স্বর্ণা এবার এইচ এস সি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে ওর, যখন নিজের ইচ্ছেমত কিছুই করতে পারে না। কলেজে যাওয়া, আসা, কোচিং-এ পড়তে যাওয়া, যেখানেই যাক, সব সময় মা-ই ওকে আনা নেওয়া করে। ওর বেশ কয়েকজন বন্ধুর বেলায়ও একই অবস্থা। কখনো কোথাও একা গেলে, বাবা-মায়ের সে কি টেনশন! অথচ ওরই তো বন্ধু মেহেরিন! বাসায় কি সুন্দর মিথ্যা কথা বলে কতখানে ঘুরে আসে।
নাহ, স্বর্ণাকে দিয়ে এসব হবে না। বাসার সামনের মুদি দোকান থেকেও কোন কিছু কিনে নিয়ে আসতে ও সাহস পাবে না। মেহেরিনের কাছ থেকে ওর অভিজ্ঞতা শুনে শুনে রোমাঞ্চিত হওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই ওর।
এইচ এস সি পরীক্ষা দিন মায়ের সাথেই পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছালো স্বর্ণা। পরীক্ষা শুরু হবার আগে খাতার পেছনে লেখা নির্দেশগুলো পড়তে বলেছিলেন শিক্ষক।
সেগুলো পড়তে পড়তে ও দেখল, লেখা আছে, খাতার প্রতিটি পৃষ্ঠায় নম্বর দিতে হবে। চিন্তায় পড়ে গেল স্বর্ণা ও তার বন্ধুরা। কীভাবে, কোন খানে খাতায় পৃষ্ঠা নম্বর দিতে হবে ওরা বুঝতে পারছে না। পরীক্ষার কক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক বিষয়টা বুঝিয়ে দিলেও একটু বিরক্ত হলেন। এই পরীক্ষার্থীরা কিছুদিন পরেই প্রাপ্ত বয়ষ্ক হয়ে যাবে, ভোটাধিকার পাবে।
এরা এসেছে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে। অথচ পরীক্ষার খাতায় পৃষ্ঠা নম্বর কিভাবে দিতে হয় সেটা কেউ বলে না দিলে করতে পারছে না। নিজে নিজে এই সামান্য সিদ্ধান্তটুকুও নিতে পারছে না! অথচ কয়দিন পরে পত্রিকার পাতা ভরে যাবে এদেরই হাস্যজ্জ্বল ছবিতে, এ প্লাস পেয়েছে বলে।
আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাবা-মায়েরা সন্তানদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে কেবল একটি ব্যাপারেই বেশি জোর দিয়ে থাকেন। সেটা হলো, স্কুল কলেজের পরীক্ষার ফলাফল।
কিন্তু এর পাশাপাশি সন্তানের জীবনের অন্যান্য দক্ষতাগুলোর দিকে তেমন নজর দেন না। অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে ফার্মের মুরগির মত বেড়ে উঠার ফলে জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে খেই হারিয়ে ফেলে অনেক ছেলেমেয়ে, তীব্র হতাশায় ডুবে যায় তারা। নিজের জীবনের কোন সিদ্ধান্ত নেবার মত আত্নবিশ্বাস তাদের গড়ে উঠে না। মানসিক পরিপক্কতাও আসে না। বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের পড়ালেখার পাশাপাশি তাদের জীবন দক্ষতার দিকেও বাবা-মায়ের গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
নিজের জীবনের সমস্যা নিজেই সঠিকভাবে সমাধান করতে পারা, নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে সেগুলো নিজে নিজে সম্পাদন করতে পারাই জীবন দক্ষতা।
স্বর্নার মত অনেকে ছেলেমেয়ে আছে যাদের পরীক্ষার ফলাফল অনেক ভাল, কিন্তু কঠিন বাস্তবতার সাথে তারা তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। কারণ তারা জীবন দক্ষতাগুলো অর্জন করেনি। প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত সন্তানকে জীবনের কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে একটু একটু করে পরিচিত করিয়ে দেওয়া, সেগুলোর সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকার জন্য তৈরি করে দেওয়া। বাবা-মা সাথে না থাকলেও ওরা যেন কখনো নিজেকে অসহায় না ভাবে।
নিজের জীবনের সমস্যা নিজেই সমাধান করে নেবার মত মানসিক পরিপক্কতা যেন তাদের তৈরি হয়। তাহলে শুধু স্কুল-কলেজের পরীক্ষাতেই নয়, জীবনের যে কোন পরীক্ষাতে সফলভাবে ওরা উত্তীর্ণ হতে পারবে। তাই কোন সমস্যাতে পড়লে কীভাবে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা সমাধান করতে পারবে সে সম্পর্কে ওদেরকে শেখাতে হবে।
কীভাবে শেখাবেনঃ
১. সন্তানকে তার সমস্যা নিজে নিজে চিহ্নিত করতে দেবেন। তাকে প্রশ্ন করতে পারেন, ‘’এখন তুমি যে অবস্থায় আছো, ভবিষ্যতেও কি নিজেকে সেভাবে দেখতে চাও?’’, ‘’নিজেকে তুমি ভবিষ্যতে কীভাবে দেখতে চাও?’’ ‘’ভবিষ্যতের লক্ষ্য পৌঁছুতে হলে কী কী সমস্যা হতে পারে?’’ সন্তানের পজিটিভ এটিচুড তৈরি হবার জন্য তাকে উৎসাহ দিতে হবে।
২. সন্তানকে ভাবতে দিন, তার সমস্যাটি কত রকম ভাবে সমাধান করা যেতে পারে। সে নিজে কীভাবে সমাধান করতে চেয়েছিল আর এর ফলে তার অভিজ্ঞতা কেমন হয়েছে সেগুলো শুনুন। আপনার নিজের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে পারেন। কিন্তু আপনি নিজে কো্ন সমাধান দিয়ে দেবেন না। বরং কিছু অবাস্তব উপায়ের কথা বলতে পারেন।
এর মাধ্যমেই ওরা ধীরে ধীরে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। তাতে সময় লাগুক, আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে।
৩. সিদ্ধান্ত নেওয়াঃ সমাধানের উপায়গুলো নিয়ে সন্তানের সাথে কথা বলুন। তাকে চিন্তা করতে দিন, কোন পদ্ধতি অবলম্বন করলে সময় কম লাগবে, অথবা নতুন সমস্যা হবে না বা কোন পদ্ধতি বাস্তবসম্মত হবে কিংবা বাধা কম আসবে।
৪. সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও যাচাইঃ সন্তানকে তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে দিন।
এর ফলে তার কাজ কতটুকু সমাধান হলো তা দেখুন। দরকার হলে কাজের পদ্ধতিতে অদল বদল করার পরামর্শ দিতে পারেন।
এভাবে আপনার সন্তানকে জীবনের সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়ে সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত করে দিন। লক্ষ্য অর্জনে তাকে আত্নবিশ্বাসী করে গড়ে তুলুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।