আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আধুনিক সাংগঠনিক কাঠামো ও জনবলের অভাবে অচল হয়ে পড়েছে বন বিভাগ।

নিরাপদ ও বাসযোগ্য পৃথিবী চাই। জাতীয় বন রক্ষায় অবহেলা জাতির জন্য বুমেরাং হবে। জাতীয় বন রক্ষায় অবহেলা জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে। মানব সভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে বিশ্ব জুড়ে আজ বন ও পরিবেশ রক্ষার জন্য মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠছে। বিশেষতঃ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন জনিত জলবায়ুর ক্রম পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও বিজ্ঞানীগণ উদ্বিগ্ন।

চলছে নানা গবেষণা,তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ। হচ্ছে নানা সভা, বৈঠকও সম্মেলন। গৃহীত হচ্ছে অনেক সিদ্ধান্ত, প্রটোকল ও চূক্তি। বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব সমাজ। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হবে বাংলাদেশ ও এর জনগোষ্ঠী।

বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক এসব উদ্দ্যোগের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করছে। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলার জন্য, বাংলাদেশের বিশাল এলাকা সমুদ্র গর্ভ থেকে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষার জন্য, কার্বন সিন্ক হিসাবে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় বনাঞ্চল রক্ষা ও সমৃদ্ধ করা যেখানে অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে সেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বনের প্রতি খোদ সরকারের কোন নজর আছে বলে মনে হয় না। ১৮৬২ সনে গঠিত প্রাচীনতম সরকারী বিভাগ সমূহের একটি বাংলাদেশ বন বিভাগ মান্ধাতা আমলের সাংগঠনিক কাঠামো আর সক্ষমতা দিয়ে মাত্র দশ হাজার জনবল দিয়ে প্রায় ৪৪ লক্ষ একর রাষ্ট্রীয় বনাঞ্চল এবং চরাঞ্চলে সৃজিত ৩ লক্ষ একর বনাঞ্চল রক্ষা করার প্রানন্তকর হাস্যকর চেষ্টা করেই যাচ্ছে বন বিভাগ। এছাড়া আছে প্রায় ৮,০০০ কিলোমিটার সড়ক, সংযোগ সড়ক, রেলপথ, বেড়ীবাঁধ এর বন বাগান প্রহরা ও রক্ষণাবেক্ষণ। বাংলাদেশের কমপক্ষে এক দশমাংশ ভূমির ব্যবস্থাপনার বিশাল বোঝা কাঁধে নিয়ে নূজ্ব্য হয়ে পড়েছে আর শুধু সমালোচিতই হয়েছে।

কিন্তু সমস্যা সমূহ নির্ণয়ে ও সমাধানে কোন সরকারই এগিয়ে আসে নি। কোন উদ্দ্যোগও নেয় নি। এভাবে দোষ আর বোঝা চাপিয়ে নির্বিকার চলতে থাকলে যেমনি রাষ্ট্রীয় বনভূমি ক্রমাগত ভূমিদস্যুদের ও ভূমিহীনদের (রাজনৈতিক আচ্ছাদনে) দখলে চলে যাবে তেমনি বন তথা প্রকৃতির আচ্ছাদন উজাড় হয়ে মাটির গুনগত মান ও উর্বরা শক্তি হারাবে। ছড়া, খাল, জলপ্রবাহ শুকিয়ে গিয়ে সাংবাৎসরিক জলপ্রবাহ কমে যাবে। বৃষ্টিপাতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে।

অল্প বৃষ্টিতেই বন্যা হবে। কৃষিভূমিতে প্রয়োজনের সময় জল সরবরাহ থাকবে না। মাটির জল স্তর নেমে যাবে, খাল , ছড়া সমূহ উপচে কৃষিভূমিতে বালু পড়বে, সমুদ্রের লোনা পানি অভ্যন্তরীন নদী, খাল, বিল সমূহে ঢুকে পড়ে সামগ্রিকভাবে কৃষিভূমি চাষাবাদের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে এর লক্ষণ ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ এলাকায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করে নীচতলা রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে ক্রমশঃ বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ছে।

হালদা নদীতে পর্যন্ত লবণাক্ততা প্রবেশ করেছে। ভবিষ্যতে সাহারা কিংবা হরপ্পা মহেনজাদাড়োর মত এ জাতি বিলীন হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে বিদগ্ধজনেরা আশংকা প্রকাশ করছেন। পরিবেশ সচেতন জনগণের দাবী অতি সত্বর সরকারের উচিত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগটির প্রতি নজর দেওয়া। শুধু বন বিভাগকে নয় এখন এ দায়িত্ব সকলকেই নিতে হবে বলে সুধীজন মতামত ব্যক্ত করেন। মাত্র ১৩০ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়ে গঠিত এ ছোট্ট প্রশাসনিক কাঠামোর বন বিভাগ জাতীয় বন রক্ষার মাধ্যমে একই সাথে জীব বৈচিত্র রক্ষা, শিক্ষা গবেষণা, চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থার পাশাপশি সাস্টেইনেবল ফরেষ্ট ম্যনেজমেন্টের আওতায় নিয়মিত বনজদ্রব্যের উৎপাদনের মাধ্যমে জাতীয় চাহিদা মেটানো , বনজদ্রব্যভিত্তিক শিল্পকারখানা বিশেষ করে কর্নফুলী পেপার মিল, খুলনা হার্ড বোর্ড মিলের কাঁচামাল সরবরাহ সহ জাতীয় আয় বৃদ্ধি এবং সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে দারিদ্রতা বিমোচনে অবদান রাখছে।

সুন্দরবন এবং উপকূলীয় বন বিভাগ সমূহ সৃজিত উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন উপকূলজুড়ে শেল্টার বেল্টের মত অভ্যন্তরীন জান মাল রক্ষায় যেমনি ব্যাপক ভূমিকা রাখছে তেমনি চরভূমির স্থায়ীত্ব প্রদানের মাধ্যমে দেশের আয়তন ক্রমশঃ বৃদ্ধি করে চলেছে। বন বিভাগের কাজের বিস্তৃতি ও ক্ষেত্র ক্রমেই বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সহ বাঘ, পাখী, হাতী তথা নানাবিধ বন্যপ্রাণী রক্ষা, বোটানিক্যাল গার্ডেন,ইকোপার্ক, সাফারী পার্ক সহ বিভিন্ন স্যাংচুয়ারী, অভয়াশ্রম এবং প্রটেকটেড এরিয়া ব্যবস্থপনার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সেই একই জনবল নিয়ে বন বিভাগকে চালিয়ে যেতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মত জনসংখ্যাক্লিষ্ট দেশে ঘরবাড়ী রাস্তাঘাট, কলকারখানা নির্মাণ,লবণ ও চিংড়ী ঘের সম্প্রসারণ সহ সকল উন্নয়নমূলক কাজের চাপ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বনভূমির উপর এসে পড়ে। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ফলে ধ্বংস হয়ে গেছে কক্সবাজারের বনাঞ্চল।

জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক লবণ ও চিংড়ী ঘের বন্দোবস্তী দেওয়ার ফলে ঐতিহ্যবাহী এবং বাস্তু'তান্ত্রিক দৃষ্টিকোণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ চকোরিয়া সুন্দরবনের আজ চিহ্নটুকু নেই। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সরকারের আমলে রাজনৈতিক চাপ। বন বিভাগের ভূমি সমূহের সীমানা জরীপ নাই। সীমানা পিলার নেই। কাঁটা তারের বেড়া বা কোনরূপ ঘেরা বেড়া নেই।

বাংলাদেশের এক দশমাংশ ভূমির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত বন বিভাগে কোন ভূমি শাখা বা রেকর্ড শাখা নেই। প্রকৌশল শাখাও নেই। অথচ বাংলাদেশ রেলওয়ে সহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ও এ বিভাগটি আছে। রেকর্ডপত্র উত্তোলন, রেকর্ড সংশোধন এবং মামলা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইনজীবি, প্রশিক্ষিত জনবল, অফিস ব্যয় বরাদ্দ নেই। অতি মূল্যবান ভূমি আগলে রাখার পাশাপাশি নুতন বন সৃজন, রক্ষণাবেক্ষণ, বন ও বনভূমি নিয়মিত প্রহরা দেওয়া, বন অপরাধ দমন, আসামী ধরা, মামলা লিখা, আসামী চালান করা, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া, জব্দকৃত ও বিভাগীয় পর্যায়ে আহরিত বনজদ্রব্য পরিবহন, বিক্রয় করা, বিভিন্ন বনজদ্রব্য যেমন মাছ, মধু, মোম, বালু, পাথর, লতা, পাতা, ছন, বাঁশ, কাঠের রাজস্ব আদায় করা, সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী নিয়োগ, উপকারভোগী প্রশিক্ষণ, বনের ছোটখাট প্রকৌশল কাজ করা ও তদারক করা, জরীপ করা, বৃক্ষমেলার আয়োজন, সড়ক বনায়ন, প্রতিষ্ঠান বনায়ন ইত্যাদি নানাবিধ কাজ করতে হয়।

সামান্য জনবল ও যানবাহন নিয়ে প্রায় ক্ষেত্রে বন ও বনভূমি ধ্বংসের অপতৎপরতা ও বেআইনী কর্মকান্ড বন বিভাগ রোধ করতে পারছে না। নিজেরা বারবার আক্রান্ত হচ্ছে, আহত/নিহত হচ্ছে এবং থানা পুলিশ ও প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্থানীয় ভূমি প্রশাসন সমূহ বনভূমি লীজ দেওয়ার/ বন্দোবস্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারী সিদ্ধান্তও মানছেন না। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে এইরূপ অসংখ্য প্রতিবেদন দাখিল করা আছে যা সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়। রক্ষিত বন সমূহ এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কর্তৃক বন আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত বনের জন্য ঘোষিত চর এলাকার নোটিফিকেশনকৃত ও বনায়নকৃত ভূমিও লীজ/বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়কে গুরুত্বতো দেনই না এমনকি খোদ ভূমি মন্ত্রনালয়ের সার্কূলার/ সিদ্ধান্ত / নির্দেশনাও মাঠ পর্যায়ের ভুমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিতগণ মানছেন না। সরেজমিন অনুসন্ধানে এমনটিই দেখা যায়। স্বাধীনতা উত্তরকালে বিশেষত ১৯৮২ সনের পর থেকে বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো ব্যাপকভাবে বিন্যস্ত করা হয়। পূর্বে যেখানে একটি থানায় একজন সার্কেল অফিসার, পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে ছিলেন একজন সাব ইন্সপেক্টর, ছিলেন থানা কৃষি কর্মকর্তা আর ওভারশিয়র ছিলেন প্রকৌশল কর্মকর্তা। বর্তমানে সেখানে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কৃষি বিভাগে কয়েকজন প্রথম শ্রেনীর সিনিয়র কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকৌশলী সহ কয়েক ডজন সরকারী কর্মকর্তা নিয়োজিত।

শিক্ষা বিভাগেই আছেন কয়েকজন কর্মকর্তা। আছেন যুব বিষয়ক, মহিলা বিষয়ক, সমাজকল্যাণ বিষয়ক নানা কর্মকর্তা। অথচ বন বিভাগে আনা হয়নি কোন পরিবর্তন। ৪৭ লক্ষাধিক একর বনের বিপরীতে ফরেষ্ট গার্ডের মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা ২৪৭৭ জন। ফরেস্টার এর সংখ্যা ১১২৯ জন, ফরেস্ট রেঞ্জারের মঞ্জুরীকৃত পদ ৪০৩ জন।

এর মধ্যেও গড়ে ৩০% পদ শূণ্য। দেশে উপজেলার সংখ্যা প্রায় ৫০০ টি। একজন কর্মকর্তা কর্মচারীর পক্ষে ২৪ ঘন্টা ডিউটি করা বা কায়িক শ্রম প্রদান সম্ভব নয়। যদি মঞ্জুরীকৃত সকল পদই ধরা হয় এবং একজন ফরেষ্ট গার্ডের ২৪ ঘন্টা ডিউটি পিরিয়ড ধরা হয় তাহলে প্রতিজন ফরেষ্ট গার্ড ১৮০০.০ একর বনভূমি প্রহরার দায়িতপ্রাপ্ত্ব। প্রতি ফরেস্টার তথা বিট কর্মকর্তার বিপরীতে ৩৫০০.০ একর।

ফরেষ্ট রেঞ্জারগণের মধ্যে কমপক্ষে কমপক্ষে ৯৫ জনকে সারাদেশে বিভিন্ন আদালতে বনমামলা পরিচালক হিসাবে, উপজেলা নার্সারী ও প্রশিক্ষণ কেন্দের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে, ফরেষ্ট্রি সাইন্স এন্ড টেকনোলজী ইন্সটিটিউট সমূহে প্রশিক্ষক হিসাবে এবং বিভিন্ন ডিপো ও স্টেশনের দায়িত্বে কাজ করতে হয়। বাকী ২৫৫ জন ফরেষ্ট রেঞ্জার রেঞ্জ অফিসার হিসাবে নিয়োজিত থাকেন যার প্রতি জনের বিপরীতে আছে গড়ে ১৯০০০.০ একর বনাঞ্চল এর দায়িত্ব। বনজসম্পদ সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ অবস্থা আরো ভয়াবহ। চট্টগ্রাম, বান্দরবান এবং কক্সবাজার জেলার ৭ টি বন বিভাগ নিয়ে গঠিত এ অঞ্চলের ৯লক্ষ ৩০ হাজার একর বনাঞ্চলে নিয়োজিত আছেন মাত্র ৪ শত বন প্রহরী। ২৪ ঘন্টা ডিউটি ধরা হলেও প্রতি জন বনপ্রহরীর প্রহরার আওতায় আছে গড়ে ২৫০০ একর বনভূমি।

নুতন ফরেষ্ট গার্ড নিয়োগ দীর্ঘকাল বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে কর্মরত ফরেষ্ট গার্ডগণের অধিকাংশের চাকুরী ২০-৩৫ বছর। ফরেষ্টার নিয়োগ বন্ধ। অনেক বিটে ফরেষ্ট গার্ডগণ বিট কর্মকর্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। অথচ তাদের পদোন্নতিও দেওয়া হচ্ছে না।

পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে অনেকেই অবসরে চলে যাচ্ছেন। প্রতিনিয়ত লোকবল কমে যাচ্ছে। অথচ নুতন নিয়োগ নেই। পদোন্নতিও নেই। বনপ্রহরার জন্য জনবলতো নেই পাশাপশি নেই যানবাহন, আধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম।

একটি রেঞ্জের বনভূমির আয়তন ১০-৩০ হাজার একর। এখানে দ্রুত টহলের জন্য একটি পিকআপ দরকার কিন্তু অনেক রেঞ্জে বা বিটে কোন মোটর সাইকেলও নেই। কোথাও থাকলেও ইহজীবনে তার জ্বালানীর জন্য এক পয়সাও দেওয়া হয় না। ফরেষ্ট গার্ডদের পায়ে হেঁটে, সি.এন.জি বা বাসে চড়ে টহলে যেতে হয়। ফলে টহলের কোন গোপনীয়তা বা কার্যকারিতা থাকে না।

গাছ চোর ও ভূমি দস্যুরা আধুনিক যানবাহন, মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে সামান্য কয়েকজন বন কর্মীর অবস্থান সহজে জেনে যায় ও নজরদারি করে থাকে। ভূমির মূল্য দিনে আকাশচুম্বি হচ্ছে আর সবার হিংস্র থাবা পড়ছে বনভূমির উপর। ঢাকা, ময়মনিসংহে বন কর্মকর্তা কর্মচারীরা কোনভাবে আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না। দেশের সেরা শিল্পপতি আর ভূমিদস্যুরা সেখানে প্রতিপক্ষ। অসহায় বন বিভাগ।

ওভারটাইম বিল নাই, ঝুকি ভাতা নাই। ২৪ ঘন্টা এটেনশন থাকতে হয়। বাগানে গাছচুরি, জবর দখল বা অগ্নিসংযোগের কোন টাইম টেবল নাই। কাজেই বন কর্মীদেরও চাকুরীর কোন টাইম টেবল নাই। থানায় পুলিশগণ ৮ ঘন্টা শিফটিং ডিউটি করে থাকে।

বন বিভাগের বন কর্মীদের শিফট করার অবকাশ নাই। ২৪ ঘন্টায় তাদের ডিউটি। টহল করে এসে বিশ্রাম নেওয়ার মত কোন ঘরবাড়ীও নাই। সুন্দরবনে থাকতে হয় নৌকায়। সেখানে রয়েছে জলদস্যুর আক্রমণ।

পানি কিনে আনতে হয়। পার্বত্য এলকায় রয়েছে নানা পার্বত্য সন্ত্রাসী গ্রুপের চাঁদাবাজি ও আক্রমন। আছে প্রাণঘাতি ম্যালেরিয়া। দেখা গেছে ম্যলেরিয়ায় গুরুতর আক্রান্ত কোন আর্মি সেপাইকে থানচি থেকে হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একজন ম্যালেরিয়া আক্রান্ত ফরেষ্ট গার্ড সেখানেই মারা গেল।

হাটহাজারী রেঞ্জের সর্তা বিটে পার্বত্য শান্তিবাহিনী নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে বিট কর্মকর্তা মির্জা আমিনুল হক এবং বন প্রহরী এয়ার আহমদকে। তাদের অসহায় পরিবারের প্রতি সরকার বা বন বিভাগ নূন্যতম দায়িত্ব পালন করে নি। খোঁজ খবরও নেয় নি। বন বিভাগের মাঠ পর্যায়ে গুরুত্বপুর্ণ ইউনিট হলো বিট অফিস। একটি বিটের অধীনে ২ থেকে ১০ হাজার একর পর্যন্ত বনাঞ্চল থাকে।

সেখানে কর্মরত থাকে একজন বিট কর্মকর্তা এবং ২ জন বা একজন ফরেষ্ট গার্ড। গড়ে ১.৫ জন ফরেষ্ট গার্ড। কিন্তু অনেক বিটের অফিস ঘর পর্যন্ত নেই। উপকূলীয় বন বিভাগ চট্টগ্রামের বড়দিয়া বিট অফিসটি বাজারের একটি ছোট্ট দোকান ভাড়া করে করতে দেখা গেছে। মহেশখালীর কেরণতলী বিট অফিসটি দীর্ঘ ১২ বছর একটি পরিত্যক্ত স্কুল গৃহে ছিল।

বর্তমানে সেখানে একটি গার্ড ব্যারাক করে সেখানেই অফিস সেখানেই বিট অফিসার ও স্টাফগণ অবস্থান করেন। চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত কাট্টলী এবং বন্দর বিট অফিস ২টি যে কেউ সরেজমিনে দেখে আসতে পারেন। সেগুলি কোন পরিত্যক্ত পাখীর বাসার মতই প্রতীয়মান হযেছে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের কালিপুর রেঞ্জের কালিপুর সদর বিট, বারবাকিয়া রেঞ্জের টৈটং বিট এবং চুনতি রেঞ্জের সাতগড় বিট এবং চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের শোভনছড়ি বিট, রাউজানঢালা বিট, দাঁতমারা বিট, বালুখালী বিট, কয়লা বিট, হিঁয়াখো বিট সমূহ সরেজমিনে ঘুরে এসে দেখা যায় যে সেখানে অফিস করা, অস্ত্র রাখা বা বসবাস করার মতো কোন অবস্থা নেই। যে সমস্ত অফিসে ২/১ টি পুরাতন জরাজীর্ণ টিনশেড বাসা আছে সেগুলিতে না আছে ফেমিলি ফেন্সিং বা বেড়া, না আছে পানি সরবরাহ বা পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা।

বিট অফিস এবং রেঞ্জ অফিস সমূহে আসামী রাখতে হয়। জব্দকৃত যন্ত্রপাতি, যানবাহনের মুল্যবান অংশ, মেশিনপত্র, কখনোবা মূল্যবান জব্দকৃত কাঠ, দা, কুড়াল, করাত, নার্সারী যন্ত্রপাতি ইত্যাদি রাখতে হয়, আগ্নেয়াস্ত্রও রাখতে হয়। কোন অস্ত্রাগার নেই এমনকি ষ্টীল আলমারীও নেই। এরূপ অবস্থায় ঐ ঘরের বিদ্যুৎ বিল ও বাসা ভাড়া বাবদ টাকা সংশ্লিষ্ট ফরেষ্ট গার্ড, বিট কর্মকর্তা ও রেঞ্জ কর্মকর্তাগণের বেতন থেকে কেটে নেওয়া হচ্ছে মর্মে সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়। বন কর্মীদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়।

পরিবার পরিজনকে অন্যত্র বাসা ভাড়া করে রাখতে হয়। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশাও পরিলক্ষিত হয়। একটি আধুনিক ও যুগপোযোগি বন বিভাগ গঠনের ব্যাপারে বর্তমান জনবল ৫ গুন বৃদ্ধি করা, প্রথম শ্রেনীর উপজেলা ফরেষ্ট অফিসার নিয়োগ সহ ১২ দফা দাবী দীর্ঘদিন যাবত জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ বন কর্ম নির্বাহী সমিতি। সে দাবীর যৌক্তিকতা স্বীকার করে সরকার বারবার তা পূরণের আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত কোন অগ্রগতি হয়নি। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৭ সনে বন বিভাগে উপজেলা ফরেস্ট অফিসার নিয়োগের নির্দেশ প্রদান করেন।

১৪ বছর পর বন বিভাগের অর্গানোগ্রাম পূনর্গঠনের একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হলেও তা ফাইলবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে বলে জানা যায়। জাতীয় বন এ দেশের জনগণের বন। এ দেশের স্বার্থে, আগামী প্রজন্মের স্বার্থে এ বনকে টিকিয়ে রাখতে হবে ও সমৃদ্ধ করতে হবে। বন বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। বাস্তবতার আলোকে মত বিনিময় বা বৈঠক করে, বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও যাচাই করে অবিলম্বে এ ব্যাপারে সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন।

সংশ্লিষ্ট মহলের অবহেলা, উদাসীনতা ও নির্লিপ্ততার পরিণাম জাতির জন্য ভয়াবহ হতে পারে বলে সকলেই আশংকা প্রকাশ করছেন। অপরদিকে বছরের পর বছর পদোন্নতি না হওয়ায় বন কর্মীগণ হতাশায় নিমজ্জিত। বিশেষতঃ ফরেষ্ট গার্ডগণ একই পদে ২০-৩০ বছর চাকুরী করে শ্রম দিয়ে জীবনের সবটুকু সময় অতিবাহিত করেও কোন পদোন্নতি পাচ্ছেন না। বিট ও রেঞ্জ অফিসে কাগজ, কলম, আসবাবপত্র, আসামী ধরা, আসামী চালান দেওয়া, আসামীদের খাওয়া বাবদ কোন ব্যয় বরাদ্দ নেই। ওভারটাইম বিল নেই, ভ্রমন ভাতা নেই।

ফরেষ্ট গার্ড, ফরেষ্টারগণ বিভিন্ন জেলায় বা উপজেলার আদালতে গিয়ে বনমামলার সাক্ষ্য দিয়ে আসেন নিজের বেতনের টাকা দিয়ে। বিভিন্ন সময়ে ঝুকিপূর্ণভাবে দায়িত্বপালন করতে গিয়ে অনেক বন কর্মী আহত ও নিহত হয়েছেন। তাদের পরিবার সরকার থেকে কোন ক্ষতিপূরণ পায় নি এমনকি তাদের পরিবারের খোঁজ খবরও কেউ রাখে না। বাংলাদেশ বন প্রহরী কল্যাণ সমিতি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক জালাল আহমদ এ ব্যাপারে গভীর দুঃখ ও হতাশা ব্যক্ত করে বলেন অবিলম্বে এ দূরাবস্থার অবসান করে ফরেষ্ট গার্ডদের অবিলম্বে পদোন্নতি, রেশন. ঝুঁকিভাতা এবং কর্তব্যকালে আহত নিহতগণের ক্ষতিপূরণ ও ঐ পরিবারের একজন সক্ষম পোষ্যকে চাকুরীতে নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বন বিভাগে কর্মরত ফরেষ্টারগণ ফরেষ্ট্রি সাইন্স এন্ড টেকনোলজী ইনষ্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন ফরেষ্ট্রি প্রাপ্ত।

কারিগরী শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সমমানের প্রকৌশল ডিপ্লোমাপ্রাপ্তগণ ১০ নং গ্রেডে দ্বিতীয় শ্রেনীর গেজেটেড কর্মকর্তার বেতন ও পদমর্যাদা পেলেও বন বিভাগে পান নি। বরং গত ২৫ বছর যাবত এ আশায় তাদেরকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ১৯৮২ সনের পূর্বে থানায় পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বেতন স্কেল ফরেষ্ট রেঞ্জার পদটির চেয়ে নীচে ছিল। এখন ইন্সপেক্টর তথা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পদটি প্রথম শ্রেণীর করা হলেও ফরেষ্ট রেঞ্জারের পদটি করা হয় নি। ফলে এ নিয়ে ব্যাপক হতাশা বিরাজ করছে।

উপজেলার বিভিন্ন মিটিং ও কার্যক্রমে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ডাবল ডিগ্রীধারী ফরেস্ট রেঞ্জারগণ একই পদে ২৫-৩০ বছর চাকুরী করে ফরেস্ট রেঞ্জার পদ থেকেই অবসরে গেছেন এবং যাচ্ছেন। মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন রেঞ্জ কর্মকর্তাগণের সাথে আলোচনা কালে তারা তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক অসংগতি আর জোড়াতালি দিয়ে ধরে রাখা এ বিভাগটি অতি শীঘ্র ভেঙ্গে পড়বে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ মহল। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, শুধু বন বিভাগকে দোষারোপ করে চোখ বন্ধ করে বসে থাকার সময় আর নেই।

এ জাতির স্বার্থে, আগামী প্রজন্মের স্বার্থে হয় কোন যোগ্য সংগঠনকে এ দায়িত্ব দিতে হবে নতুবা পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও পরিবর্তিত বিশ্বের আলোকে আধুনিক ও সক্ষম একটি বন বিভাগ গঠন করা অতি জরুরী। এখনই। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু নিয়ে মিটিং, সেমিনার,প্রটোকল করে বেড়ালে কয়টা টাকা হয়ত ভিক্ষা পাওয়া যেতে পারে উন্নত বিশ্বের পাপের সন্তানের (নির্গত কার্বনের: তারা কার্বন প্রসব করবেই) পিতা হওয়ার জন্য ভাড়া হিসাবে। তাতে বাংলাদেশের বনের সমস্যার সমাধান হবে না। বাংলাদেশের বন ও পরিবেশ রক্ষা করতে হলে বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বাস্তবতার নিরীখে নাগরিক তথা বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ বন কর্মী ও মিডিয়ার আন্ত:মতবিনিময়, গোলটেবিল বৈঠক এর পাশাপাশি ব্যাপক প্রচারণা ও মোটিভেশনাল কাজ করতে হবে।

আসুন আমরা যে যেভাবে যতটুকু পারি জাতীয় বন সংরক্ষণ ও উন্নয়নে অংশগ্রহণ করি ও সামান্য হলেও ভূমিকা রাখি। বেসরকারী বন সৃজন করি। বনজসম্পদের অপচয় বন্ধ করি। ওয়ান টাইম বোতল,টিস্যু পেপার, বিভিন্ন রকম কাগজের ব্যবহার কমাই। জ্বালানী, প্রাকৃতিক গ্যাস, পানি, খাদ্য ইত্যাদির অপচয় বন্ধ করি।

ইন্টারনেটে পত্র পত্রিকা পড়ি, লিখি। সরকারী আধা সরকারী ও বেসরকারী অফিসে কাগুজে পত্র বা যোগযোগ কমিয়ে ফেলি। অযথা প্যাকেজিং, প্যাকেটিং বন্ধ করি। বিলাস ও ভোগের মাত্রা কমাই। প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশকে কম বিরক্ত করে প্রকৃতির মত করে থাকতে দিই।

নতুবা প্রকৃতির প্রতিশোধ বড়ই ভয়ংকর। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।