I am Bangladesh supporter মহাসমাবেশে ৯০ দিনের আলটিমেটাম দেয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য সংসদেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। গতকাল সংসদে এক ঘণ্টা ৫৩ মিনিটের ভাষণে সরকারকে আবারও হুশিয়ার করে তিনি বলেন, সরকার সমঝোতার সব পথ বন্ধ করে গায়ের জোরে চলতে চায়। কিন্তু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতিতে এদেশে নির্বাচন হবে না। হাসিনা-এরশাদের ’৮৬মার্কা নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বিদ্যমান বাস্তবতায় আমরা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেব না।
নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। বিতর্কিত ইভিএম মেশিনের ব্যবহার আমরা মেনে নেব না। খালেদা জিয়া তার বক্তৃতায় বিচারপতির আসনে বসে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার সমালোচনা করে বলেন, রাজনীতি করতে চাইলে বিচারকের আসন ছেড়ে সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিন। বিচারপতির আসনে বসে রাজনীতি করবেন না।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা রাজপথে মহাসমাবেশ করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছি।
এটা শুধু আজ বিরোধী দলের নয়, জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। আদালতও দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের নির্দেশনা দিয়েছে। রাজপথে মহাসমাবেশ করে এই জনদাবি তুলে ধরেছি। এজন্য সরকারকে ৯০ দিনের সময়সীমা দিয়েছি।
আজ সংসদেও একই দাবি করছি। আমাদের আন্দোলনের পথে ঠেলে দেবেন না। একতরফা নির্বাচন করলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলব। একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবে অংশ নিয়ে দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে না ধরায় তিনি রাষ্ট্রপতিকে কোনো ধন্যবাদ জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তবে সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের বিজয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারকে ধন্যবাদ জানান। বিরোধীদলীয় নেতা তিস্তার পানির হিস্যা, টিপাইমুখ বাঁধ বন্ধ, ৭৪টি আন্তঃনদী সংযোগ বন্ধ, সীমান্তহত্যাসহ নানা বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আপনারা আওয়াজ তুলুন—আমরা আপনাদের সহযোগিতা করব। দেশের জনগণ আপনাদের পাশে থাকবে।
দুই দফায় বক্তব্য দিয়ে ১৯৭১ থেকে ’৭৫সহ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, নির্যাতন, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, লুটপাট ও দুর্ভিক্ষ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, সাংবাদিক খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণসহ বর্তমান সরকারের তিন বছরের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।
এছাড়া তিনি বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন, ভারতের সঙ্গে চুক্তি ও জাতীয় বাজেটের আগে সরকারের উদ্দেশে দেয়া প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা বারবার সরকারকে সহযোগিতা করতে চেয়েছি, এখনও চাই। এ সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন ১৮০ সরকার ও বিরোধীদলীয় এমপি। সরকারদলীয় এমপিরা খালেদা জিয়ার বক্তব্য চলাকালে ‘চোর’, ‘ইশ’, ‘নো’, ‘চুপ চুপ’, ‘উপন্যাস বন্ধ করুন’, ‘এত দেখে পড়া শোনা যায় না’সহ নানা কটূক্তি, হাসাহাসি ও হইচই করেন। বেশ কয়েকজন এমপি বারবার স্পিকারের প্রতি মাইক বন্ধের ইশারা করেন। কেউ কেউ সিট ছেড়ে হাঁটাহাঁটি করেন।
একপর্যায়ে খালেদা জিয়া ট্রেজারি বেঞ্চের এক সদস্যের কথার জবাব দিতে গেলে স্পিকার বলেন, আপনি ওদের কথা শুনবেন না। তখন খালেদা জিয়া স্পিকারকে বলেন, ওরা তো কিছুই পারে না—শুধু ডিস্টার্ব করে। এ সময় স্পিকার সরকারদলীয় এমপিদের হৈ চৈ বন্ধ করে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য শোনার আহ্বান জানান। তবে শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সরকারদলীয় এমপিরা হইচই ও নানা কটূক্তি অব্যাহত রাখেন। বিরোধীদলীয় নেতার দ্বিতীয় দফা বক্তব্য শুরু হলে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা অধিবেশনে যোগ দেন।
খালেদা জিয়া বক্তব্য শেষ করে অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। এ সময় সরকারদলীয় এমপিরা ‘ধর ধর’, ‘চোর চোর’ বলে কটূক্তি করতে থাকেন।
সরকার প্রতিবাদ করলে আমরা সমর্থন দেবো : বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, সীমান্তে যখন পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশী হত্যা করা হয়—সরকার কোনো প্রতিবাদ করে না। তিনি ফেলানীর ছবি সংবলিত একটি দৈনিক পত্রিকার সংবাদ দেখিয়ে বলেন, কী অপরাধ ছিল এই ফেলানীর। এ কিশোরী মেয়ে কি চোরাকারবারি হতে পারে? এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে এক বাংলাদেশীকে উলঙ্গ করে নির্যাতন করা হয়েছে।
কিন্তু সরকার প্রতিবাদ করেনি, করতে পারেনি। যখন দু’দেশের সীমান্তরক্ষীদের বৈঠক হয়, তখন বিএসএফ বলে গুলি হয়, গুলি হবে। এটা কি বন্ধুত্বের লক্ষণ? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখানে আছেন। কেন আপনারা প্রতিবাদ করেন না? আপনারা প্রতিবাদ করুন, জনগণ আপনাদের সঙ্গে থাকবে—আমরা সমর্থন দেবো। খালেদা জিয়া বলেন, মহাজোটের অংশীদারও বলেছে।
টিপাইমুখ বাঁধ হলে দেশ মরুভূমি হবে। উত্তরবঙ্গের কথা দেশবাসী জানে। সেখানে নদী শুকিয়ে গেছে, মাটির নিচ থেকে পানি আসছে না। এখন টিপাইমুখে বাঁধ দেয়া হলে মেঘনা শুকিয়ে যাবে। হাওর-বাঁওড় শুকিয়ে যাবে, মাছ থাকবে না।
এছাড়া টিপাইমুখ বাঁধটি তৈরি করা হয়েছে এমন একটি জায়গায় যেটা ভূমিকম্পপ্রবণ। ভূমিকম্প হলে সিলেটের কিছুই থাকবে না, কোনো চিহ্নই থাকবে না। সেখানে যে একটি বিভাগ ছিল, তা-ই থাকবে না। আমরা সরকারকে সহযোগিতার কথা বলেছি। সরকার একটি টিম পাঠিয়েছিল, তারা তো সংসদীয়; টেকনিক্যাল নয়।
তারা কী বুঝবেন। তারা তো হেলিকপ্টার থেকে নিচেই নামতে পারেননি। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, সরকার চুপ থাকলেও আমরা সবসময় প্রতিবাদ করি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখন আলোচনায় তার কাছে প্রতিবাদ করেছি। পরে তাকে চিঠি দিয়েছি।
আপনারা টিপাইমুখের প্রতিবাদ করুন, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।
দেশে আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই : খালেদা জিয়া বলেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই দাবি করুন, এখন আইনশৃঙ্খলা আসলে সবচেয়ে খারাপ। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই অস্বীকার করুন, দেশে প্রতিদিন গুম খুন হচ্ছে। আগে কূটনৈতিক এলাকা নিরাপদ ছিল, এখন সেটাও নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কারও বেডরুম পাহারা দেয়া যাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা হবে কিন্তু করেননি। আমরা মনে করি, খুনিদের ধরা হয়েছিল আবার পাচার করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সৌদি কূটনীতিক হত্যা হয়েছে। প্রতিদিন বাংলাদেশীরা খালি হাতে ফিরে আসছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদি আরব গেছেন, তিনি কী করবেন, জানি না। তবে প্রবাসীরা খালি হাতে ফিরলে অর্থনীতিতে চাপ পড়বে। দেশের বেকারত্ব বাড়ছে। সেদিকে সরকারকে কড়া নজর দিতে হবে। আমাদের দাবি, সাংবাদিক দম্পতি ও সৌদি কূটনীতিকের খুনিকে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগের টেন্ডারবাজিতে জনজীবন অতিষ্ঠ; এমনকি মানুষের বাড়িঘর দখল করছে। এটাই কি দিনবদলের নমুনা, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নমুনা! তিনি বলেন, পুলিশ এখন সরকারি দলের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা দেন। বিরোধী দল হলে গ্রেফতার ও মারপিট করা হয়। সেদিন পুলিশও নিরাপদ ছিল না। পুলিশকে গুলি করেছে।
আমাদের ছেলে হাবিবকে গুলি করেছিল; প্রাণে বেঁচে গেছে। আবারও গুলি করতে গিয়েছিল, তারা ধাওয়া দেয়। পুলিশ ধরতে গেলে পুলিশকে গুলি করে। একজন অ্যাডিশনাল আইজির গাড়ি ছিনতাই হয়েছে। তাহলে মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? এখনও প্রতি রাতে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করা হচ্ছে।
আমাদের একনিষ্ঠ কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এটা বন্ধ করুন; নইলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে—যার দায় সরকারকেই নিতে হবে। আমরা এমন একটা সময়ে আছি—যখন খুন-গুমের উত্সব লেগেছে। চৌধুরী আলমকে সাদা পোশাকে র্যাব ধরেছে। বড় কথা, একবার গুম হলে আর রেহাই নেই।
নালা-ডোবায় লাশ পড়ে থাকে। অনেক সময় লাশ শনাক্ত হয় না। দেশে, এমনকি বিদেশেও এর প্রতিক্রিয়া ঘটেছে—গুপ্তহত্যায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে ব্রিটিশ কথা বলতে ইতস্তত করবে না। প্রতিদিনই খুন হচ্ছে।
এবার ক্ষমতায় এসে ১২ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। নাটোরের উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে খুন করা হয়। গামার খুনিদের ছেড়ে দেয়ায় নতুন করে খুন করেছে। তাহেরের ছেলেদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের ৩৫টি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কয়েক দফা বন্ধ করা হয়।
এসব সংঘর্ষের পেছনে রয়েছে সরকারি দলের কর্মীদের টেন্ডারবাজি, যৌন উত্পীড়ন, পদ না পাওয়া, ফ্রি খাবারসহ অনেক কারণে।
গালাগাল ও গুণকীর্তন শুনতে কি সংসদে আসব : খালেদা জিয়া বলেন, সংসদ এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, গালাগালের আখড়া। যারা বলেছেন, তারা সত্য কথা বলেছেন। দেশের এত সমস্যা, কিন্তু সে সমস্যা নিয়ে কোনো কথা বলা হয় না।
শুধু বিরোধীদলকে গালাগাল করা আর সরকারের গুণকীর্তন করাই যেন একমাত্র কাজ। সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। আমরা না থাকলেও আমাদের বিরুদ্ধে গালাগাল হয়। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী খারাপ ভাষায় কথা বলেন। নতুন সদস্যরা খারাপ ভাষা শিখছেন।
বিরোধী দল বাইরেও আক্রান্ত হয়, সংসদের ভেতরেও কথা বলতে দেয় না। সংসদে সরকারি দলের আকার অনেক বড়। কিন্তু তারপরও কোরাম পূর্ণ হচ্ছে না। সরকারি দলের এমপিরা সংষদে আগ্রহী নয়। দেশ আজ চরম সঙ্কটে।
এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসা সময়ের দাবি। দেশের মানুষ তা-ই চায়। দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। খালেদা জিয়া বলেন, যে সংসদে জনগণের সমস্যা নিয়ে কথা বলা না যায়, তবে এসে কী লাভ। জনসমস্যা নিয়ে বিরোধী দল অনেক নোটিশ দিয়েছে।
সেগুলো গ্রহণ করলে আলোচনা হতো। বিরোধী দলের অংশগ্রহণ অর্থবহ হতো। তিনি স্পিকারকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি একটি নোটিশও গ্রহণ করেননি। তাহলে কি সরকারের গুণকীর্তন ও গালাগাল শুনতে আমরা সংসদে আসব। বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে আমার প্রিভিলেজ আছে।
আমাকে একটু সময় দেন। সব ইস্যুতে তো আমি বলি না, বলতে চাই না। তারা সুযোগ পেলে বলতে পারত। আজকেও অনেক আশা নিয়ে আমার দলের ২০ জন এমপি এসেছেন, অন্তত ১০ মিনিট করে সুযোগ পাবেন। আপনারা বলেছিলেন, চলতি অধিবেশন ২৯ মার্চ পর্যন্ত চলবে।
এখন বলছেন রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা আজই শেষ। কেন এ সিদ্ধান্তের পরিবর্তন? ক’দিন বাড়ালে কী হতো। সবাই কথা বলার সুযোগ পেত। তিনি স্পিকারের উদ্দেশে বলেন, আমাদের নোটিশ গ্রহণ করবেন না, আবার বলবেন সংসদে আসুন। এটা কি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নয়? খালেদা জিয়া বর্তমান সংসদের সমালোচনা করে বলেন, স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ বাদ দেয়া হয়েছে।
বিসমিল্লাহ বাদ দেয়া হয়েছে। বর্তমান এমপিরা ১৫ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা খর্ব করেছে। ভবিষ্যতে যারা এমপি হবেন, তাদেরও অধিকার খর্ব করা হয়েছে—এটা যৌক্তিক নয়। সংসদ ইতিহাসচর্চার জায়গা নয়; এখানে বর্তমান এবং ভবিষ্যত্ নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শেয়ারবাজার লুট হয় : বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, আমরা ক্ষমতায় থাকলে শেয়ারবাজারে কোনো সমস্যা হয় না।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কেন শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি হয়। এবার ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পথে বসেছে। দেড় কোটি পরিবার আজ ক্ষতিগ্রস্ত। তারা এটা প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশ দিয়ে নির্যাতন করা হয়। আজ তারা প্রতিবাদের ভাষাও প্রকাশ করতে পারে না।
তিনজন এরই মধ্যে আত্মহত্যা করেছে। একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল; কিন্তু রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন—যারা জড়িত, তাদের নাম প্রকাশ করতে পারবেন না। তারা অর্থমন্ত্রীর নাগালের বাইরে বলে পারেননি। দেশের গরিব মানুষকে পথে বসিয়েছেন।
তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।
মুখ দেখে বিচারকরা রায় দিচ্ছেন : তিনি বলেন, ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এখন আদালতেও। সেখানে বিরোধী দলের জন্য একরকম, সরকারি দলের জন্য অন্যরকম। এমপিদের বিরুদ্ধে মোবাইল চুরি ও গরু চুরির মামলা দিলে কী সংসদের জন্য লজ্জার নয়! অথচ তারা এমন রায় দিচ্ছেন। একজন বিশিষ্ট আইনজীবী বলেছেন, এখন মুখ দেখে রায় দেয়া হয়।
কিছু কিছু রায় দেখে মানুষ হতবাক হয়ে যায়। এটা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্বিচারে বিচারপতি নিয়োগ দেয়ায়। বিচারপতিরা চেয়ারে বসে রাজনৈতিক কথাবার্তা বলেন। তারা যদি রাজনৈতিক কথা বলতে চান, তবে চেয়ার ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসুক।
কুইক রেন্টাল মানে কুইক মানি লুট : খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ ওয়াদা করেছিল ১০ টাকা সের চাল দেবে, বিনামূল্যে সার দেবে, ঘরে ঘরে চাকরি দেবে।
এখনও মোটা চালের দাম ১০ টাকা নয়। শিশুরা না খেয়ে থাকছে। মা ডিম, দুধ, মাংস কিছুই দিতে পারেন না। শিশুরা পুষ্টিহীন হয়ে যাচ্ছে। শিশুরা পুষ্টিহীন হলে আমাদের ভবিষ্যত্ অন্ধকার।
সরকারকে সেদিকে নজর দিতে হবে। ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের আমল থেকে দারিদ্র্যতা বেড়েছে। সরকারের উচিত সেটা কমিয়ে আনা। দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নেমে আনা। বিনামূল্যে সার দেয়া হবে বলেছিল।
কিন্তু তাও দেয়া হয়নি। দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস সঙ্কট চলছে। দিনের বেলায় গ্যাস থাকে না। সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বাড়ছে। গ্যাস সংযোগের বেহাল অবস্থা।
লাখো কারখানা গ্যাসের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না। এতে অনেক লোকের চাকরি হতো; কিন্তু তা পারেনি সরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আমাদের সময় নাকি ১ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ও উত্পন্ন হয়নি। কিন্তু সরকারি তথ্য আছে ১২শ’ মেগাওয়াট উত্পন্ন ছিল। আমরা যে পরিকল্পনা নিয়েছিলাম, মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন তা বাতিল না করলে দেশের কোনো বিদ্যুত্ সমস্যা থাকত না।
তারা তো দেশের জন্য ভালো কিছু করতে আসেনি। সরকার আজ বিদ্যুেক হরিলুটে পরিণত করেছে। কুইক রেন্টাল মানে কুইক মানি লুট। কুইক রেন্টাল হচ্ছে না, কিন্তু কুইক মানি নিয়ে যাচ্ছে। নতুন বিদ্যুত্ সংযোগ বন্ধ।
আগে শুক্রবার বিদ্যুত্ কম যেত। এখন শুক্রবার-শনিবার নেই। গ্রামে তো এখন বিদ্যুত্ই নেই, মাঝে মাঝে আসে। আজ মঙ্গলবার মতিঝিলে ৪ ঘণ্টা বিদ্যুত্ ছিল না। বাণিজ্যিক এলাকায় ৪ ঘণ্টা বিদ্যুত্ না থাকলে কী হবে বুঝুন।
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে নির্যাতন সংসদের জন্য লজ্জার : খালেদা জিয়া বলেন, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে আমাদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ কীরকম নির্যাতন করেছে—তা বিশ্ববাসী দেখেছে। তাকে পিটুনির পর রক্তাক্ত অবস্থায় টানাটানি করেছে পুলিশ। এজন্য দীর্ঘদিন তাকে বিদেশে চিকিত্সা নিতে হয়েছে। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হলেও এটা কী পুরো সংসদের জন্য লজ্জার নয়? আরেকজন এমপি শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী। অল্প বয়স থেকেই এমপি নির্বাচিত হয়ে আসছেন।
তার ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা কি নির্লজ্জভাবে আক্রমণ করেছিল—তা দেশের মানুষ দেখেছে। সেদিন সাধারণ মানুষ হলে তাকে বাঁচানো যেত না। মহিলা এমপিরাও রক্ষা পাচ্ছেন না এ সরকারের নির্যাতন থেকে। স্পিকার হিসেবে আপনার কাছে এসবের প্রতিকার চাইব—এমপিদের যেন কর্মসূচি পালনকালে লাঞ্ছিত হতে না হয়। আপনি অভিভাবক হিসেবে এসব খেয়াল রাখবেন।
এছাড়াও বিরোধীদলীয় এমপিদের মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। সংসদে বিরাধীদলীয় এমপিরা কথা বলার সুযোগ পান না। এই হচ্ছে আজ বিরোধীদলীয় সদস্যদের সঙ্গে সরকারের আচরণ।
বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তি সংসদে উপস্থাপন করা হয়নি : খালেদা জিয়া বলেন, বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তি সংসদে উপস্থাপন করা হয়নি। কেউ এটা নিয়ে আলোচনা করতে পারেননি।
ক্যাবিনেটের বাইরে সরকারদলীয় এমপিরাও জানেন না সে চুক্তিতে কি আছে। অথচ নিয়ম আছে, বিদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি করলে তা সংসদে উপস্থাপন করতে হবে। তিনি বলেন, ভারত আন্তঃনদী সংযোগ করছে। এ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। তিস্তার পানিচুক্তি হবে বলেছিল।
এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা পানি পাচ্ছি না। তিস্তার পানি আমাদের অধিকার। তিস্তার পানি আমাদের দিতেই হবে। আপনারা আওয়াজ তুলুন, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।
তিনি বলেন, ট্রানজিট দেয়া হলে নাকি বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। এসব নিয়ে অনেক প্রচার চালানো হয়েছে। অথচ আজ আমরা কি দেখতে পাচ্ছি। সিঙ্গাপুর তো নয়, দেখতে পাচ্ছি দেশ পেছনের দিকে যাচ্ছে। জেনেছি বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া হচ্ছে।
ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে। আমাদের বন্দরের প্রয়োজন বেড়েছে। সেখানে আমরা শুল্ক পাচ্ছি না। তাহলে কার স্বার্থে এ বন্দর ব্যবহারের অনুমতি?
ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের সরকার তত্ত্বাবধায়ক নয় : খালেদা জিয়া বলেন, ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক দাবি করে মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করেছে। কিন্তু সেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না।
সেটা ছিল অবৈধ সরকার। তারা জোর করে ক্ষমতা দখল করেছে। তারপর জরুরি অবস্থা জারি করে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। তিনি বলেন, তারা রাস্তার দু’পাশের দোকান ভেঙেছে। মানুষকে রাস্তায় বসিয়েছে।
ভিক্ষুক বানিয়েছিল। তারা ২০ বছর দেশকে পিছিয়ে দিয়েছে।
মহাসমাবেশেই প্রমাণ হয়েছে সরকার জনতার আস্থা হারিয়েছে : বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দেই। ২৯ মার্চ আমরা গণমিছিল দিয়েছি দেড় মাস আগে চট্টগ্রামে। সরকারি দল হঠাত্ একটি কর্মসূচি দিল।
সরকার কৌশল করে ১৪৪ ধারা জারি করাল। সেদিন প্রশাসন দেড় মাস আগের ও দু’দিন আগের বিষয়টি বিবেচনা করলে তাদের আচরণ হতো নিরপেক্ষ। তিনি বলেন, আমরা ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচি দিয়েছি। এ ধরনের কর্মসূচি আপনারা এবং আমরা আগেও দিয়েছি। কিন্তু এবার কেন সরকার এত বিরোধিতা করল বুঝলাম না।
তিনদিন ধরে সরকার রীতিমত হরতাল করল। ঢাকার সঙ্গে দেশের যোগাযোগ বন্ধ করা হলো। যারা কষ্ট করে এসেছেন, তাদের হোটেলে থাকা বন্ধ করা হলো। খাবার হোটেলও বন্ধ করে দেয়া হলো। এটা কি গণতান্ত্রিক কর্মসূচি? এটা তো ফ্যাসিস্ট সরকারের আচরণ।
এ সময় তিনি একটি পত্রিকা উঁচিয়ে সেখানে প্রকাশিত ছাত্রলীগের নৈরাজ্যের ছবি দেখান। তিনি বলেন, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও মহাসমাবেশ মহাসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু টেলিভিশনগুলোকে সরাসরি সম্প্রচার করতে দেয়া হয়নি। খালেদা জিয়া বলেন, সরকার অপপ্রচার করে বিরোধী দল নাকি সন্ত্রাস করবে। কিন্তু সন্ত্রাস করল সরকারি দল।
এটা কি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নয়। দু’দিন পরই মহাজোটের মহাসমাবেশ হলো। সেদিন সারাদেশ থেকে গাড়িতে করে লোক আনা হলো। টাকা, চকলেট, কোকাকোলা দেয়া হয়েছে; তারপরও জনসমুদ্রে রূপ নেয়নি।
আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসন : খালেদা জিয়া তার দীর্ঘ বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের অতীত রেকর্ড থেকে বিভিন্ন কেস স্টাডির মাধ্যমে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ওপরও হামলা চালাতে দ্বিধাবোধ করেনি। ১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই পুরনো ঢাকার ‘রূপমহল’ সিনেমা হলে নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে সেই হামলা হয়েছিল। পরদিন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভাও পণ্ড করে দিয়েছিল আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। মওলানা ভাসানী ছাড়া আহত হয়েছিলেন ‘সীমান্ত গান্ধী’ হিসেবে খ্যাত প্রবীণ নেতা খান আবদুল গাফফার খানসহ অনেক নেতা। এই অঞ্চলের ইয়ার মোহাম্মদ খান, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা এবং মাহমুদ আলী গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সব সময়ই সীমা ছাড়িয়ে যায়।
তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের পহেলা জানুয়ারি ঢাকায় ভিয়েতনাম দিবস পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে সরকারি নির্দেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে ২ জন ছাত্রকে হত্যা করে। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকের খবর থেকে জানা যায়, গুলি বর্ষণে দুইজন ছাত্র নিহত হওয়া ছাড়া একজন প্রেস ফটোগ্রাফারসহ ছয়জন আহত হয়েছে। নিহতরা হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষ দর্শন বিভাগের ছাত্র মতিউল ইসলাম ও ঢাকা কলেজের ছাত্র মির্জা কাদের। ছাত্র হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর গ্রুপ) শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করে।
সভায় ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, হারুনুর রশিদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, আবদুল হালিম এবং কার্যকরী কমিটির সদস্য সাবেক এমসিএ বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাদের বক্তব্যে সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন।
খালেদা জিয়া বলেন, ৩ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত এক সভায় ডাকসু’র ভিপি মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ থেকে শেখ মুজিবর রহমানকে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। তিনি সদস্যপদ বই থেকে সংশ্লিষ্ট পাতাটি জনসভায় ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলেন। সেলিম ডাকসুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে দেয়া ‘বঙ্গবন্ধুু’ উপাধি প্রত্যাহার করেন। তিনি সাবধান করে দেন, ‘সংবাদপত্র, টিভি ও বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে আর ‘জাতির পিতা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ব্যবহার করা চলবে না।
’ তিনি বাড়িতে ও দোকানে টানানো শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলারও আহ্বান জানান।
১১ মার্চ ১৯৭৩ দৈনিক ইত্তেফাকের এক রিপোর্টে জানা যায়: আহাদ সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবি করেছেন, ‘ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতার অপব্যবহার, জাল ভোট প্রয়োগ এবং সন্ত্রাসমূলক কাজের দ্বারা ও দালাল আইনের ভয় দেখাইয়া নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করিয়াছে। ’
অলি আহাদ আরও দাবি করেন, ‘অনুষ্ঠিত নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করিয়া পুনরায় নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করিতে হইবে। ’
১৩ মার্চ ১৯৭৩ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমেদ সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নামে দেশব্যাপী একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়া নির্বাচনী প্রহসন করা হইয়াছে। ’ সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ন্যাপ নেতা রাশেদ খান মেনন সাংবাদিকদের বলেন, ‘জনগণের ভোটে বাকেরগঞ্জ ৮ ও ৯ আসন হইতে আমি নির্বাচিত হইয়াছি।
কিন্তু শাসক দল সুপরিকল্পিত উপায়ে জাল ভোট করিয়া আমাকে পরাজিত ঘোষণা করিয়াছে। ’ খাদ্য-বস্ত্র, দ্রব্যমূল্য হ্রাস, দমননীতি বন্ধ এবং সব ক্ষেত্রে অরাজকতার অবসান ও জান-মালের নিরাপত্তা—এই তিন দফা দাবিতে ১৫ মে ১৯৭৩ সকাল ৮টা থেকে মওলানা ভাসানী ঢাকায় তার দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ২২ মে ১৯৭৩ মওলানা ভাসানীর দাবির সমর্থনে সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। হরতাল চলাকালে বাংলাদেশ বিমানের কর্মচারী নুর হোসেনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলা হয়। আজও তার খোঁজ মেলেনি।
তিনি বলেন, ১৯৭২-৭৫ পর্বে আওয়ামী লীগ শাসনামলে প্রগতিশীল বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাকে সরকারি নির্দেশে হত্যা করা হয়।
বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদারের হত্যাকাণ্ড ছিল এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত। সিরাজ সিকদারকে ১ জানুয়ারি ১৯৭৫ চট্রগ্রামে গ্রেফতার করে বিমানে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বন্দি অবস্থায় তিনি নিহত হন। সরকার বলে, পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে মারা যান সিরাজ সিকদার।
সেদিন বাংলাদেশের কেউ সিরাজ সিকদারের নিহত হওয়া সম্পর্কে সরকারের এই সাজানো কাহিনী বিশ্বাস করেনি; আজও করে না। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সংসদে দেয়া ভাষণে বিনাবিচারের সেই হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’
এভাবে স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রক্ষীবাহিনীকে দিয়ে হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
নিহতদের সঠিক সংখ্যা কোনোদিনই জানা যাবে না। তবে রাষ্ট্রপতি থাকাকালে জেনারেল এরশাদ বিভিন্ন সময় বলেছিলেন, রক্ষীবাহিনী ৩৭ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল। তার দেয়া এই হিসাব পাওয়া যাবে ওই সময়ের সংবাদপত্রে।
রক্ষীবাহিনীর নিষ্ঠুরতার কাহিনী তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের বাংলা আশ্বিন মাস। বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অরুণা সেন, রানী সিংহ ও হনুফা বেগমকে ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার রামভদ্রপুর গ্রাম থেকে রক্ষীবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয় এবং পরে সুপ্রিমকোর্টে তাদের পক্ষে রিট আবেদন করার পর কোর্টের নির্দেশে তাদের আদালতে হাজির করা হয়। মামলার শুনানির তাদের পক্ষে রিট আবেদন করার পর কোর্টের নির্দেশে তাদের আদালতে হাজির করা হয়। মামলার শুনানির সময় সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণযোগ্য অভিযোগ আনতে না পারায় বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ অবিলম্বে তাদের তিনজনকেই বিনাশর্তে মুক্তিদানের নির্দেশ দেন।
অরুণা সেন ও অন্যদের পক্ষে এই মামলা পরিচালনা করেছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। তারা দুজনেই এই সংসদে আছেন। ঘটনার জীবন্ত সাক্ষী তারা।
দুর্ভিক্ষ নিয়ে লেখা বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের একটি প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, আতিউর রহমান আওয়ামী লীগ সমর্থক। তিনি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে আতিউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১৬ নভেম্বর সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যে নিবন্ধ লেখেন তার অংশবিশেষ তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন : প্রাকৃতিক কারণে যে সামান্য খাদ্য ঘাটতি হয়েছিল, তাকে অধিকতর ভয়াবহ করে তোলে তত্কালীন শাসক গোষ্ঠীর কৃপাপুষ্ট চোরাচালানি, মজুতদার, ফড়িয়া প্রভৃতি সমাজবিরোধী। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে কত লোকের মৃত্যু হয়েছিল? সরকারি হিসাব মতে এর সংখ্যা ২৬ হাজার। কিন্তু নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও মহিউদ্দিন আলমগীরের হিসাবে ওই দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর সংখ্যা ১৫ লাখ। আওয়ামী লীগ কখনই সংবাদ-মাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না।
স্বাধীনতার পরপরই তারা সংবাদ মাধ্যমের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ শুরু করেছিল।
গণমাধ্যমের ওপর নগ্ন হামলার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ অবজারভারের সর্বজন শ্রদ্ধেয় সম্পাদক আবদুস সালাম জাতীয় সরকার গঠনের দাবির সমর্থনে ‘দি সুপ্রিম টেস্ট’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন, যা ১৫ মার্চ ১৯৭২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই সম্পাদকীয় প্রকাশের দিনই তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এভাবেই একজন সম্মানিত সম্পাদককে তার অভিমত প্রকাশের জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল । ৩ মে ১৯৭২ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সংবাদদাতা এসএম হাসানকে সাতক্ষীরায় রিলিফ দ্রব্য আত্মসাত্ সম্পর্কে রিপোর্ট করায় গ্রেফতার করা হয়।
ভারত-বাংলাদেশ অসমসম্পর্কের ওপর সমালোচনামুখর হওয়ার কারণে সাপ্তাহিক ‘হক কথা’র সম্পাদক ইরফানুল বারীকে ২০ জুন ১৯৭২ ডিটেনশন দেয়া হয়। সাপ্তাহিক ‘মুখপাত্র’ ও ‘স্পোকসম্যানে’র সম্পাদক ফয়জুর রহমানকে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। একই বছর ৭ সেপ্টেম্বর ‘দেশবাংলা’ অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়। ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ ‘হক কথা’, ‘মুখপাত্র’, এবং ‘স্পোকসম্যানে’র ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়।
তিনি বলেন, ১ জানুয়ারি ১৯৭৩ ঢাকায় ছাত্র হত্যার ঘটনায় সেদিন বিকালেই দৈনিক বাংলা একটি টেলিগ্রাম ইস্যু প্রকাশ করে।
এতে সরকার ক্ষুব্ধ হয়। ফলে দৈনিক বাংলার সম্পাদনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মরহুম হাসান হাফিজুর রহমান এবং সম্পাদক আবদুল তোয়াব খানকে তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের ওএসডি করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৭ জানুুয়ারি জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ বন্ধ করে দেয়া হয়। এর আগে ১৭ মার্চ ১৯৭৪ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির সামনে জাসদের মিছিলে রক্ষিবাহিনী গুলিবর্ষণ করে। এর ফলে ছয় জন নিহত হয় বলে সরকারি ভাষ্যে দাবি করা হয়।
কিন্তু অন্যান্য সূত্রে দাবি করা হয় যে, ১২ জনের মৃত্যু ঘটেছে এবং একশ’ জনের মতো মানুষ আহত হয়েছে। সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের ধারাবাহিকতায় রক্ষিবাহিনী সেদিন রাতেই ‘গণকণ্ঠ’ কার্যালয় দখল করে নেয় এবং সব ধরনের কাগজপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করে। ১৮ মার্চ ১৯৭৪ গণকণ্ঠের সম্পাদক কবি আল মাহমুদ গ্রেফতার হন। ১৯৭৩ সালের ১১ আগস্ট পুলিশ চট্টগ্রামে দৈনিক দেশবাংলার কার্যালয় সিলগালা করে তালা বন্ধ করে দেয়। পত্রিকার দুজন সাংবাদিক এবং ৮ জন প্রেসকর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়।
৬ ফের্রুয়ারি ১৯৭২ সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ এনায়েতউল্লাহ খান ঝরীঃু ঋরাব গরষষরড়হ ঈড়ষষধনড়ত্ধঃড়ত্ং শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন।
এ কারণে তার বিরুদ্ধে সংসদে ও সংসদের বাইরে আওয়ামী লীগের নেতারা অত্যন্ত কুিসত ভাষায় বিষোদগার করেন। এ বিষোদগার থেকে তার স্ত্রীও রেহাই পাননি।
তিনি বলেন, এই সংশোধনী অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তার পদ হারান এবং তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি পদে এমনভাবে অধিষ্ঠিত করা হয় ‘যেন তিনি নির্বাচিত’। দুনিয়ার কোথাও অনির্বাচিত ব্যক্তিকে ‘যেন তিনি নির্বাচিত’ ঘোষণা করে পদে বসাবার কোনো নজির নেই।
এটা গণতন্ত্র নয়। এই চরম স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থা প্রবর্তন কেবল আওয়ামী লীগের পক্ষেই সম্ভব। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জনগণের সব মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করেছিল। বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রপতির কর্তৃত্বের অধীনে ন্যস্ত করেছিল।
দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশালে সরকারি কর্মকর্তা ও সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসারদেরও বাধ্যতামূলকভাবে যোগদান করানো হয়। পরে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেন। সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগকে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা। ১৬ জুন ১৯৭৫ বাংলাদেশের ইতিহাসে আর একটি কালো দিন।
ওইদিন আওয়ামী লীগ সরকার সংসদে নিউজ পেপারস ডিক্লারেশন্স (অসবহফসবহঃ) অর্ডিনেন্স পাশ করে।
এ অর্ডিনেন্স বলে ২৯টি দৈনিক পত্রিকা এবং ১৩৮টি সাপ্তাহিক ও সাময়িকীর প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কেবল দুটি ইংরেজি এবং দুটি বাংলা দৈনিক প্রত্যক্ষ সরকারি নিয়ন্ত্রণে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়।
১৯৯৬ সালের ক্ষমতাকালীন আওয়ামী লীগের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের চিত্র তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, ২১ বছর পর জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে শুধু একটিবারের জন্য সুযোগ প্রার্থনা করে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।