নিতে পারত, করতে পারত কোনো দরকারি কাজ।
যদি জবাবদিহির সংস্কৃতি থাকত তাহলে পুলিশ এই ঔদ্ধত্য দেখাতে পারত না।
আদালত যখন দেখত যে তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই, তখন তাদের ছেড়ে দিত। তাহলে এই ভুলটা কে করল? বেআইনি আটকের জন্য তাহলে কে দায়ী? মুসলমানদের বিনা অপরাধে আটক রাখার ঘটনার দাগ মুছে ফেলতে হলে দায়ী ব্যক্তিকে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে।
মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূরত্বের জন্য আমি অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। একে অন্যের সঙ্গে কোনো সামাজিক যোগাযোগ নেই। পারস্পরিক আদান-প্রদানের মনোভাবও মরে যেতে বসেছে।
একটাই সুখবর যে গুজরাট হত্যাযজ্ঞের পর আর কোনো দাঙ্গা হয়নি। এর মানে আবার এই নয় যে ভারত সাম্প্রদায়িকতাকে নির্মূল করতে পেরেছে। আসামই তো সাম্প্রতিক উদাহরণ।
কিছুদিন আগে কেরালায় ছিলাম। দেখলাম, বেশির ভাগ বামপন্থীর মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে গেছে।
এটা হলো সেই রাজ্য, যেখানে হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে বিবাদের সুযোগে খ্রিষ্টানরা প্রভাব বাড়িয়ে ফেলছে। আমাদের আড়ালে, উত্তর প্রদেশে ছোট আকারের শত শত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। অথচ গণমাধ্যমে তার সামান্যই জানানো হয়েছে। কার্যত, বড় আকারের দাঙ্গা না হলে কেউ তা নিয়ে কথাই বলে না।
একদিকে আমাদের রয়েছে দিল্লির উদাহরণ।
২৩ বছরের একটি মেয়ে ধর্ষিত হলে তার প্রতিবাদে সব বর্ণের ও সব ধর্মের ছাত্রছাত্রী ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াল। অনাচারের বিরুদ্ধে এই ঐক্যই আমাদের পথ দেখাবে। অন্যদিকে যেকোনো ভুল পথ গ্রহণ খাপ থেকে বের করে আনবে তরবারি।
কংগ্রেস নেতা আবুল কালাম আজাদ ও আবদুল গাফফার খানের মতো আমিও বিশ্বাস করতাম যে সাম্প্রদায়িকতা ব্রিটিশের তৈরি করা ব্যাধি, ব্রিটিশরা বিদায় হলেই সাম্প্রদায়িকতাও বিদায় নেবে। কিন্তু আমি ভুল প্রমাণিত হয়েছি।
দেশভাগের আগে যে উন্মত্ততা দেখেছিলাম, সামাজিক খোলসের তলে সেই উন্মত্ততাই আবারও দেখতে পাচ্ছি এখন। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের স্বার্থে বা অন্য কোনো কারণে যখনই দরকার মনে করে তখনই এই উন্মত্ততাকে সামনে নিয়ে আসে। স্বাধীনতার ৬৫ বছর হয়ে গেল, অথচ আজও সেক্যুলারিজমের শিকড় গজাল না। যা একে ক্ষয় করে দিচ্ছে তা হলো গ্রহণ না করার মানসিকতা। সেক্যুলারিজমকে টেকানোর একটা উপায় হলো, যে এর ক্ষতি করবে তাকেই শাস্তি দেওয়া।
অথচ বাবরি মসজিদ ধ্বংসকারীরা এখনো শাস্তি পায়নি। একইভাবে তিন হাজার মুসলমানকে হত্যা করার পরও মোদির চুলটাও স্পর্শ করা হয়নি। বরং সেই ঘটনার কারণে বিজেপিতে তার আসন আরও উঁচু হয়েছে।
আমার অস্বস্তি হচ্ছে দেখে যে সাম্প্রদায়িকতা এখন বৈধতা পাচ্ছে। উত্তরোত্তর বেশি হারে মানুষ ধর্মান্ধ হয়ে পড়ছে।
এমনকি পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীতেও এর সংক্রমণ ঘটছে। গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে ঘৃণা আর পক্ষপাতিত্ব রাজনীতির অঙ্গন থেকে হটাতেই হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।