মেঘ বালিকা, ও-মেঘ বালিকা
কত স্বপ্ন কথা ছিল তোমার সাথে
অথচ ক্লান্তিহীন পথচলা থামেনা
বেড়ে চলে জীবনের নীরবতা . . . .
সর্বগ্রাসী এক নিরাপত্তাহীনতার নাম বাংলাদেশ। রাষ্ট্র এখন বিভীষিকার নাম। আমাদের সবটুকু শুভবোধের পথরোধ করতে চাইছে নানা রকম পশুতোষ জাগ্রত বাহিনী। আর সুশীল(?) সমাজ প্রতিদিন সুশীতল হচ্ছেন। সাত চড়েও রা করেন না।
ঠিক এই সময়ে একজন তীরন্দাজকে আমি আমার পাশে হাঁটতে দেখি। তার অন্ধ চোখে চক্ষুষ্মান হওয়ার আকুলতা, স্বপ্ন! আমরা চক্ষুষ্মান হবো কবে? আমাদের চোখ গেল যে! হে বন্ধু . . . . !(১*)
“চোখ গেলো বলে ডাকে চোখ গেল পাখি,
আমি অন্ধ তীরন্দাজ দাঁড়িয়ে থাকি
হাত বাড়ালে এখন শূণ্যতা দেখি,
রোদ চশমায় ভীরু লজ্জা ঢাকি
লুটপাট হয়ে গেলে সোনা রোদ্দুর,
পথ থেকে পা সরে যায় বহুদূর
লুটপাট হয়ে গেলে যৌথ খামার
ব্যাক্তি জীবনে বাড়ে শখের বাহার”
আঁধারে ডুবে থেকেও আমরা নাকি আলোকিত। ক্ষুদার ঝঙ্কারে কেউ কেউ দেহ বিক্রি করে দিলেও নাকি নেই কোন ক্ষুদার হাহাকার। এখানে সংসদ নামক রাষ্ট্রযন্ত্রের যাতাকলে উল্লসিত কথার আঘাতে পিষ্ট হতে থাকে নিষিদ্ধ পল্লী। নিজরুমে নিরাপদে খুন হয়ে গেলেও নাকি এখানে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে না।
রাজপথের উত্তপ্ত কালো পিচে ছোপ ছোপ রক্তের অনুভূতিগুলো আজ শুধুই কিছু বেওয়ারিশ কুকুরের দখলে।
“রাজা যায় রাজা আসে
রাণীরা আসে যায়
গাছে গাছে পাখি গান গায়
ফুল বাগানে ফুল ফুটে রয়
তবুও একদিন খবর আসে
নিরাপদ হেফাজতে
একজন সীমা চৌধুরী
নিরাপদে মারা যায়”
জীবন থেমে নেই। রাত যায়, ভোর আসে। পাখির কলতান যান্ত্রিক শব্দের ভিড়ে হয়ত কানে পৌছতে পারে না, তবুও পাখিরা থেমে নেই। যান্ত্রিক শহরে কখনোবা এক পশলা বৃষ্টি শেষে গেয়ে উঠে আপন সুরে।
আর আমি চমকে উঠি। দেখি এখানে মানুষ ছোটে জীবন থেকে জীবনে। নববধুর প্রিয় স্বামীটি যখন বধুর আঁচল পেরিয়ে নামে নতুন জীবনে, সেখানে সে আগুন্তুক। আর আমি হাটি ফুটপাত ঘেঁষে এমন হাজারো আগুন্তুকের ভিড়ে এক আগুন্তুকের মত। আমি হাসি, ফুল হাতে ছোট্ট মেয়েটি আমার হাসির প্রশ্রয় পেয়ে ধীর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ায় আমার গা ঘেঁষে।
শুধু পরম মমতায় কাছে টেনে নরম গাল দুটো টেনে দিতেই ফোকলা দাতে নরম হাসির রেখা টেনে ছুটে গিয়েছে প্রেমিক থেকে প্রেমিকাতে। দিনের আলো মৃয়মাণ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে যখন অন্ধকার নেমে আসে, হাসি ঠাট্টায় রাজপথ মুখর করে বেরিয়ে আসে অজস্র গার্মেন্টস শ্রমিক। তাদেরই একজন ইয়াসমিন। আগুন্তুকেরা একে একে নীড়ে ফিরে আসে। কেউ কেউ আবার থেকে যায় শিকারের আশায়।
তাদেরই একদল পশুতোষ জাগ্রত বাহিনী রাতের আঁধারে দানবের হাসি হাসে।
“দানবের হুঙ্কারে দানবের জয়,
যেন এই পৃথিবী মানুষের নয়।
গোলামীতে কেটে যায় সারাবেলা সারাদিন
ভোররাতে মারা যায় ধর্ষিতা ইয়াসমিন।
ভীনদেশী নর্তকী অশ্লীল নেচে যায়
ধর্ষিতার হাহাকার বাতাসে কেঁদে যায়”
রাষ্ট্রনীতি আজ স্বার্থের খাঁচায় বন্দী। মন্ত্রণালয় থেকে রম্য বাণী প্রচার পায় প্রচার মাধ্যমে।
গরু ছাগল হয়ে উঠে মানদন্ড হিসেবে। নীতি নির্ধারকেরা নিক্তি হাতে দৌড়াদৌড়ি করেন। রাষ্ট্রবাহিনী রাষ্ট্রনীতি রেখে লাঠি হাতে মাঠে নামেন। বুট দিয়ে চেপে ক্ষতবিক্ষত করেন যুবকের বুক। বুক পকেটে রক্তাক্ত হয় দেশের পতাকা।
অন্যদিকে বিদেশী শকুনেরা বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে কাটাতারে ফেলে রাখে বাংলার এক একটি ফেলানী। বন্ধুবৎসল রাষ্ট্র আমার বাহবা কুঁড়ায় এক একটি লাশের উপর দাঁড়িয়ে। আর আমি শুনি একজন গায়কের মানবিক কান্না---
“শকুনেরা উড়ে আকাশে/ধর্মের ধ্বজা ধরে হাসে
তীক্ষ্ণ নখে চিড়ে যায়/স্বদেশের প্রিয় পতাকা
পরাজিত ঘাতকের চোখ/কুৎসিত হলাহল হাসে
মাঝরাতে টোকা দিয়ে যায়/জানালায় কান্নার ধ্বনি
ধর্ষিতা হয়েছিল যে/এখানেই মাটি আর ঘাসে
সোনামুখ বোনটি আমার/কখনোই হাসবে না জানি
প্রতিশোধ জ্বলে না কোথাও/ঘিড়ে আসে ঘোর অশনী”
যুগ এবং রাষ্টের তালে তালে আজ আমরা সবাই কম বেশী ডিজিতাল। এদিকে রাষ্টপক্ষ ডিজিতালে এতই তালমাতাল যে নিজেকেই সামলাতে পারছে না। ডিজিতালের হাওয়ায় ভর্তুকি দিয়ে বাঁশ বাগান ছেড়ে নাগরিক হাওয়ায় ভাঙা গলায় শিষ বাঁজায় অপুষ্টিতে রুগ্ন, ঝাপসা দৃষ্টির কিছু দুই নম্বর দোয়েল।
আর আমার রাষ্ট্রপক্ষ বাহবা কুঁড়ায় ‘আহা! বেশ!! বেশ!!! বেশ!!!’। এদিকে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে যায় তাজা তাজা প্রাণ। বাবার কাধে ছেলের লাশ, ভাইয়ের কাধে বোনের লাশ, স্বামীর কাধে স্ত্রীর লাশ। অচেনা গ্রাম্য বালিকার লাশ কোলে তুলে নির্বাক এক আগুন্তুক শূণ্যে চেয়ে থাকে কারো উত্তরের আশায়। লাশের যাত্রী নিয়ে ভেসে উঠে শরীয়তপুর-১।
আর আমার যখন খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে তিনি চুপিচুপি এসে কানে কানে বলে যান-
“কবিতার মত নয়তো জীবন
জীবন কবিতায় ফুল হয়ে ফোটে
পাওয়া না পাওয়ার দুঃখ সুখে
জীবনের দোলনা দুলে উঠে
রাত্রির কাছে শুধু জানতে চেয়ো
কেন স্তব্দতা তার বুকে থাকে।
চলে যাওয়া না যাওয়ার পথের বাঁকে
ঘুঘু ডাকা কোন দুপুর বেলা
সুদূরে হারায় যদি তোমার চাওয়া
দেখো স্বপ্ন তবু কত ছবি আঁকে
নদীর কাছে শুধু জানতে চেয়ো
কেন কুলকুল করে সে এতো ডাকে”
জীবন থেমে থাকে না। বাংলার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে কিছু স্বপ্নবাজ মানুষ জেগে থাকে। তারা স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখায়। যেমনটি দেখেছিল ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা।
সালাম, রফিক, বরকত, শহীদুল্লাহ জাগিয়েছে ভাষার স্বপ্ন। আমার প্রাণের ভাষা। ৭১-তে বাংলার দামাল ছেলেরা ছিনিয়ে এনেছে বাংলা নামের রাষ্ট্র। আবার এই স্বাধীন বাংলা্র গণতন্ত্র যখন বিপথগামী হতে চলেছিল তখন নূর হোসেনের পূণ্য রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ। আর এই স্বপ্নবাজ মানুষগুলোর চোখে ধূলো দিতে জেগে আছে কিছু মুখোশধারী।
এরা গণতন্ত্রের নামে, ধর্মের নামে, মানবিকতার নামে এই বাংলার পতাকার ছায়াতলে মুখোশের আড়ালে থেকে হিংস্র থাবায় কেড়ে নিচ্ছে এক একটি স্বপ্ন। আমার বুক জুড়ে যখন ভাঙনের ঢেউ উঠে তিনি গেয়ে উঠেন-
“সম্পূর্ণ রঙিন অথবা সাদাকালো মুখোশ! আছে
নিজের স্বার্থ বুঝে বোবাকালা সাজা মুখোশ! আছে
আড়ালে ফিসফাস কুৎসিত দাবাখেলা মুখোশ! আছে
ভালবাসার নামে প্রতারক হাসিমাখা মুখোশ! আছে।
সংস্কৃতির নামে তোষামোদী করা মুখোশ! আছে
নিজের বিবেকটাকে বাজারে বেচাকেনা মুখোশ! আছে
গণতান্ত্রিক হাতে কণ্ঠ চেপে ধরা মুখোশ! আছে
প্রগতিশীলতায় ঝোপ বুঝে কোপ মারা মুখোশ! আছে।
হয় না সেই মুখোশ, সত্যকে জেনে শুনে
চোখে চোখ রেখে মাথা উচু করে বলা দারুণ সাহস। ”
মুখোশে ঢাকা অচেনা সময়ে আজকাল প্রায়ই নোনা জলে ঝাপসা হয়ে যায় দু’চোখ।
ঝাপসা দৃষ্টি খুব বেশী দূর কি দেখতে পায়? পায় না। কিন্তু আমাদের তো দীর্ঘপথে হেঁটে বহুদূর যেতে হবে। আলোর খোঁজে। আর এই অন্ধকার ছোঁয়া চলতি পথে যা চোখে পড়েছে, পড়ছে, পড়বে- তা নিয়েই দাহকালের গান।
যারা বন্ধু, যারা শত্রু, যারা ভালবাসে, যারা ঘৃণা করে- সবাইকে বলি কৃতজ্ঞতা।
বলি শুভবোধের জয় হোক। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা পৃথিবীতে। (২*)
*--- মাহমুদুজ্জামান বাবু, দাহকালের শিল্পী। দরাজ কণ্ঠে নিজের লেখা ও সুরে করেছেন তুলে ধরেছেন অস্থির সময়ের কথা, মানবিকতার কথা, ধর্মান্ধতার কথা। তুলে ধরেছেন মুখোশের আড়ালের হিংস্র পশুগুলোর রুপ।
ভালবাসার রুপ, রস ও গন্ধে অপার মমতায় গানের কথায় এঁকেছেন দেশের মানচিত্র, তুলে এনেছেন নিষ্ঠুর এই সময়কে, নিষ্ঠুর রসিকতাকে।
গানগুলো নিজের আত্মার প্রতিনিধিত্ব করে। মনে হয় যেন এ-তো আমারই কথা, আমারই অনুক্ত অনুভূতি। যখন দু'চোখের পাতা ভারি হয়ে বন্ধ হয়ে আসতে চায় তখন চোখের তারায় স্বপ্নের ডিঙা ভাসিয়ে নিয়ে যায় বহুদূরে অজানা দেশে। এই অস্থির সময়ে অস্থির মন নিয়ে যখন লাগামহীন অন্ধ ঘোড়া টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় ক্ষত বিক্ষত করে, যখন চোখের পাতা দুটো এক করতেই হতাশা, গ্লানি, কষ্ট বিষাক্ত ফলার মত ধেয়ে আসে তখন দাহকালের গানগুলো এসে পাশে দাঁড়ায় বন্ধুর মত, কানে কানে বলে যায়--
“আস্থা থাকুক মানুষ নামে
আস্থা থাকুক পরস্পর
আস্থা থাকুক ভোরের গানে
আস্থা থাকুক জীবনভর
আস্থা থাকুক দুঃসময়ে
আস্থা থাকুক স্বপ্নময়
আস্থা থাকুক পথ চলাতে
আস্থা থাকুক সূর্যোদয়”
এই পোষ্টের লিরিক গুলো মাহমুদুজ্জামান বাবুর বিভিন্ন অ্যালবামের গানের কথা থেকে নিয়েছি।
মাহমুদুজ্জামান বাবুর প্রকাশিত তিনটি অ্যালবামের কথা আমার জানা আছে। সেগুলো পাঠকের জন্য উল্লেখ করছি
১. চোখ ভেসে যায় জলে
২. অচেনা সময়
৩. অন্ধ তীরন্দাজ (২০০৪)
---*
(১*) এই অংশটুকু মাহমুদুজ্জামান বাবু’র ‘অন্ধ তীরন্দাজ’ অ্যালবামের কাভার থেকে নেয়া
(২*) এই অংশটুকু মাহমুদুজ্জামান বাবু’র ‘অচেনা সময়’ অ্যালবামের কাভার থেকে নেয়া
* প্রিয় ব্লগার বন্ধুরা আপনাদের জন্য এই লিখাটি পাঠিয়েছেন আপনাদের প্রিয় "RaDiO bg24" একটি শিক্ষিত রেডিও এর বন্ধু শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত মুখলেসুর রহমান সজল। *
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।