আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিরূপ প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে

সুবিধা পাওয়া পণ্যের তালিকায় তৈরি পোশাক না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি স্থগিত হওয়ায় আপাতত আর্থিক কোনো ক্ষতির মুখে পড়ছে না বাংলাদেশ। তবে দীর্ঘ মেয়াদে ওবামা প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে বিশ্বজুড়ে ভাবমূর্তির সংকট তৈরি করবে, যাতে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ ব্যাহত হতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার ওমাবা প্রশাসন অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা বা জিএসপি স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত করার কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পাওয়া জিএসপি স্থগিত করাই শ্রেয়। তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কিংবা নিচ্ছে না।


ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) প্রভাবিত করলে সত্যিই সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। কারণ, বাংলাদেশ ইইউর দেশগুলোতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে জিএসপি সুবিধা পেয়ে থাকে। গত বছর বাংলাদেশ দুই হাজার কোটি ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। আর পোশাক রপ্তানির বড় অংশটাই যায় ইউরোপের দেশগুলোতে।
মার্কিন কংগ্রেস ও সিনেটের একাধিক সদস্য বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন।

মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্রেটিক পার্টির দুই প্রভাবশালী সদস্য স্যান্ডার লেভিন ও জর্জ মিলার ওবামা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত প্রচারের ঠিক পরপরই এক বিবৃতিতে বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশের কাছে একটি কঠোর বার্তা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শ্রমমানের উন্নতিতে বাংলাদেশকে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অন্যরাও একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে উৎসাহী হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের অবাধ বাজার-সুবিধা স্থগিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। আর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিজিএমইএ) এ সিদ্ধান্তকে মার্কিন প্রশাসনের ‘বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে অভিহিত করেছে।

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেছেন, এ সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি হবে। সিদ্ধান্তটির পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে। বাংলাদেশকে নিয়ে ‘বাণিজ্য ষড়যন্ত্র’ (ট্রেড কন্সপিরিসি) হতে পারে।
তবে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বলেন, বাংলাদেশের জিএসপি বাতিল করা হয়নি, স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল তিনি এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, বিয়োগান্তক ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিতাদেশ হলো প্রথম ধাপ।

এখন বাংলাদেশের উচিত শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নত করা। এতে বাংলাদেশেরই লাভ হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপির আওতায় যেসব শিল্প সুবিধা পেয়ে থাকে, সিরামিক তার অন্যতম। গত অর্থবছরে জিএসপির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে প্রায় ৩৩০ কোটি টাকার সিরামিক রপ্তানি করা হয়েছে। মোট রপ্তানির ২৫ শতাংশ গেছে যুক্তরাষ্ট্রে।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কখনো যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি, কখনো আবার ইউরোপের ক্রেতাদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সিরামিকের পণ্য রপ্তানি করে। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ সিরামিক রপ্তানি করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লিবে, মেসি, ক্রেইট অ্যান্ড ব্যারেল, ব্লুমিংডেইলস, জেসিপেনি, লেনক্স, মার্থা স্টুয়ার্ট হোম ও পুসা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিরামিক ওয়্যার ম্যানুফেকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রিজভী উল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ, কারখানার শ্রমমান নিয়ে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা সিরামিক কারখানাগুলোর জন্য প্রযোজ্য নয়। বরং আমাদের ক্রেতারা বাংলাদেশের কারখানার কর্মপরিবেশের প্রশংসা করে থাকেন।

কাজেই বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই মার্কিন ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। মার্কিন ক্রেতারা পরিস্থিতি উত্তরণে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। ’
জানা গেছে, জিএসপি স্থগিতের সিদ্ধান্তের পর মার্কিন ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা পাওয়া পণ্য রপ্তানিকারক সংস্থাগুলো। এ ব্যাপারে সিরামিক রপ্তানিকারক একটি প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, এখনই জিএসপি স্থগিতের প্রভাব তাদের পণ্যের ওপর পড়বে না। মার্কিন ক্রেতারা আভাস দিয়েছেন, ওবামা প্রশাসনের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়নে বাংলাদেশ আগামী দুই মাস কার্যকর কী পদক্ষেপ নেয় সেটি পর্যবেক্ষণ করা হবে।

যদি দ্রুত ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেওয়া হয়, ব্যবসায় এর প্রভাব পড়বে না। অন্যদিকে আগামী দুই মাসে বাংলাদেশ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে ব্যবসা অব্যাহত রাখতে সিরামিকের পণ্যের মূল্য বর্তমান বাজার দরের চেয়ে ২০ শতাংশ বাড়ানো হবে।
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত হওয়াটা আমাদের জন্য যুগপৎভাবে দুঃখজনক ঘটনা ও একটি মনে করি বড় ধরনের ধাক্কা। এর ফলে বাংলাদেশের জন্য নানাবিধ চাপ তৈরি হবে। প্রথমত, মার্কিন ক্রেতারা শ্রমিক সংগঠনসহ মানবাধিকার ও ক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো চাপের মুখে পড়বে।

এ সংগঠনগুলো মার্কিন ক্রেতাদের বাংলাদেশ থেকে পণ্য না কিনতে চাপ দিতে পারে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিযোগীরাও পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইবে। এই প্রেক্ষাপটে দেখলে যুক্তরাষ্ট্রে এভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি ঝুঁকিতে পড়বে। ’
বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাশের দেশ কানাডা মার্কিন নীতি ও সিদ্ধান্তের কারণে প্রভাবিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত কানাডাকে প্রভাবিত করলে আমাদের জন্য সুখকর হবে না।

কারণ, কানাডার বাজারে আমাদের তৈরি পোশাক শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। আর যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত যদি আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রভাব ফেলে, তবে সেটি হবে আমাদের কফিনে শেষ পেরেক। সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি স্থগিতকে কেন্দ্র করে আতঙ্কিত হওয়ার পাশাপাশি পরিস্থিতি উত্তরণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যথাযথ সময়ে যথোপযুক্ত মনোযোগ, দক্ষতা ও মেধা দিয়ে শ্রমমান নিয়ে মার্কিন আপত্তির বিষয়গুলোকে মোকাবিলা করা হয়নি। যখন একের পর এক যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংকেত আসছিল, তখন সামগ্রিক মনোভাব দিয়ে বিষয়টি মোকাবিলা করা হয়নি।

বরং শ্রমিক অধিকারের বিষয়টিকে ধারাবাহিকভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে। অর্থাৎ মালিক-শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ে সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অর্থ, পররাষ্ট্র, শ্রম, বাণিজ্যসহ সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর যে ধরনের সমন্বয় দরকার ছিল সেটিও চোখে পড়েনি।
বাংলাদেশ-মার্কিন বাণিজ্য: উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য-সুবিধা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ’৭৪-এর বাণিজ্য আইন অনুযায়ী জিএসপি চালু হয়। ১৯৭৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হয়।

জিএসপির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচ হাজার পণ্য রপ্তানির সুযোগ পায় উন্নয়নশীল দেশগুলো। আর বাংলাদেশ এ সুবিধার আওতায় মূলত সিরামিক পণ্য, চশমা, তাঁবু, প্লাস্টিক ব্যাগ, উলের তৈরি পাপশ ও শতরঞ্জি যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে থাকে।
অন্যদিকে ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৪০ কোটি ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ৪৯০ কোটি ডলার। আর আমদানি করেছে ৫০ কোটি ডলারের পণ্য।


যেভাবে জিএসপি স্থগিত: শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষা ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তাজনিত শর্ত পূরণে ব্যর্থতার কারণে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের জিএসপি প্রত্যাহারের দাবি জানায় আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশনের (এএফএল-সিআইও)। পোশাক কারখানায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা, অবনতিশীল শ্রম পরিস্থিতি ও শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড (এক বছর পর যার সুরাহা হয়নি) নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের শেষ প্রান্তে এসে বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে পর্যালোচনার প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার হয়। শেষ পর্যন্ত ওবামা প্রশাসন এএফএল-সিআইওর পিটিশনটি এবার গ্রহণ করে। আর গত এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের জিএসপি বাতিলের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। এএফএল-সিআইওর আবেদনের পর বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে চার দফা শুনানি হয়েছে।

আর এসব শুনানিতে বাংলাদেশের বক্তব্য শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসনকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে গত ২৮ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক আদেশে বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত করেন। এখন জিএসপি স্থগিতের সিদ্ধান্তটি প্রজ্ঞাপন আকারে ফেডারেল রেজিস্টারে প্রকাশের ৬০ দিন পর বাস্তবায়িত হবে। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.