আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংসদে ও 'র'-আইএসআই টাকা কাহিন

আজ পহেলা এপ্রিল। মনে আছে বালক বেলায় এই দিন বন্ধু-বান্ধবদের 'এপ্রিল ফুল' করে বেশ মজা পেতাম। এখন ভাবি, ছিঃ! না জেনেশুনে কী খারাপ কাজই না করেছি তখন। সপ্তাহখানেক আগে আমার এক বয়ঃকনিষ্ঠ সাংবাদিক বন্ধু তার বিয়ের দাওয়াত দিয়ে বলল, তারিখটা নিশ্চয়ই মনে থাকবে_ 'এপ্রিল ফুলের' দিন। বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তার দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকলাম খানিকক্ষণ।

'এপ্রিল ফুল' নিয়ে তার বিভ্রমটা কাটিয়ে দেব যখন ভাবছিলাম, তখনই সে বিদায় নিয়ে ছুটে গেল আরেকজন বন্ধুর দিকে দাওয়াত কার্ড হাতে। বাংলাদেশে এখনো বালক-বালিকা বেলা পেরিয়ে আসছে অনেকের মধ্যেই এই বিভ্রম আছে। অথচ এই দিনটি শুধু একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই নয়, মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত জঘন্য অপরাধের এক ভয়ঙ্কর কালদিন। ইতিহাসের এক হৃদয়বিদারক ও নিষ্ঠুর প্রতারণার স্মৃতিবিজড়িত দিন এই পহেলা এপ্রিল। ঘটনাকাল ১৪৯২ সাল।

১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে এরাগনরাজ ফার্ডিন্যান্ড এবং ক্যাস্টাইলের রানী ইসাবেলার পরিণয়ের পর স্পেনে খ্রিস্টানরা শক্তিশালী হতে থাকে। মুসলমানদের মধ্যে দেখা দেয় বিশ্বাসঘাতকতা, সৃষ্টি হয় আত্দঘাতী ভ্রাতৃযুদ্ধ ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব। কর্ডোভা, সেভিল, ভেলেন্ত্রিয়া ইত্যাদি পতনের পর সম্মিলিত খ্রিস্টানশক্তি মুসলিম সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রস্থল গ্রানাডা রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। গ্রানাডার শেষ রাজা আবুল হাসানের পুত্র আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ (বুয়াবদিল নামে কুখ্যাত) এক যুদ্ধে বন্দী হয়ে ফার্ডিন্যান্ডের প্রতারণায় তারই সঙ্গে যোগ দিয়ে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ফার্ডিন্যান্ড-ইসাবেলার বন্ধুরাজ হিসেবে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি গ্রানাডা দখল করে ফার্ডিন্যান্ডের হাতে তুলে দেয়। এ কাজে তাকে সাহায্য করেছিল তার মা আয়েশা।

স্ত্রী ও সন্তানের বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজিত গ্রানাডারাজ আবুল হাসান ভ্রাতা আল জাগালের পক্ষে সিংহাসন ও রাজ্য ত্যাগ করেন। গ্রানাডা পতনের পর বিশ্বাসঘাতক বুয়াবদিলের মীরজাফরের মতো সিংহাসনে বসে পুতুল নবাব হওয়ার সুযোগ হয়নি। বৃত্তিভোগী হিসেবে সে বিতাড়িত হয়। কিন্তু খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে এলাকাভিত্তিক বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ চলতেই থাকে। বিজয়ী ফার্ডিন্যান্ড ঘোষণা করেন, দেশের মুসলিমরা অস্ত্র ত্যাগ করে ১ এপ্রিল (১৪৯২) মসজিদে আশ্রয় নিলে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে এবং অত্যাচারিত হবে না।

মসজিদে মসজিদে আশ্রয় গ্রহণকারী নিরস্ত্র প্রতারিত মুসলিমদের ওপর শুরু হয় পরিকল্পিত হামলা। মসজিদগুলোতে অগি্নসংযোগ করা হয়। প্রায় ৭ লাখ নর-নারী ও শিশু হত্যা করা হয়। অবশিষ্টরা ধর্মান্তরিত হয়ে আত্দরক্ষা করে। এ হত্যাকাণ্ড যদিও গ্রানাডার বড় বড় মসজিদে কামান দাগিয়ে অগি্নসংযোগ করে ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল শুরু করা হয়েছিল, একই নীতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে স্পেনের অন্যান্য শহর ও জনপদেও অনুসরণ করা হয়।

ওই প্রতারণার স্মৃতি হিসেবে পাশ্চাত্যে 'আনন্দ দিবস' হিসেবে 'এপ্রিল ফুল' পালিত হয় (সূত্র : ডায়েরি-২০০৯, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক)। মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত হৃদয়বিদারক ঘটনার কলঙ্কিত দিন মজা করার দিন হতে পারে না। কোনো নিরস্ত্র, শান্তিপ্রিয় অসহায় জাতির এ ধরনের বিড়ম্বিত ভাগ্য নিয়ে কৌতুক করা অশোভনই শুধু নয়, অন্যায়ও বটে। পহেলা এপ্রিল নিয়ে আমাদের দেশে এখনো যাদের মধ্যে বিভ্রম আছে, আশা করি তা কেটে যাবে, কেটে যাক। দুই আজ পহেলা এপ্রিল লেখাটা প্রকাশ হবে বলে আবেগাশ্রিত প্রসঙ্গটি শুরুতেই এসে গেল।

লিখতে যখন বসেছি, অনেকগুলো বিষয় সামনে চলে এলো। জাতীয় সংসদে 'কোল' ও নিষিদ্ধ পল্লীবিষয়ক কুরুচিপূর্ণ আলোচনা, শাসক দলের 'সাতশ ইঁদুর মেরে বিড়াল তপস্বী' ভাব, আইএসআই ও ভারতের বস্তা বস্তা টাকা কাহিনী এবং বিরোধী দলের আবার সংসদ বর্জন প্রসঙ্গ- কোনোটাই কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। জাতীয় সংসদ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। আমাদের জাতির পোড়া কপালে জোটা বর্তমান সরকারি ও সরকারবিরোধী নেতা-নেত্রীরাও এই সংসদকে কখনো মহান, কখনো পবিত্র বলে আখ্যায়িত করে তৃপ্তি বোধ করেন। সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু বলেও দাবি করে থাকেন।

তাই বলে শ্লেষ-বিদ্রূপ, অশ্লীল বাক্যবাণ হানা ও নারী সংসদ সদস্যদের প্রায় চুল ছেঁড়াছেঁড়িরও কেন্দ্রবিন্দু হবে সংসদ! ১৮ মার্চ প্রায় এক বছর ৭৭ কার্যদিবস পর সংসদে গিয়ে হুলস্থুল ফেলে দেয় বিএনপির দুজন নারী সংসদ সদস্য। সরকারি দলের নারী সংসদ সদস্যরাও পিছিয়ে ছিলেন না। এ যেন 'কেউ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান'। এটা খুবই নিন্দনীয় যে, জাতীয় সংসদ সদস্যরাই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে এর-ওর কোলে তোলার মতো কুৎসিত, অরুচিকর ও অসংসদীয় মন্তব্য করেছেন। বিরোধী দল বিএনপির দুই নারী সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে যা বলেছেন প্রিন্ট মিডিয়ায় তা অনেকটা হুবহুই ছাপা হয়েছে।

১৮ মার্চ প্রথম বিএনপির সংরক্ষিত আসনের এক সদস্য প্রধানমন্ত্রী কার কোলে চড়েছেন বলে প্রশ্ন তুললেই দারুণ হৈচৈ বেধে যায়। প্রধানমন্ত্রীকে কালনাগিনী, ডাইনি বলেও অভিহিত করা হয়। প্রধান বিচারপতিও ওই সংসদ সদস্যের বাক-সন্ত্রাস থেকে রেহাই পাননি। উত্তপ্ত পরিস্থিতির একপর্যায়ে সরকারি ও বিরোধী দলের দুই নারী সদস্যের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হয় বলে 'বাংলাদেশ প্রতিদিনে'ই খবর ছাপা হয় ১৯ মার্চ। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, পরদিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।

আবারও প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে অশোভন বক্তব্য দেন বিএনপির সংরক্ষিত আসনের আরেক নারী সদস্য। তার বক্তৃতা শুনে মনে হয়েছে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বলার চেয়েও তার আগের দিনের সহকর্মীর বক্তব্যকে ছাপিয়ে গিয়ে চ্যাম্পিয়নশিপ মেডেলটা নিজের গলায় পরতে চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, '১৯৮৬ সালে এরশাদের কোলে বসেছেন, লং ড্রাইভে গিয়েছেন। গোলাম আযমের কোলে বসে ছিয়ানব্বইয়ে ক্ষমতায় গিয়েছেন। সর্বশেষ মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের কোলে বসে ক্ষমতা দখল করেছেন।

... আর কার কার কোলে বসেছেন? একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে ২০ মার্চ মঙ্গলবার প্রকাশিত 'অশালীন বক্তব্যে সংসদ আবারও উত্তপ্ত' শিরোনামে প্রধান সংবাদে তার এ বক্তব্য ছাপা হয়। সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ জাতীয় সংসদে কেন, সংসদের বাইরেও এ ধরনের অশ্লীল বক্তব্য প্রদানে হাততালি দেওয়া তো দূরের কথা, কানে তুলো দিয়ে রাখবে। ১৮ মার্চের বক্তব্যের সময় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা সংসদে উপস্থিত ছিলেন। সবাই আশা করেছিলেন যে, এ ব্যাপারে বিরোধীদলীয় নেতা তার নিজ দলীয় সংসদ সদস্যকে সতর্ক করে দেবেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের বক্তব্য যাতে কেউ না দেন সে ব্যাপারে কড়া নির্দেশ দেবেন। কিন্তু হতবাক হয়ে সবাই লক্ষ্য করেছেন যে, পরের দিনের বক্তব্য ছিল আরও বেশি অশ্লীল।

তবে কি ধরে নিতে হবে যে, এমন বক্তব্য প্রদানকে উৎসাহিত করা হচ্ছে? এ ব্যাপারে যারা পারঙ্গম তারাই কি ছোট নেতা থেকে বড় নেতা, সংসদ সদস্য থেকে মন্ত্রী, ছোট মন্ত্রী থেকে আরও বড় মন্ত্রী হয়ে যাবেন? দুর্ভাগ্য এই জাতির! পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এর সঙ্গে যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। বিরোধীদলীয় নারী সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, এ ধরনের বক্তব্য নাকি নিষিদ্ধ পল্লীতেই শোনা যায়। ওই সংসদ সদস্য সম্পর্কে তিনি সংসদের মাধ্যমে জনগণকে কি ধারণা দিতে চেয়েছেন তা সহজ বোধ্য। তা অশ্লীল বাক্যবাণকেও ছাড়িয়ে যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে অভিযোগ করেছেন যে, ১৮ মার্চ বিরোধী দলের নারী সদস্যের বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেতা নাকি টেবিল চাপড়ে উৎসাহ দিয়েছেন।

অভিযোগ অবশ্যই আমলে নেওয়ার মতো। কোনো অবস্থাতেই এমন হওয়া উচিত নয়। তবে প্রধানমন্ত্রীরও উচিত ছিল 'নিষিদ্ধ পল্লী' প্রসঙ্গটি প্রত্যাহার করার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলা। সংসদের চলতি অধিবেশনের শেষ দিকের উত্তপ্ত ও অশ্লীল বাক্যবিনিময় নিয়ে মিডিয়ায় সরকারি কলেরগান যেভাবে 'সুর তুলেছে' তা কিন্তু রেকর্ডের একদিক। অন্য পিঠে কিন্তু অন্য সুর আছে।

১৮ ও ১৯ মার্চ 'কোল' প্রসঙ্গটি কেন এলো সংসদে? এর আগে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে কি উনাকে কোলে করে নিয়ে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে?' একাধিকবার তিনি এ কথা বলেছেন। এর আগে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে হানাদার বাহিনীর হাতে খালেদা জিয়ার বন্দীদশার বিড়ম্বিত ভাগ্য নিয়ে এই জাতীয় সংসদেই অশ্লীল ও কুরুচিকর মন্তব্য করা হয়েছে। সংসদের পবিত্রতা, বক্তব্যে অশ্লীলতা ইত্যাদি নিয়ে গত এক-দেড় সপ্তাহ যারা মিডিয়া কাঁপাচ্ছেন-ফাটাচ্ছেন, এর আগে কিন্তু তারা তা উপভোগ করেছেন। অথচ এ ধরনের অশ্লীলতা ও অসংসদীয় আচরণ সরকারি দল-বিরোধী দল যারাই করুন সবাই সমানভাবে তিরস্কৃত হওয়া উচিত। অনেকে স্পিকারকে অনুরোধ করেছেন সংসদের কার্যবিবরণী থেকে অসংসদীয়, অশ্লীল বক্তব্য এঙ্পাঞ্জ করার জন্য।

আমি মনে করি, তার চেয়েও ভালো হয়, প্রধানমন্ত্রী হোন আর বিরোধীদলীয় নেতা হোন, সরকারি দলের সংসদ সদস্য হোন আর বিরোধী দলের সংসদ সদস্য হোন, সংসদে প্রদত্ত অশালীন অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ ও অসংসদীয় বক্তব্য তারা নিজেরাই প্রত্যাহার করে নেবেন এবং জাতির কাছে এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না হোক, অন্তত দুঃখ প্রকাশ করবেন। কিছুদিন ধরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই'র কাছ থেকে ১৯৯১ সালে পাঁচ কোটি টাকা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করেছিলেন বলে খুব প্রচার করছে শাসক দল। খোদ প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী-মিনিস্টার-সংসদ সদস্য ও দলীয় নেতারা এ অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে পাকিস্তানের দালাল অভিহিত করে চলেছেন অব্যাহতভাবে। বেগম জিয়ার উদ্দেশে এমনও বলা হচ্ছে, 'যে দেশের টাকা খান, সে দেশে চলে যান। ' প্যাক করে তাকে পাকিস্তানে পার্সেল করে দেওয়া হবে বলেও বলা হচ্ছে।

জাতীয় সংসদেও এই অভিযোগ আনা হয়েছে। বিএনপি এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশে এ কুকর্মের হোতা দৈনিক প্রথম আলো ও দুবাই থেকে প্রকাশিত খালিজ টাইমসের কাছে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। ২৫ ও ২৬ মার্চ ২০১২ খালিজ টাইমস ও প্রথম আলোর কাছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই প্রতিবাদলিপি পাঠান। প্রথম আলো স্বীকার করেছে যে, প্রকাশিত প্রতিবেদনটি তাদের নিজস্ব অনুসন্ধান বা সূত্রে পাওয়া নয়। তবে কি খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে গভীর সংকটে নিমজ্জিত লীগ সরকারকে স্যালভেজ করার জন্যই প্রথম আলো এ কাজটি করেছে? দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত এক সংবাদ মাধ্যমের খবর অন্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা সাংবাদিকতার একটি স্বীকৃত চর্চা বলেই যাচাই-বাছাই ও সঠিক অনুসন্ধান ছাড়া দেশে-বিদেশে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার মতো খবরও কি ছাপা যায়? নিজ দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দুবারের বিরোধীদলীয় নেতা ও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে তেমন একটি খবর অনুসন্ধান ছাড়াই কি কোনো দায়িত্বশীল পত্রিকা ছাপিয়ে দিতে পারে? পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে পুরো অভিযোগটিকে সুস্পষ্ট ভাষায় ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করে।

যার বরাত দিয়ে এ ধরনের একটি মুখরোচক খবর ফলাও করে প্রচারে ছেড়ে দেওয়া হয়, আইএসআই'র সেই সাবেক প্রধান জেনারেল (অব.) মাসুদ দুররানিও অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন। গত ২৫ মার্চ রবিবার বিবিসিকে দেওয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে দুররানি বলেন, পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টে প্রদত্ত হলফনামায় বিএনপিকে এ ধরনের অর্থ প্রদানের কথা তিনি বলেননি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট ২৬ মার্চ জেনারেল দুররানির সাক্ষাৎকারটি ছেপেছে। তাতে বলা হয়, 'Durrani described the allegation as complately baseless and fabricated. General Durrani told BBC that the did never speak about such funding ho RNP During his submission to the Pakistan supreme court.' বিএনপিকে আইএসআই'র অর্থায়নের অভিযোগটি ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গেই বিএনপি নেতারা গত ৩০ জুলাই ২০১১ আমেরিকার মর্যাদাশীল সংবাদ ম্যাগাজিন 'ইকনোমিস্ট'-এ প্রকাশিত ভারতের বস্তা বস্তা টাকা ও সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে বলে সংবাদের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র'-এর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ এনেছে।

কোনো পক্ষ থেকেই এর জোরালো প্রতিবাদ করা হয়নি। ২০১১ সালের ৫ আগস্ট সরকারের একটি সাধারণ প্রতিবাদ পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে ছাপা হলেও মূল ম্যাগাজিনে তা প্রকাশ করা হয়নি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পত্রিকাটির কাছে খালিজ টাইমসের কাছে বিএনপির প্রতিবাদের মতো কড়া প্রতিবাদ জানানো এবং মূল ম্যাগাজিনে তা ছাপানোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। সংবাদটি অসত্য তথ্যনির্ভর হলে আওয়ামী লীগ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে যেতে পারত। তাতে এ ব্যাপারে জনগণের মধ্যে তখনো বিদ্যমান সব বিভ্রান্তি ও সন্দেহ দূর হতো।

দেশের ও জনগণের নানাবিধ সমস্যা এবং তা সমাধানের ব্যাপারে সংসদে আলোচনা না করে কে কার টাকা খান, কে কার দালাল_ এসব আলোচনায় মানুষ বিরক্ত। সরকারি ও বিরোধী দলের বর্তমান নেতৃত্বের তা অনুধাবন করা উচিত। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, আমাদের দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলে রাজনীতি ও আদর্শের কোনো চর্চা নেই। আছে পরচর্চা ও ক্ষমতার চর্চা। দল পরিচালনা ও নেতৃত্ব কর্তৃত্ব থেকে প্রকৃত রাজনীতিবিদরা বিতাড়িত।

বড় দুই দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের পছন্দ-অপছন্দ, কাউন্সিলের মতামত কোনো কিছুকে আমলে না নিয়ে দুই নেতার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেখায় বড় বড় পদাধিকারীরা নিযুক্ত হন এবং নেত্রীদের এবং তাদের ছেলেমেয়ে এমনকি নাতি-নাতনিদের বিরাগভাজন হয়ে কখন পত্রপাঠ বিদায় হন এ আতঙ্কেও ভোগেন। সাবেক আমলাদের 'ছু মন্তর ছু' এবং অস্ত্রবাজ-পেশিবাজদের ধাক্কাধাক্কিতে চলছে দল। সন্ত্রাসের তালিকায় এখন বাক-সন্ত্রাসও যুক্ত হয়েছে। রাজনীতিতে এসবের অবসান না ঘটলে বা ঘটানো না গেলে জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ভূমিকা আশা করা যাবে না। যারা তা করতে চান, তারা তা করতে পারবেন না।

পরের সংসদে মনোনয়নই পাবেন না। কিন্তু এভাবে আর কতদিন... কতকাল...? তিন ১৮ মার্চ বিএনপি সংসদে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু চলতি অধিবেশনের শেষদিন তারা আর সংসদে যায়নি। খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও বিএনপি সম্পর্কে অশ্লীল, আপত্তিকর ও আইএসআই'র কাছ থেকে টাকা নেওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীসহ শাসক দলের অন্যান্যের বক্তব্য সংসদ প্রসিডিংস থেকে এঙ্পাঞ্জ করার দাবিতে তারা সংসদ অধিবেশনে যোগ দেননি বলে জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ। বিরোধী দলের অসংসদীয় বক্তব্য এঙ্পাঞ্জ করা হলে একই ধরনের সরকারি দলের বক্তব্যও এঙ্পাঞ্জের দাবি অযৌক্তিক নয়।

বিশেষ করে আইএসআই'র কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ভিত্তিহীন অভিযোগটি তো এঙ্পাঞ্জ করা যেতেই পারে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার তথ্য সহকর্মীরা বলছেন, সদস্যপদ বহাল রেখে বেতন-ভাতা খাওয়ার জন্যই বিরোধী দল সংসদে এসেছিল। এটা অনেকটা এক বুড়ি আরেক বুড়িকে নানি ডাকার মতোই হয়ে গেল। এখনকার সরকারি দলও বিরোধী দলে থাকতে একই কাজ করেছে। পঞ্চম সংসদের হিসাবটা হাতের কাছেই আছে।

অধিবেশন শুরু হয় ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল ৭ এপ্রিলই ওয়াক আউট করে। সেই সংসদে বিরোধী দল বাষট্টি বার ওয়াক আউট ও আট বার সংসদ বর্জন করে। তারা শেষ সংসদ ছাড়েন ১৯৯৪ সালের ১ মার্চ এবং জামায়াত ও জাপাকে নিয়ে একযোগে পদত্যাগ করেন ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর। দীর্ঘদিন সংসদে অনুপস্থিত থাকাকালে বিদেশ ভ্রমণ, ডিউটি ফ্রি গাড়ি, বেতন-ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধার ষোলআনাই ভোগ করেছেন।

অষ্টম সংসদেও তারা একই কাজ করেছেন। এ খারাপ ও অনৈতিক প্রবণতা দুই দলেই সমান বিদ্ধমান। এ প্রবণতা ত্যাগ করা উচিত। ওয়াক আউট সংসদীয় সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু অবিরাম বর্জন সমর্থনযোগ্য নয়।

জনগণ প্রদত্ত দায়িত্ব সংসদে গিয়েই পালন করা উচিত। সংসদের ভেতরে-বাইরে দুই জায়গায়ই তো লড়াই করা যায়। সংসদে না গেলে তরুণ সংসদ সদস্যরা অভিজ্ঞতা লাভ করবে কীভাবে? সংসদাচার শিখবেন কি করে? গালিগালাজ, অশ্লীল কথাবার্তা যে সংসদীয় সংস্কৃতির রীতিবিরুদ্ধ, তরুণরা তা জানবে কি করে? অজ্ঞতার জন্য তরুণদের দোষারোপ করে কি লাভ? কাজী সিরাজ লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ই-মেইল : Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.