আবদুর রশিদ রেনু,সিলেট ব্যুরো
সিলেটের উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সিটি মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান নির্বাচনের সময় প্রতিশ্র“তির বন্যা বইয়ে দিলেও কেউ কথা রাখেননি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সিলেটের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনার প্রতিশ্র“তি ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। নির্বাচনের সময় ভিডিও কনফারেন্সে দেয়া বক্তব্যে সিলেটের উন্নয়নের বিষয়টি তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। আলোকিত সিলেট গড়ার অঙ্গীকার ছিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের। সিটি নির্বাচনের সময় মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের প্রতিশ্র“তি ছিল আধ্যাÍিক পর্যটন নগরী গড়ার।
তারা এখন ক্ষমতার চেয়ারে থাকলেও সিলেটে দৃশ্যমান উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। উন্নয়নের সেসব প্রতিশ্র“তি, অঙ্গীকার কথার ফুলঝুরিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তাদের রকমারি প্রতিশ্র“তির ভিড়ে বিগত সরকারের নেয়া উন্নয়ন পরিকল্পনাও থমকে আছে। সিলেটের জন্য গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ যে ১২ দফা উন্নয়ন প্রস্তাব রেখে গিয়েছিল, তারও কোন হদিস নেই। ঝিমিয়ে পড়েছে স্পেশাল ইকোনমিক জোন স্থাপনের তৎপরতাও।
ফলে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে নতুন নতুন সমস্যা ঘিরে বসছে সিলেট নগরীকে। পানি, যানজট, গ্যাস সমস্যা ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য ১৭ বছর আগে সিলেট বিভাগের যাত্রা শুরু হলেও এখন পর্যন্ত সব বিভাগীয় দফতর সিলেটে স্থানান্তর হয়নি। নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ এসএমপি। তাদের নেই নিজস্ব ঠিকানা, নেই প্রয়োজনীয় জনবল, নেই প্রয়োজনীয় আবাসন ও সুযোগ-সুবিধা।
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে কয়েক বছর আগে দেড় হাজার শয্যায় উন্নীত করা হয়। যেখানে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছে প্রায় ২ হাজার রোগী। শয্যা বৃদ্ধি করা হলেও বাড়েনি হাসপাতালের জনবল। পুরনো জনবল দিয়ে অধিকসংখ্যক রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
সিলেটবাসীর অভিযোগ, একের পর এক সরকার ক্ষমতায় এলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী সিলেটের উন্নয়ন হয়নি।
পরিকল্পিত মৌলিক উন্নয়ন পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে সব সরকারের আমলেই। ওসমানী বিমানবন্দরকে নামে আন্তর্জাতিক করা হলেও কাজে হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে ওই বিমানবন্দর থেকে সিলেট-লন্ডন সরাসরি ফ্লাইট চালু করা হলেও গত ডিসেম্বরে ঘন কুয়াসার অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশ বিমান তা বন্ধ করে দেয়। অথচ একই কুয়াসায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে বিমান চলাচল করে। এ নিয়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের মধ্যে।
সিলেট-লন্ডন সরাসরি বিমানের ফ্লাইট চালুর দাবিতে সিলেট ও লন্ডনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রবাসীরা উচ্চ আদালতে রিট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শিল্পায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে সিলেট। বিশেষ করে বিভাগীয় নগরী নানা সমস্যায় জর্জরিত। খাবার পানির তীব্র সংকট, জলাবদ্ধতা, যানজট আর গ্যাস সংকটে অতিষ্ঠ নগরবাসী।
অবৈধ দখলে চলে যাওয়া নগরীর সবক’টি ছড়া, নালা, খাল উদ্ধার না হওয়ায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই নগরীতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। নগরীর দক্ষিণ সুরমার তিনটি ওয়ার্ডে এখনও পানির কোন সংযোগ নেই। নগরীর মাত্র ৩০ ভাগ নাগরিক পাচ্ছেন পানিসেবা। তাও লাইন আছে তো পানি নেই প্রায় সময়ই।
বাকি ৭০ ভাগ নাগরিকের কথা ভাবছেন না কেউই। জনপ্রতিনিধিরা বস্তিবাসীর উন্নয়নে নানা প্রতিশ্র“তি দিয়ে এলেও এ পর্যন্ত কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সন্ধ্যা নামলেই বাতিহীন নগরীর রাস্তাগুলো হয়ে ওঠে ভূতের গলি। আলো-আঁধারিতে ওঁৎ পেতে থাকা ছিনতাইচক্র এ সুযোগে তাদের কাজ সেরে নেয় নিরাপদে। সিলেট প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল।
এসব সম্পদের সদ্ব্যবহারের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সিলেটে পাথরের পাশাপাশি নুড়ি ও বালুর জোগান রয়েছে। এসব সম্পদ কাজে লাগিয়ে সিরামিক ও কাঁচ শিল্পের কথা বলা হলেও এ ধরনের কোন শিল্পই স্থাপিত হয়নি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রথম ও প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল ব্রিটিশ আমলে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারকে নগরীর বাইরে স্থানান্তর। কারাগার স্থানান্তরের কাজ শুরু হলেও চলছে মন্থরগতিতে।
এই সরকারের আমলে তা বাস্তবায়ন হবে কি না এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। এমনিতেই নগরীর রাস্তাগুলো অত্যন্ত সরু। তার ওপর ফুটপাতসহ রাস্তার অর্ধেকজুড়েই ভাসমান হকারের হাট। অর্থমন্ত্রী একাধিবার আইন-শৃংখলা কমিটির সভায় ফুটপাত হকারমুক্ত করার উদ্যোগ নিলেও সিটি কর্পোরেশনের অসহযোগিতার কারণে তা হচ্ছে না। হকারদের অভিযোগ, অপরিকল্পিত হকার মার্কেট এখন হয়ে উঠছে নগরীর গলার কাঁটা।
দিনের বেলায়ও ওই মার্কেটে কেউ যেতে পারেন না। নেশাখোর, জুয়াড়ি, দেহব্যবসায়ীরা স্থায়ী আস্তানা গেড়েছে ওখানে। নগরীর হাসান মার্কেটের চারতলা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল সেই পৌরসভা আমলে। প্রতিবছর এই মার্কেট নির্মাণে বিপুল অংকের বাজেট রাখা হলেও একটি ইটও লাগেনি হাসান মার্কেটে। দীর্ঘদিন ধরে সিলেট নগরীর রাস্তাঘাটে বিরাজ করছে বেহাল দশা।
সমপ্রতি কয়েকটি রাস্তা উন্নয়নের কাজ শুরু করেছে সিটি কর্পোরেশন। নগরীর বিভিন্ন স্থানে সরু রাস্তা থাকায় তীব্র যানজট লেগেই থাকে। যানজট নিরসনে রাস্তা প্রশস্ত করণের কোন উদ্যোগ নেই। গত চারদলীয় জোট সরকারের সময় সুরমা নদীতে নির্মাণকাজ শুরু করা কাজীর বাজার সেতুর কাজ আটকে আছে দীর্ঘদিন ধরে। একই সময়ে নগরীর শিশুদের চিত্তবিনোদনের জন্য সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণ সুরমায় সাইফুর রহমান পার্ক নির্মাণের কাজ শুরু করে।
চারদলীয় জোট সরকারের সময় সিটি কর্পোরেশনের কয়েকটি বাজেটে কোটি কোটি টাকা বারাদ্দ রাখা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থমকে গেছে এই পার্ক নির্মাণের কাজ। এছাড়াও সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন নগরীর ধোপাদীঘির পাড়ে স্থাপিত ওসমানী শিশু পার্কটি এখন ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হয়েছে। পৌরসভা থাকাকালে পার্কটি ৬ মাসের জন্য লিজ দেয়া হয়েছিল। নগর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ৬ মাসের লিজ শেষ হয়নি এক যুগেও।
রহস্যজনক কারণে পার্কটি নতুন করে প্রকাশ্য নিলামে লিজ দেয়ার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে গোপনে আঁতাতের মাধ্যমেই বিভিন্ন অজুহাতে লিজগ্রহীতা পার্কটি দখলে রেখেছেন। সরকার গঠনের পরেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিভিন্ন সভায় সিলেটে উড়াল সেতু নির্মাণ এবং নগরীর ১টি বালক ও ১টি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়কে সরকারিকরণের ঘোষণা দেন। সরকারের ৩ বছর চলে গেলেও এসব উদ্যোগ ঘোষণার মধ্যেই আটকে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা গ্রহণের প্রতিশ্র“তি দিলেও ৩ বছরে কোন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি।
তিনি নিজেকে হাওরাঞ্চলের বাসিন্দা উল্লেখ করে হাওর-বাঁওড় বেষ্টিত সিলেটের উন্নয়নে নতুন আরেকটি হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠনের প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন। নানা সমস্যার ভাগাড়ে থাকা সিলেটবাসী প্রধানমন্ত্রীর মহাপরিকল্পনা, অর্থমন্ত্রীর আলোকিত সিলেট আর মেয়রের আধ্যাÍিক পর্যটন নগরীর মিল খুঁজে পাচ্ছেন না। এছাড়াও গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সিটি কর্পোরেশন বিভাগের সব সংসদ সদস্যকে দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তারা বিভাগের উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন। এটা এখনও প্রতিশ্র“তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
কপি পেস্ট
দৈনিক যুগান্তর
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।