আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভালোবেসো নিজেকে

‘’এখন যদি আগুন লাগে, আর যদি দেখো আমার গায়ে আগুন লেগে গেছে, তাহলে তুমি কী করবে? ’’ ‘’স্যার, আপনাকে বাঁচাবো। ‘’ কথাটা বলার জন্য বলা বা স্যারকে খুশি করার জন্য বলিনি। মনের ভেতরে যা অনুভব করেছি, তাই বলেছিলাম স্যারকে। কিন্তু আমার উত্তরে স্যারকে খুশি মনে হলো না। প্রায় ধমকে উঠলেন আমাকে।

‘’না, তুমি আগুন থেকে দূরে চলে যাবে, আমাকে বাঁচানো লাগবে না। ‘’ ‘’আমি চলে যাবো!!!!” আমার এত্ত অবাক লাগে স্যারের কথা শুনে। সবাই তো উল্টোটাই বলে, অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার কথাই শেখায় সবাই। ‘’হ্যাঁ, চলে যাবে। সব কিছু পুড়ে যাক, যদি আমিও পুড়ে যেতে থাকি, তবু তুমি আগে নিজেকে বাঁচাবে।

অন্যের কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। ‘’ ‘’স্যার আপনাকেও বাঁচাবো না?’’ আমার বিশ্বাস হতে চায় না স্যারের কথা। ‘’মানুষ নিজেকেই সবচেয়ে ভালবাসে। নিজের কথাই মানুষ আগে ভাবে। অন্যকে রক্ষা করার কথা কেউ ভাবে না।

এটাই সত্যি। তোমাকেও আগে নিজেকে বাঁচাতে হবে। ‘’ স্যারের কথা আমি মেনে নিতে পারি না। আমার সামনে স্যার পুড়ে মারা যেতে থাকবে, তবুও আমি পালিয়ে যাবো? স্যারের বাসা থেকে পড়া শেষ করে বাসায় ফিরেও প্রশ্নটা মাথা থেকে যায় না। এরপরেও অনেক বার ভেবেছি কথাটা।

কোথাও চুপচাপ বসে থাকলে হঠাৎ মনে হয়েছে, এক্ষুনি এখানে আগুন লেগে গেলে বা ভীষণ বিপদজনক কিছু ঘটলে আসলে আমার কী করা উচিত? আগে নিজেকে বাঁচানোর জন্য বিপদ থেকে পালিয়ে যাওয়া নাকি বিপদগ্রস্থ মানুষজনের পাশে দাঁড়ানো? হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে, আমি আমাকে ভালবাসি। এত সহজে মরে যেতে চাই না, ব্যথা পেতে চাই না। তাহলে আমার করণীয়টা কী? আমার ছোট্ট মাথায় এর উত্তর আসে না। যে শিক্ষকের কথা বলছি, তিনি আমাদের স্কুলে বিজ্ঞান পড়াতেন। স্যারের ক্লাস আমাদের ভীষণ প্রিয় ছিল।

মনে মনে ইচ্ছে হতো স্যারের মত হবার। স্যারের ক্লাস মানেই বিশেষ কিছু। যেমন রসিকতা করে ক্লাস মাতিয়ে রাখতেন, তেমনি প্রত্যেক ক্লাসেই নতুন কিছু জানতে পারতাম। স্যার জানতেন, কীভাবে কৌতুহলকে উস্কে দিতে হয়। ক্লাস নাইনে উঠে কয়েকজন বন্ধু বান্ধবী স্যারের বাসায় ব্যাচে পড়তাম।

স্যার বলতেন, ‘’আমি কিন্তু তোমাদের পড়াই না, তোমরা পড়। ‘’ আসলেই ঠিক তাই, স্যার আমাদের পড়াতেন না। এমন এক নিয়মের মধ্যে তিনি আমাদের বেঁধে ফেলেছিলেন যে, আমরা নিজেরা নিজেরা ঠিক করতাম কোন পড়াটা পড়ে আসবো। পরের দিন স্যার আমাদের হাতে প্রশ্ন ধরিয়ে দিতেন। কত দিন এমন হয়েছে, স্যার বাসায় নেই অথচ আমরা ঠিকই সময়মত পরীক্ষা শুরু করে ঠিক সময়ে শেষ করেছি।

অথচ একটুও দেখাদেখি করি নি একে অন্যের সাথে। পরীক্ষা শেষে একজন আরেকজনের খাতা মূল্যায়ন করেছি। খাতা মূল্যায়ন করতে গিয়ে বন্ধুদের সাথে রীতিমত তর্ক বিতর্ক হতো, কেন এখানে নম্বর দেওয়া হয় নি, কেন নম্বর দেওয়া হলো। এইসব করার জন্য আমাদের তাই খুব ভাল করে পড়াগুলো বুঝে নিতে হতো। আর এটাও কিন্তু আমরা নিজেরাই করতাম, একে অন্যকে পড়া বুঝিয়ে দিলাম।

আমাদেরও দারুন উৎসাহ হত, এ কাজগুলো করতে। (পরে নিজে বি.এড আর ট্রেইনিং করতে যেয়ে শিখেছি, এটাই নাকি অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষার্থীরা থাকবে সক্রিয়, আর শিক্ষক ফ্যাসিলেটেটর। ) আমাদের মধ্যে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল, নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করতে চাইতাম আমরা। ঈর্ষাও ছিল, তবে সেটা মাত্রাছাড়া বা ক্ষতিকর ছিল না। ঐ বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে অমন একটু আধটু ঈর্ষা, মান-অভিমান থাকেই।

স্যারের বাসাটাকে নিজের বাসা বলেই মনে হতো আমাদের। স্কুল ছুটির পরে পড়তে যেতাম যেদিন, সেদিন আমাদের জন্য নাস্তা থাকতো টেবিলে। অবশ্য মাঝে মাঝে স্যারের উপরে বিরক্তও হতাম। হয়ত কোন কোন অংকের ব্যাখ্যা ঠিক মত বুঝিয়ে দিতে পারতেন না। সাথে সাথে নিজের অপারগতার কথা স্বীকার করে নিতেন।

পরে নিজে বড় হবার পরে যখন টিউশনি করতাম, শিক্ষার্থীকে ঐ অংক বুঝিয়ে দিতে গিয়ে অবাক হয়েছি! এত সহজ অংক স্যার ব্যাখ্যা করতে পারেন নি! পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা হতো। স্যার হয়ত অল্পই জানতেন (আসলে বেশি জানা কি কারো পক্ষে সম্ভব?), তবে যেটুকু জানতেন, সেটুকু খুব সুন্দর করে বোঝাতে পারতেন। স্যারের জন্য সাথে সাথে আবারও একটা গভীর বেদনা ভেতরটা মুচড়ে দিতে শুরু করে। স্যারের কাছে টানা দুই বছর ব্যাচে পড়েছি। এস.এস.সি. পরীক্ষা শেষ করে অবসর সময় কাটাচ্ছি, এমনই এক দুপুরে খবর পেলাম, স্যার হঠাৎ করে চলে গেছেন।

স্যারকে এক নজর দেখার জন্য স্কুলে শিক্ষার্থীদের ঢল নামলো। স্যারকে দেখে মনে হলো, যেন কী এক প্রশান্তিতে হাসছেন! আর কিছুদিন পরেই আমাদের এস.এস.সি. পরীক্ষার ফলাফল দেবে, স্যার সেটা জেনে যাবার প্রয়োজন মনে করেন নি! পরে স্যারের স্ত্রীর কাছে শুনেছি, তিনি নাকি প্রায়ই আমাদের ব্যাচটার কথা বলতেন। আমাদের পড়াতে তাঁর নাকি এত ভালো লাগতো। এজন্যই বুঝি আমরা পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়ে গেলেও স্যার আমাদের ছুটি দিতে চাইতেন না! স্ত্রীর কাছে আক্ষেপ করে বলতেন, ‘কতজনের ছেলেমেয়ে আমার কাছে পড়ে পাস করলো। আমার ছেলেমেয়েদের আমি কবে পড়াতে পারবো?’’ নার্সারিতে পড়া ছেলে আর ক্লাস এইটে পড়া মেয়েকে রেখে স্যার চলে গেলেন।

তাঁর স্বপ্ন পূরণ হলো না। আমাকে যদি কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আমার প্রিয় শিক্ষক কে, প্রথমে আমি বলব এই গিয়াসউদ্দিন স্যারের কথা। এরপরেও দারুন কিছু শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ আমি পেয়েছি। তাঁরাও আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে নিজেকে ভালবাসতে হয়, নিজেকে ভালবেসে অন্যকে ভালবাসতে হয়। স্যারের ঐ প্রশ্নটা হয়ত ছিল আমার আইকিউ পরীক্ষা করার জন্য (উত্তরটা তো এমনও হতে পারতো, গায়ে পানি ঢেলে দেব!)।

মাঝে মাঝে মনে হয়, স্যারকে যদি পেতাম তবে তাঁকে আমি এই প্রশ্নটা করতাম, ‘’ স্যার, এখন যদি আগুন লাগে, আর যদি দেখেন আমার গায়ে আগুন লেগে গেছে, তাহলে আপনি কী করবেন?’’ প্রশ্নের উত্তরে যাই বলুন না কেন, সত্যি সত্যিই যদি এমন কিছু ঘটত, তবে স্যার কী করতেন, সেটা হয়ত আমি আজ জানি। ১৯ মার্চ, ২০১২ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।