কেউ যদি সত্যিকার অর্থে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে চায় তবে তাকে সিলেট যেতে হবে। সিলেটের আগে, কিশোরগঞ্জের পর থেকেই শুরু হয় খোলা রাস্তা দিয়ে চলা। বিশুদ্ধ বাতাস। গাড়ির উইন্ডো নামিয়ে দিলেই সে বাতাস হু হু করে এসে গায়ে লাগবে। দুই পাশে হাওড় কিংবা বিল।
যার কোন সীমা নেই। মাঠের পর মাঠ। কাদার মধ্যে মহিষের দল গিয়ে নেমেছে। এই বিশাল প্রান্তরে দু-একটা বাচ্চাকে মনে হয়েছে যেন এরা ভীনগ্রহ থেকে এসেছে। না হলে এমন জনমানবহীন জায়গায় এরা আসল কোথা থেকে।
গায়ে কোন জামা কাপড় নেই, মাটির সাথে গায়ের রং মিশে গেছে। কত নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায় খেলছে, একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছে। এই পৃথিবীর কোন কিছুর সাথেই তাদের যোগাযোগ নেই।
সিলেটের নাম আসলেই হযরত শাহ জালাল (রহঃ) এর মাজারের কথা আসবে। সেজন্য সিলেট গিয়েই প্রথমে তার মাজারে গেলাম।
গিয়ে খুবই দুঃখ পেলাম। শাহ জালাল (রহঃ) এত বড় মাপের একজন ধার্মিক লোক ছিলেন অথচ তার মাজারেই এখন ধান্ধাবাজরা চালাচ্ছে নানান অধার্মিক কাজ। রাতের বেলা মাজারের সব জায়গাতেই পাওয়ারফুল লাইট জ্বলছে। মাজারের ভিতরেও। সেই আলোর মধ্যে মানুষজন শত শত মোমবাতি নিয়ে জ্বালাচ্ছে।
এর কারণ কী? ইসলাম ধর্মের নিয়মকানুন গুলো খুবই সহজ। কোরআন এবং হাদিসের মধ্যেই প্রার্থনার সব নিয়ম কানুন দেয়া আছে। সেখানে কোথাও মোমবাতি জ্বালিয়ে এভাবে প্রার্থনা করার কথা বলা নেই। নিজেদের পকেট ভরার জন্য এই সিস্টেম চালু হয়েছে? তবে একটা জিনিস বুঝলাম না, যদি টাকা কামানোর ইচ্ছাই থাকে তবে সস্তা মোমবাতি কিংবা হালুয়া কেন? দামি জিনিসও তো দেয়া যেত। তাতে ইনকাম হত বেশি।
বিষয়টা নিয়ে কেউ একটা গবেষণা করলে জানা যেত।
রাত নয়টা দশটার দিকে মাজারের সামনের রাস্তার দাঁড়িয়ে ছিলাম। দুই পাশের দোকানগুলোতে মেলার মত শো পিস সহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্রের পসরা বসেছে। বেশ কিছু দোকান আছে যেখানে হালুয়া বিক্রি হচ্ছে। হালুয়ার চেহারা ভাল না।
দেখেই বোঝা যাচ্ছে সস্তা এবং অখাদ্য। লোকজন সেখান থেকে হালুয়া কিনে নিয়ে যাচ্ছে মাজারের ভিতর। এই হালুয়া প্রার্থনার নিয়ম যে তারা কোথা থেকে পেল বুঝলাম না। এমন সময় মেইন গেটের কাছাকাছি একটা মোটর সাইকেল এসে থাকল। আরোহী দুইজন।
পিছনের জনের গা খালি। সে মোটর সাইকেল থেকে নেমে ‘ আইছিরে বাবা!’- বলে জিনসের প্যান্ট গা থেকে খুলে ছুড়ে মেরে মাজারের দিকে দৌড় দিল। তার গায়ে শুধূই একটা আন্ডার প্যান্ট। তার ছুড়ে মারা প্যান্ট গিয়ে পড়েছে এক হালুয়ার দোকানে। অল্পের জন্য প্যান্টটি হালুয়ার পাত্রে পড়ে নি।
এই স্টাইলে মাজার জিয়ারতের নিয়মই বা সে কোরআন-হাদিসে কোথায় পেল?
(এই লেখার জন্য আবার আমার উপর বোমা হামলা হয় কি-না কে জানে!)
সিলেট শহরটা খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং অদ্ভুদ। কারণ ছোট বেলাতেই আমরা বইয়ে পড়েছি এখানে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। শহরটি পাহাড় এবং বড় বড় গাছ-পালায় ঘেরা। বিশাল বিশাল পাহাড় গুলো দেখে সত্যি বলে মনে হয় না। তার মধ্যেই চা বাগান।
পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা উপরের দিকে উঠে চলে গিয়েছে কমলা বাগানের দিকে। ছোট ছোট বাচ্চারা সোয়েটার গায়ে হাতে বই নিয়ে পড়তে যাচ্ছে। রাস্তার মুখে ছোট ছোট চায়ের দোকান। অনেক শোনা চা বাগানের নাম চোখে পড়ছে। যেমন - ‘মালনিছড়া চা বাগান’।
পাহাড়ের উপর থেকে দৃশ্যটা আরও অন্য রকম। চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের উপর গাছপালা বনের মত হয়ে আছে। একদিকে কোন একটা এমিউজমেন্ট পার্ক। অন্যদিকে এয়ারপোর্ট।
এয়ারপোর্টের চারপাশে পাহাড়ের বেস্টনী। আরও দূরে আকাশস্পর্শী পাহাড়। পাহাড় এত বড় হয়! যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। এই পাহাড়ে গিয়েই অনেকে চড়ে। কারা থাকে সেখানে? কত বিচিত্রই না সেসব মানুষের জীবন।
জাফলং যাওয়ার পথে ঘটল এক ঘটনা। আমাদের গাড়ি অতিক্রম করে সামনে গেল এক মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেলের আরোহী দুইজন। সামনের জন চালক, সে নরমাল। পিছনের জন দেখার মত।
তার পায়ে স্যান্টেল। গায়ে খয়েরী রঙের ঢোলা-ঢালা স্যুট-প্যান্ট। মাথায় পিঠ পর্যন্ত লম্বা ফিনফিনে লাল চুল। তার উপর ক্যাপ। সে খুবই ভাবে আছে।
এমন সময় মোটর সাইকেলে পিক আপ দিতেই বাতাসে তার চুল আর ক্যাপ উড়ে গিয়ে রাস্তায় পড়ল। কেলেংকারী অবস্থা। আমাদের গাড়ি ব্রেক করল। আশে পাশের মানুষ হাসা হাসি করছে। সে দৌড়ে এসে ক্যাপ এবং চুল তুলে নিয়ে গিয়ে মোটর সাইকেলে বসল।
আবার সে চুল এবং ক্যাপ পড়ল। আবার ভাব। কিছুন পরে আবার সেই ঘটনা। মোটর সাইকেলে পিক আপ দিতেই ক্যাপ এবং চুল উড়ে গিয়ে পড়ল রাস্তায়। সংপ্তি এই ভ্রমণে মোটর সাইকেল আরোহীরা যথেষ্ট আনন্দ দিয়েছে।
জাফলং যাওয়ার পথে ডান পাশে বিশাল বিশাল পাহাড়। বড় বড় পাহাড়গুলো সব ভারতে। সেই পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি থেকে সৃষ্ট সরু নদী এসে পড়েছে বাংলাদেশে। জাফলংয়েও একই অবস্থা। সেখানে গিয়ে সবাই বড় বড় যে পাহাড় দেখে, ঝরণা, এসব কিছু ভারতে।
এখানকার লোকজন বাংলাদেশের সীমানায় ঝরণার ধারা থেকে সৃষ্ট নদীর পানিতে নেমে সেসব দেখে আসে। সেই নদী ক্রস করা যায় না। করলেই বিডিআরটা পো পো করে হুইসেল বাজাতে থাকে। জাফলংয়ে ভারতের সবচেয়ে বড় যে পাহাড়টি দেখা যায় সে পাহাড়ে একটা কালো রঙের একটা বড় পাথর ঝুলে রয়েছে। দেখলে মনে হয় এুনি গড়িয়ে নীচে পড়বে।
সেই পাথরের ফাক গলেই নেমে এসেছে সবচেয়ে বড় ঝরণার ধারা।
জাফলংয়ের নদীটির পানি আয়নার মত স্বচ্ছ, ফ্রিজের পানির মত ঠান্ডা। নীচে পাথরের পর পাথর বিছানো। পানির উচ্চতা কোমড় পর্যন্ত (প্রায়)। নীচে পানির ভিতর তাকালে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
সেই পানিতে নেমে পাথরের উপর হেটে বেড়ানো খুবই ইন্টারেস্টিং একটা ব্যপার। সেখানে সরু এক ধরনের নৌকা চলে। অনেকে সেই নৌকাতেও চড়ছে। শুনেছিলাম এখানে আগে মূল্যবান পাথর পাওয়া যেত। এখন সেসব নেই।
সব সাধারণ পাথর। সেই পাথরও যেন লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। মেশিন দিয়ে পাথর উঠানো হচ্ছে। নৌকায় করে পাথর তোলা হচ্ছে। যদি পাথর তুলতেই হয় তাহলে তার প্রথম অধিকার সেখানকার দরিদ্র পাথর উত্তোলনজীবিদের, বিত্তবান প্রভাবশালীদের নয়।
নদী থেকে পাথর তোলা ফ্রি, এজন্য কাউকে টাকা দিতে হয় না। এটা শোনার মাথায় একটা বুদ্ধি আসল। ঢাকায় ফুলের টবের জন্য যে পাথর বিক্রি হয় তার বেশ দাম। এখান থেকে পাথর নিয়ে গেলে দারুন হয়। অন্যদেরকেও দেয়া যাবে।
সাথে গাড়ি আছে, বহন করারও সমস্যা নেই। আমি আর ড্রাইভার মিলে এক বস্তা পাথর তুললাম। সেই বস্তা টেনে গাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় সবাই খুব অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। একজন জিজ্ঞেস করল - ভাই, বস্তার ভিতর কী?
- পাথর।
- পাথর? পাথর কিনে নিতেছেন?
- কিনব কেন? এখান থেকে পাথর নেয়া তো ফ্রি।
- পাথর নিয়া কী করবেন?
- সেইটা বলা যাবে না।
এই কথা শুনে তারা আরও একটু কৌতুহলি হয়ে পড়ল। কয়েকজন একবার নদীর দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার বস্তার দিকে। ভাবছে নদীর পাথরে কোন বিশেষ ব্যপার ঘটল কিনা।
সিলেটে নদীর পানির নীচে যে পাথরগুলো খুবই সাধারণ মনে হয়েছিল সেই পাথরগুলোই বাড়িতে এনে টবে রাখার পর অন্য রকম দেখাচ্ছে।
খুব ঝকঝকে। অন্যদেরকেও দিলাম। বললাম - ‘এগুলো সিলেটের জাফলংয়ের নদীর পাথর। প্রকৃতির উপহার’।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।