ঘুষ এবং দুর্নীতি মারাত্মক দুটি ব্যাধি, যা অনেক দেশেই মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশেও তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ঘুষ এবং দুর্নীতির কারণে দেশ এবং জনগণের কতটা ক্ষতি হচ্ছে তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নাই। এর সাথে যোগ হয়েছে অন্যায়, অনাচার, জুলুম নির্যাতন। অপরাধীদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বাড়ছে আর মজলুম জনতার আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হচ্ছে।
অপরাধ বন্ধের আইন হচ্ছে, লেখা লেখি হচ্ছে, বক্তৃতা বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অপরাধ কমছে না। বছরের পর বছর যুগের পর যুগ এভাবেই চলছে। এক সময় যারা দুর্নীতি আর জুলুম নির্যাতন বন্ধের উপদেশ দেয় তারাই আবার দায়িত্ব পেলে দুর্নীতি আর জুলুম নির্যাতনের সাথে কম বেশি জড়িয়ে পড়ছে [ কিছু মানুষ অবশ্যই ভাল আছে]। এই দুষ্ট চক্রের কবল থেকে দেশ ও জাতির যেন মুক্তি নাই।
কিন্তু কেন?
কেও বলছেন আইনের শাসনের অভাব রয়েছে আবার কেও বলছেন আইনের শাসন ঠিক ঠাক মতই চলছে। তা ঠিক থাকুক বা না থাকুক আইন মানুষকে সার্বক্ষণিক পাহারা দিতে পারে না। রাতের অন্ধকারে যেখানে কেও দেখছে না সেখানেও মানুষ অপরাধ করে। তাকে আইন কিভাবে বাঁধা দেবে। আবার আইনের ফাঁক গলে রাঘব বোয়াল গুলো বের হয়ে যেতে দেখা যায় হর হামেশাই।
সঠিক বিচার বা ন্যায় বিচার বলে যেটাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় সেটার রায়ও অনেকটা নির্ভর করে সাক্ষীর সাক্ষ্যের উপর। কিন্তু মানুষ যদি হলফ করেই মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় তাহলে সেটাকে থামাবে কে?
প্রিন্ট মিডিয়া আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে যারা দুর্নীতি আর জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তারাও দায়িত্ব পেলে দুর্নীতি বা জুলুম নির্যাতন করবে না তার কী গ্যারান্টি আছে? আজকাল যাদের বিরুদ্ধে এই সব অপরাধের অভিযোগ আসছে তাদের অনেককেইতো এক সময় এই সব অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার দেখা গেছে। আর ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সন্ত্রাসী লালন করা এখন গরু ছাগল পালনের মত ডাল ভাত হয়ে গেছে। তাহলে এই সব অপরাধ থেকে বাঁচার উপায় কি? বাঁচার পথ একটা আছে আর সেটা সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও বর্ণনা করাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
দুনিয়াবি লোভ লালসা, জবাবদিহিতার ভয় না থাকা, ধরা না পড়ার সম্ভাবনা আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে পার পেয়ে যাওয়ার মত কিছু কারণেই সাধারণত মানুষ অপরাধ করে থাকে।
আর যারা অভাবের কারণে অপরাধ করে সেটাও যদিও অপরাধ তবে তা মোটামুটি ছোটখাটো ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে। যেমন ক্ষুধার কারণে কেও চুরি করলে সে একবেলার খানা চুরি করে। ঘুষ দুর্নীতির মত বড় বড় অপরাধ গুলো বন্ধ হয়ে গেলে কেও আর অভাবের মধ্যে থাকবে না। তাই অভাবের কারণে যে সব অপরাধ করা হয় তা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে।
লোভ লালসাকে যদি ত্যাগ করা যায় বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, জবাবদিহিতার ভয় যদি অন্তরে সদা জাগ্রত থাকে, ধরা না পড়ে রেহায় নাই বরং অপরাধী ধরা পড়বেই এরকম দৃঢ় বিশ্বাস যদি মনে থাকে, আর রোজ কিয়ামতে কারো ক্ষমতা থাকবে না একমাত্র পরাক্রমশালী আল্লাহ তালার ক্ষমতাই চলবে তাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে পার পাওয়া যাবে না এই বিশ্বাস নিয়ে যদি কেও দায়িত্ব পালন করে তাহলে কারো পক্ষে অপরাধ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু এই কথা গুলি অনেকেরই মুখস্থ আছে তার পরেও তারা অপরাধ করছে। কিন্তু কেন? তাহলে বাঁচার উপায় কি? এটাই আজকের মূল আলোচ্য বিষয়।
আমরা এমন অনেক কিছুই জানি যা জানা থাকা সত্যেও উপায় উপকরণ আর প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে তার উপর আমল করতে পারি না। আর যদি উপায় উপকরণ আর প্রশিক্ষণ থাকে তাহলে জানা বিষয় গুলোর উপর আমরা আমল করে দেখাতে পারি খুব সহজেই।
মানুষের মধ্যে সাধারণত অহংকার, হিংসা, দুনিয়ার লোভ-লালসা, আখেরাত সম্পর্কে উদাসীনতা, গুনাহের প্রতি আগ্রহ ইত্যাদি দোষ ত্রুটি গুলি থাকে।
এই সমস্ত দোষ ত্রুটি গুলি শয়তানের ওয়াসওয়াসা আর কুমন্ত্রণার দ্বারা দৃদ্ধি পেতে থাকে। আল্লাহর নেক বান্দাগণ রিয়াজাত আর মুজাহাদার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি করেছেন তাই তারা শয়তানের এসমস্ত ধোঁকা সম্পর্কে সহজে অবগত হন এবং সহজে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচতে পারেন। আর যারা তাদের সংস্পর্শে এসে তাদের কাছ থেকে শয়তান আর নফসের ধোঁকা থেকে বাঁচার বিভিন্ন তদবির শিখেন তারাও শয়তানের ধোঁকা সম্পর্কে সহজে অবগত হন এবং তারাও সহজে বাঁচতে পারেন। আল্লাহর নেক বান্দাগণের বাতানো রাস্তায় চলার কারণে নফসের বিভিন্ন দোষ ত্রুটি গুলি আস্তে আস্তে ত্যাগ করা সহজ হয়ে যায়। এটাই হল অপরাধ ত্যাগ করা আর ইবাদতের প্রতি মনোযোগী হওয়া সহজ করার প্রশিক্ষণ।
যাকে কোরানের ভাষায় বলা হয় তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি অর্থাৎ অন্তর পবিত্র করা।
আল্লাহ তালা বলেন, هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।
সুরা জুমুআহ = আয়াত, ২
ভাল বা মন্দ যেকোনোও কাজ করার আগে মানুষ তা করার ইচ্ছে করে অন্তরে। অন্তরই মানুষের এক প্রকার পরিচালক বলা যায়।
যাকে আরবীতে বলা হয় কলব قلب অন্তরের ইচ্ছেটাকেই পরে মানুষ কর্মে পরিণত করে। এই অন্তর যদি ভাল হয় তাহলে মানুষের কাজও ভাল হয় আর অন্তর যদি খারাপ হয় তাহলে মানুষের কাজও খারাপ হয়। হাদিসে এসেছে হযরত রসুলে করীম (সঃ)বলেন: الا إن فى الجسد مضغة إذا صلحت صلح الجسد كله وإذا فسدت فسد الجسد كله الا وهى القلب অর্থাৎ 'যেনে রাখো মানবদেহের মধ্যে একটা গোশতের টুকরা রয়েছে। যখন তাহা সংশোধিত ও বিশুদ্ধ হয়ে যায়, তখন গোটা শরীরই বিশুদ্ধ হয়ে যায়। আর যখন তাহা অপবিত্র বা অশুদ্ধ হয়ে যায়, তখন গোটা শরীরই অসুস্থ হয়ে যায়।
অতএব জেনে রাখো যে,তা হচ্ছে অন্তর। (সহি বুখারী, কিতাবুল ঈমান)
তাযকিয়া বলা হয় অন্তরের পবিত্রতাকে। অর্থাৎ মানুষের চিন্তা চেতনাকে নির্লজ্জতা আর দুনিয়াবি লোভ লালসা থেকে পবিত্র করে তাতে আখেরাতের ভয় আর আল্লাহর মুহাব্বাত সৃষ্টি করে দেওয়া। মানুষের স্বভাবে যে সব দোষ ত্রুটি থাকে, তাকে কিছু আমল এর মাধ্যমে বের করে দেওয়া বা নিয়ন্ত্রণ করা। যেমন রিয়া [লোক দেখানো ইবাদত] অহংকার, লোভ লালসা, দুনিয়ার মুহাব্বাত, হিংসা, কৃপণতা ইত্যাদি।
মানুষ সাধারণত নিজের দোষ নিজে দেখে না। তাই যে সমস্ত নেকার ব্যাক্তি তাঁদের অন্তরকে পবিত্র করেছেন তাদের সান্নিধ্যে এসে তাঁদের সহযোগিতায় তাযকিয়ার মাধ্যমে এসব দোষ ত্রুটি গুলো মন থেকে বের করে দিয়ে এই মনের মোড়কে হেদায়েত আর নেকীর দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারলে তখন সেই অন্তরে আল্লাহর ভয় সদা জাগ্রত থাকে। আখেরাতে হিসাব দেওয়ার কথা মানুষ আর ভুলে না। তখন সে পাপ কাজ থেকে এমন ভাবে দূরে থাকতে চায় যেভাবে মানুষ বিষাক্ত সাফ থেকে দূরে থাকতে চায়। রাতের অন্ধকারে যেখানে কেও তাকে দেখছে না সেখানেও পাপের উপকরণ থাকা সত্যেও তার মন পাপের দিকে যায় না।
সেখানেও সে আল্লাহর ভয়ে পাপ থেকে বিরত থাকতে পারে।
একারণে পবিত্র কোরানে তাযকিয়ায়ে নফসের ব্যাপারে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ তালা বলেন
قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّى নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয়
সুরা আ,লা= আয়াত ১৪
قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়।
وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا 10
এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।
সুরা- আশ-শামস= আয়াত ৯,১০
এই দুটি আয়াতের দিকে দৃষ্টি দিলে বুঝা যায় কল্যাণ আর সফলতা তাযকিয়ায়ে নফসের সাথে সম্পর্কিত।
দিল বা অন্তর পাক পবিত্র থাকলেই নেক কাজ করা যায়। যাতে নিহিত রয়েছে দুনিয়াবি ইজ্জত, মানসিক প্রশান্তি আর পরকালিন নেয়ামত, তথা জান্নাতের চিরস্থায়ী জীবন। সর্বোপরি আল্লাহ তালার সন্তুষ্টি।
আমরা জানি নবী নবী করীম (স.)এর আগমনের আগে আরব জাতি ছিল বর্বর, জুলুমবাজ, মানুষের ধন সম্পদ নির্দ্বিধায় লোট করত তারা এবং সব ধরণের অপরাধের সাথে জড়িত ছিল। কিন্তু নবী করিম সঃ সান্নিধ্যে আসার ফলে সাহাবায়ে কেরামের অন্তর পবিত্র হয়ে গিয়েছিল।
তাই তাঁরা জাহিলি যুগের সব অপরাধ ছেড়ে দিতে পেরেছিল মুহূর্তে এবং ইমান আনার সাথে সাথে আল্লাহ তালা তাঁদের অতীত পাপ গুলো মুছে দিয়েছিলেন। ফলে তাদের স্বভাবে এমন পরিবর্তন এসেছিল যে যারা এক সময় মানুষের ধন সম্পদ লোট করতো সেই তারাই নিজের খাবার অন্যের মুখে তুলে দিয়েছিল। পরোপকারিতা এবং মানব সেবার এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল যা ইতিহাসে বিরল।
ঘুষ আর দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করা যায় কিন্তু শান্তি অর্জন করা যায় না। অপরাধ আর অশান্তি একটা আরেকটার সাথে উৎপ্রোত ভাবে জড়িত।
যারা অপরাধ করে তারা মানসিক অশান্তিতে ভোগে। অপরাধ বোধ তাদের মনের শান্তি কেড়ে নেয়। আর যারা ন্যায় নীতি মেনে চলে তাদের অন্তরে শান্তি বিরাজমান থাকে। এছাড়া দুনিয়াতে শাস্তি হোক বা নাহোক আখেরাতে সব অপরাধের বিচার হবে। তখন অন্যায় ভাবে উপার্জিত সম্পদ কাওকে রক্ষা করতে পারবে না।
তবে যারা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে অন্তর পবিত্র করেছেন এবং অপরাধ ছেড়ে দিয়ে সৎ ভাবে জীবন যাপন করেছেন তারা আল্লাহ তালার কঠিন আযাব থেকে রক্ষা পাবেন। আল্লাহ তালা يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ ﴿٨٨﴾إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّـهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ ﴿٨٩﴾
অর্থাৎ 'যেদিন ধনবল ও জনবল কোন কাজে আসবেনা। শুধু কাজে আসবে আল্লাহ প্রদত্ত বিশুদ্ধ আত্মা। (শুরা শুআরাঃ ৮৮,৮৯) এতে সহজেই অনুমেয় যে,আত্মাকে বিশুদ্ধ করা কতটুকু প্রয়োজন।
পরিশেষে বলতে চাই আমরা যদি তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে অপরাধ আর দুর্নীতি করার ইচ্ছা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারি এবং আল্লাহ তালার কাছে পাপ পুণ্যের হিসাব দেওয়ার ভয় অন্তরে জাগ্রত রাখতে পারি তাহলে আমাদের দ্বারা অপরাধ করা আর সহজ হবেনা বরং ন্যায় নীতি মেনে চলা আমাদের পক্ষে অনেক সহজ হবে।
তখন দেশ উন্নতির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাবে আর মানুষের মধ্যে বিরাজ করবে স্বর্গীয় শান্তি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।