ওওম শান্তি যারা চিন্তাশীর নিজেদের জীবন যাত্রা, পরিদৃশ্যমান পৃথিবী, অদৃশ্যমান মহাজগত, সুষমামন্ডিত বিশ্ব প্রকৃতি এবং দৈনন্দিন কর্ম প্রবাহ তথা অলঙ্ঘনীয় মৃত্যু ও মৃত্যুত্তর অজ্ঞাত গন্তব্য সম্পর্কে তাদের পবিত্র কোরআন বার বার বিভিন্ন প্রসঙ্গ বর্ণনার সময় উদাত্ত কন্ঠে আহ্বান জানায় : " এটি (আল-কোরআন) মানুষের জন্য একটি সুসংবাদনামা এবং যাতে এরদ্বারা ভীত হয় এবং যাতে জেনে নেয় যে, উপাস্য তিনিই একক এবং যাতে বুদ্ধিমানরা চিন্তা-ভাবনা করে। "
"আমি এই কোরআনে নানাভাবে বুঝিয়েছি, যাতে তারা চিন্তা করে। অথচ এতে তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়। "
"আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি, তাতে পর্বতমালার ভার স্থাপন করেছি এবং তাতে সর্বপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ উদগত করেছি। এটা জ্ঞান আহরণ ও স্মরণ করার মত ব্যাপার প্রত্যেক অনুরাগী বান্দার জন্যে"
"তারা কি উড়ন্ত পাখিকে দেখে না ? এগুলো আকাশের অন্তরীক্ষে আত্তাধীন রয়েছে।
------- নিশ্চয়ই এতে বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে"
এরকম অসংখ্য উদ্বৃতি পবি্ত্র কোরআন থেকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেয়া যাবে, যেখানে মানুষকে, বিশেষত: চিন্তাশীল সম্প্রদায়কে বার বার চিন্তা করতে বলা হয়েছে। যাদের জ্ঞান রয়েছে, কেবল তারাই চিন্তা করে, আর চিন্তা করে বলেই তাদের দায়িত্ব হয়ে দাড়ায় সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করে মানুষকে বোঝানো। এ কারনে মহাজ্ঞানী আল্লাহ স্বয়ং তার পছন্দনীয়, নির্বচিত, মনোনীত বান্দাকে অত্যুচ্চ জ্ঞানের মাহমায় অভিষিক্ত করেছেন, অত:পর জীবন-জগতের বহুবিধ রহস্য সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব যারা চিন্তার মাধ্যমে, গভীর অধ্যয়ন ও অনুধ্যানের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি ও স্রষ্টার সম্পর্কে, বিশ্বের অগ্রগতি, সমাজের বিবর্তন ধারা এবং মৃত্যুর পরে নির্ধারিত পরকাল সম্পর্কে তাদের কাছে পবিত্র কোরআন চিরঞ্জীব, আলোর উৎস, সৃষ্টিকর্তা মহাপরিকল্পনাকার-এই সত্য পরিস্ফুট হয়ে উঠে।
একটি বিষয় আগেই পরিষ্কার করে নেয়া ভাল যে, ইসলাম যে জ্ঞানের কথা বলে, তাতে অক্ষর সম্পন্ন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা জরুরী নয়; তবে অক্ষরজ্ঞান থাকলে ভাল হয়।
কারন আল্লাহ মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন কলম দ্বারা, যা মানুষ জানত না। যাদের হৃদয় অন্ধ নয়, মন বিভ্রান্ত নয়, বিবেক নিষ্কৃয় নয়, চক্ষু উৎপাটিত নয় এবং কর্ণদ্বয় উন্মুক্ত তারা একটু চেষ্টা করলে এ সত্য নির্ভূলভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন যে, ইসলাম শুধু একটি ধর্মের নাম নয। যুক্তি যেখানে শেষ, বিজ্ঞানের গতি যেখানে স্থির ও স্থবির, ধর্ম সেখানে মানুষকে ভয়াবহ আযাব ও মনোরম প্রশান্তির আভাস দিয়ে বার বার মহান এক স্রষ্টার প্রতি তাদের আনুগত্য দাবী করছে এবং বিজ্ঞানের উন্নতি যত আকাশস্পর্শী হোক- ধর্মের আহ্বান মানবজাতি কখনো নির্দয়ভাবে উপেক্ষা করতে পরে নি।
অতএব আবেগময় উচ্ছ্বাস পরিহার করে, আপাতত স্বচ্ছ দৃষ্টিতে ইসলামকে দেখবার চেষ্টা করা যাক। সাধারনত: আমরা ধর্মকে একটা বিশ্বাস সর্বস্ব কিছু প্রাচীন বিষয়ে বদ্ধমূল ধারণা ও কিছু নিত্যনৈমিত্তিক আচার-অনুষ্ঠানের সারাংশ মনে করে থাকি।
একথা আমরা বিজ্ঞানী ও সমাজতত্ত্ববিশারদদের ব্যাখ্যা মাতে মত মিলিয়ে স্বীকার করে নিয়েছি যে, মানুষ প্রাচীনকালে গুহায় বাস করত, এবং জীব জন্তুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টায় গাছের ডালে থাকত এবং প্রকৃতির অসংখ্য শক্তি যেমন সূর্য, বায়ু, পানি, আগুন, প্রভৃতির কাছে অনুগত্য করত। কালক্রমে মানুষ তার বুদ্ধি বলে প্রকৃতির এই শক্তিসমূহকে জয় করে, কিন্তু তার মন থেকে সেই আদিম অনুগত্যের স্মৃতি মুছে যায়নি। ফলে এখনো হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা প্রকৃতির নানা শক্তিপুঞ্জকে পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করে থাকে। পারস্যের জরসুষ্টবাদীরাও প্রাচীন অগ্নিপূজকদের মত। অতএব এই প্রকৃতির শক্তিপূঞ্জে বিশ্বাস ও ভক্তি বিজ্ঞানের চোখে একটা অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কার রূপে প্রতিভাত হয়; এবং সে কারনে বিজ্ঞান, বিশেষত আজকের বিজ্ঞান, ধর্মের কথা যেন শুনতেই পারে না।
হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্ট ধর্মের মত ইসলামকেও অনুরূপ একটি ধর্মরূপে এক খাচায় বন্দী করে বিবেচনা করলে নিশ্চয়ই যে কোন পর্যবেক্ষক সঠিক বিচার করবেন না। তার একমাত্র কারন ইসলাম যে ধর্মের কথা বলে, তার প্রতিটি বাক্য শুরু থেকে অদ্যবধি নির্ভূলভাবে একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে; এবং পরবর্তি প্রজন্মসমূহের জন্যেও অবিকৃতভাবে তা গতিশীল থাকবে। কিন্তু অন্যকোন ধর্মের নিভূল ধর্মগ্রন্থ বা দলীলপত্র নেই। আর একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠালগ্নে এর পেছনে আত্মত্যাগকারী সাহাবী বৃন্দের জীবনযাপন মানব ইতিহাসের যে কোন যুগে, যে কোন দেশে, যে কোন সমাজে কেবল দূর্লভ নয়, অচিন্তনীয়। তাদের প্রশ্নাতীত সংযম ও ত্যাগ, অত্যুচ্চ আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং সমাজ ও জনগনের ভবিষ্যত ভাবনায় অবিচল থাকা এক মহান দৃষ্টান্ত হয়ে রয়ে গেছে ভবিষ্যত মানবজাতীর জন্য।
অতএব ইসলামকে উপলব্ধি করতে প্রয়োজন ইতিহাসের নির্ভূল সাক্ষ্য, গভীর অধ্যয়ন এবং প্রশস্ত বিবেক সচেতন অনুধ্যান। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বার বার দাবী করেছেন, তিনি মহাজ্ঞানী, সূক্ষ্মদর্শী এবং সর্ববিষয়ের নিয়ন্তা। ফলে তার মনোনিত ধর্ম ইসলাম উপলব্ধির জন্য পাঠকের সর্বোচ্চ বোধ ও বিবেকাংশ সক্রিয় রাখা প্রয়োজন।
মানুষকে খুব সামান্যই জ্ঞান দেয়া হয়েছে; সেই সামান্য জ্ঞানের উপর অসামান্য জ্ঞানের আলাকবর্তিকা- এই কোরআন নাযিল করেছেন স্বয়ং আল্লাহ পাক; তবে একথা আরো সত্য যে মানুষের মধ্যে খুব সামান্য অংশই উপলব্ধি করে এবং সেভাবে জীবন পরিচালনা করে। কোরআন বলছে, যারা আল্লাহর নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় দ্বিধাহীনভাবে বিশ্বাসী, তাদেরকে কিছু নিত্য নৈমিত্তিক কর্মানুষ্ঠান উদযাপন করতে।
যেমন প্রত্যহ পাচ ওয়াক্ত নামায, রোযা পালন, যাকাত প্রদান ও সঙ্গতি থাকলে জীবনে অন্তত একবার হজ্জ্বব্রত পালন। এসব কর্মানুষ্ঠান, যা দৈহিক শ্রম, অর্থ বিনিয়োগ ও ব্যাপক চিত্ত সংযম দাবী করে এবং এগুলো পালনের প্রতি আল্লাহর কঠোর নির্দেশ রয়েছে; যার সুফল এত সুদূরপ্রসারী যে তা ব্যাখ্যা করবার কলম আল্লাহ খুব অল্প জ্ঞানীকেই দিয়েছেন।
উপরিউক্ত ধর্মনুষ্ঠানে ব্যাপৃত যে কোন লোককে আমরা বাহ্যিকভাবে সনাক্ত করতে পারি একজন মুসলমান রূপে। আসলে এই অনুষ্ঠানগুলো উদযাপনে একজন মুসলমানের পরিচয় সম্পূর্ণতা অর্জন করে না। যারা কোরআন উপলব্ধির জন্য পাঠ করে নি, যারা ইসলামের উদ্ভব ও বিকাশের নির্ভূল পথ ও পক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞাত নয়, যারা সমগ্র সৃষ্টি জগতের সূক্ষ্ম শৃঙ্খলা অনুধাবনের জ্ঞান রাখে না; রোযাদারদের সঙ্গে উপোস করে কিন্তু অশ্লিল ভাষাবুলি পরিহার করে না; অধিক সম্পত্তির জোরে হজ্জ্ব যাত্রীদের সঙ্গে সওয়ার হয় কিন্তু আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জ্যোতির্ময় মহিমা কখনো উপলব্ধি করে না-এমন ঈমানদার মুসলমানদের জন্য সত্যি অনুতাপ; তারই ইসলাম ধর্মকে একটা সংস্কারের পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে।
আর সত্য-মিথ্যার প্রভেদ তাদের কাছে খুব সামান্যই।
আজ হিন্দু ধর্মের মত ইসলাম ধর্ম, বিশেষত এদেশের মারাত্মক পৌত্তলিকতার জ্বরে আক্রান্ত হতে চলেছে। আমরা ত্রিপিটকের কথা বলতে পারি, যেখানে বুদ্ধের কষ্টদীর্ণ সাধনায় অর্জিত জীবনোপলব্ধি অর্থৎ দু:খ থেকে মুক্তির উপায় নির্দেশ রয়েছে অসংখ্য ভঙ্গিমায়; অথচ একটি শিশু কিভাবে জন্মগ্রহণ করে , তার দৈহিক ও শারীরিক গড়ন যে বৈজ্ঞানীক সত্য সে বিষয়ে কিছু্ই লেখা নেই। যদিও মানুষের শিশু হিসেবে জন্মগ্রহণ করার মধ্যে যে বৈজ্ঞানীক সত্য বা ধাপগুলো রয়েছে তা চিন্তাশীল সমাজের জন্য কত না জরুরি।
যারা অগ্রসর পাঠক, পাঠ করতে ভালবাসেন, তারা অন্তত কোরআন বাদে অন্য তিনচারটি ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে দেখবেন; এবং জানবেন , একটি সমাজ পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত হবার জন্য একজন আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীর কাছে যা অত্যন্ত জরুরী তার কি কি উপকরণ পাওয়া যায় সেখানে।
আমরা একটি সমাজের মধ্যে বাস করি; সমাজের একটি ঐতিহাসিক বিবর্তন ধারা রয়েছে, যেমন বর্তমানে আমরা দেখছি এ সমাজে কিছু প্রতিষ্ঠিত বিধি-বিধান চালু আছে যা আমাদেরকে মেনে চলতে হয়, এর মূল উৎস কোথায় ? এ সমাজের জনগোষ্ঠি অশিক্ষা ও অজ্ঞতার কারণে জীবনসচেতন ছিল না। প্রকৃতির শক্তিপুঞ্জের কাছে দ্বিধাহীন আত্মসমর্পন ছিল তাদের গৌরবময় অনুভুতি; এবং সে কারনে আজও অন্ধআনুগত্যের মাধ্যমে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছেন। নগ্নভাষায় বলতে গেলে এরা ধর্ম ব্যবসাজীবী হীনতর প্রাণী বিশেষ। যদি ধর্মের সত্যিকার জ্ঞান থাকত, ধর্মের উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধ এই তুচ্ছ জীবননির্বাহক ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বিনষ্ট হয় এবং অশিক্ষিত সাধারন মানুষ আচার সর্বস্ব, আত্মশোধনের চেয়ে দৈহিক শুদ্ধি স্রষ্টার করুনার চেয়ে কঠোরতার চিত্রই বেশী দেখতে পায়, তাহলে ঐ সব ধর্মজীবীরা অত্মকেন্দ্রিকতার মধ্যে ধর্ম প্রচারের সীমানা নির্দেশ করতেন না।
ইসলাম জ্ঞানীর ধর্ম।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ অসংখ্য বার এই একটি কথাই যেন বুঝাতে চেয়েছেন। মুর্খের জন্য কোরআন কেবল বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি করে। আল্লাহ স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন- 'এটি কিতাব, এর আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত আরবী কোরআন রূপে জ্ঞানী লোকদের জন্য'
'আমি এ কোরআনে মানুষের জন্য সব দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছি যাতে তারা অনুধাবন করে। '
জ্ঞানী লোক কারা ? কোরআন কাদেরকে জ্ঞানী লোক মনে করে ? অবশ্যই বিশদ আলোচনা পূর্বে এ ক্ষুদ্র পশ্নের উত্তর জেনে নেয়া ভাল। জ্ঞান একটি শক্তি, যা ব্যাক্তির চিত্তকে জাগ্রত করে; জীবন জগত-সমাজ-সংসার সম্পর্কে প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে তোলে, প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং ব্যাক্তির মধ্যে ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর রহস্য সম্পর্কে অসংখ্য জিজ্ঞাসার জন্ম দেয় এবং এসব জিজ্ঞাসার উত্তর সন্ধানে জিজ্ঞাসু যে মাধ্যমটি ব্যাবহার করেন তাই হল জ্ঞান।
জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক দুরকম, একটি ইন্দ্রিয়জাত, অন্যটা অতি-ইন্দ্রিয়। পঞ্চম ইন্দ্রিয়ের এই দেহ একটি বস্তুপিন্ড, অথচ এই বস্তুপিন্ডটির মধ্যে রয়েছে অতিক্রিয় পর্যায়ের ধরা ছোঁয়ার বাইরে কেবল অনুভব যোগ্য একটি আত্মা-মন বা হৃদয়। দেহ মাটির তৈরী; পচনশীল এবং আত্মা নূরের তৈরী, অমর। যখন সাধারণ লোক মহানবীকে প্রশ্ন করেন, আত্মা কি? আল্লাহ মহানবীকে তার উত্তরে বলতে পরামর্শ দিয়েছেন, "আত্মা আল্লাহর হুকুম"। আত্মা কি করে আল্লাহর হুকুম হয় ? কথাটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
আমরা হিন্দুদের পূজানুষ্ঠান দেখি। স্বরস্বতী বা দূর্গার দশহাতী মূর্তির সামনে গড় হয়ে হা্টু গেড়ে বসে থাকা পূজার্থিরা অনুনয় বিনয় করেন, কিন্তু মূর্তির কন্ঠ থোকে কোন জবাব নেই। ঠন ঠনে ছাঁচে ঢালাই করা কাঁচা মাটি দিয়ে আল্লাহ মানুষকে প্রথমে একটি মূর্তির মত তৈরী করলেন, অত:পর মূর্তিকে কথা বলার হুকুম দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে মুর্তিটি কথা বলে উঠল। অথচ আমরা মাটির একটি মূর্তিকে যদি হাজার বছর হুমুম কিংবা তোষামদ করি, মূর্তিটি কখনো কথা বলবে না। কারন আমাদের হুকুমের মধ্যে শব্দ আছে কিন্তু কোন ক্ষমতা নেই, যে ক্ষমতা মাটির মূর্তির মধ্যে প্রবেশ করে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
অথচ আল্লাহ হুকুম দেয়ামাত্র মূর্তির বাকশক্তি খুলে গেল; আল্লাহর জিজ্ঞাসার জবাব দিল। এটা এক মহাকৌশল। এই যে হুকুমরূপ আত্মা মানবদেহে প্রবিষ্ট করানো হয়েছে, তার মধ্যে আবার শ্রেনীভেদ রয়েছে। দেহগত গঠনে যত বৈচিত্র্য মানুষের আত্মগত প্রকৃতিতে তার চেয়ে বৈচিত্র অনেক বেশী। দেহের গড়নে মানুষ ছোট বড় কালো-সাদা কিন্তু আত্মার প্রকৃতি মানুষে মানুষে এতবেশি পার্থক্যপূর্ণ যে তা হিসেব করা মানবীয় বুদ্ধির পক্ষে অসাধ্য।
আমার প্রারম্ভিক বক্তব্য ছিল ইসলাম জ্ঞানীর ধর্ম। এ কথার ব্যাখ্যা ও সত্যতা যাচাই করা। আমরা কিভাবে এর সত্যতা যাচাই করব ? আমরা বিশ্বের পাঁচটি ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থকে দেখতে পাই যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের আনুগত্য আদায় করেছে। হিন্দু ধর্মের বেদ গন্থের চারখন্ডের বিষয়বস্তু চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, পানি থেকে শুরু করে প্রকৃতির শক্তিপূঞ্জের মাহাত্ম বর্ণনায় পরিপূর্ণ; কিন্তু দু:খের বিষয়, স্বামীর মৃত্যুকালে স্ত্রী কিভাবে বেচে থাকবে, স্বামী ও স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হলে স্ত্রী কীরকম ব্যাবহার লাভ করবে, নি:সন্তান স্বামী হারা স্ত্রীলোকের দায়ভার কে বহন করবে এর কোন সমাধান নেই। খৃষ্টানদের বাইবেল (পুরাতন ও নতুন নিয়ম) উভয়টিতে হযরত আদম (আ থেকে আরম্ভ করে হযরত ঈসা (আ পর্যন্ত বিভিন্ন নবীর আগমন, পৃথিবী সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে বহু বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে, এমনকি হযরত ঈসা নবীর বহুবিধ অলৌকিক ঘটনা-যেমন মৃত ব্যাক্তিকে জীবিত, রোগীর রোগ দূর করা ইত্যাদি থাকলেও দৈন্দিন সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত খুব সামান্য।
আল্লাহ বার বার পূর্ববর্তী গ্রন্থের অস্তিত্বকে স্বীকার করার উপদেশ দিয়েছেন কোরআন অনুসারীদের; যেহেতু সেগুলোও তিনি প্রেরণ করেছিলেন তার মনোনীত নবী ও রাসূলগণের কাছে। সেসব গ্রন্থের মধ্যে ইঞ্জিল, তাওরাত, যাবুর প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থে যত গভীর বাণী ও বক্তব্য থাকুক; পবিত্র কোরআনের অবতীর্ন প্রথম বাণীটির মত গুরুত্ববহ তাৎপর্যপূর্ণ বাণী সেগুলোতে আছে কিনা সন্দেহ। পৃথিবীর অতীতকালের সকল ধর্ম ও ধর্মসম্প্রদায়, মানুষ ও মানবসম্প্রদায়ের সাম্মলিত জ্ঞান বুদ্ধির চেয়ে এই কয়টি কথা চিরদিনের জন্য মহামূল্যবান এবং এর তাৎপর্য মানুষের চিন্তার শৃঙ্খলাকে বার বার বিচলিত করে তুলবে।
"পাঠ করুন আপনার পালন কর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট বাঁধা রক্তবিন্দু থেকে।
পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি মলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। " (সূরা আলাক:১-৫)।
মহান করুণাময়ের ধ্যানমগ্ন, জগতের নিষ্কলুষ সৃষ্টি, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স এর উপর সর্ব প্রথম নাযিল হয় উপরের বাণীগুলো। "মানুষ জমাট রক্ত বিন্দুর তৈরী, এবং কলম দ্বারা তাকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, যা সে জানত না"। মানুষকি জানত তাকে এক বিন্দু অপবিত্র রক্ত থেকে পয়দা করা হয় ? আর কলম দ্বারা মানুষ শিক্ষা অর্জন করে,-এটা কতবড় বৈজ্ঞানিক সত্য।
এমন সত্য কথা কোথায় পাওয়া যায়। কলম শিক্ষার মাধ্যম, কলমকে আমরা জ্ঞান শক্তির প্রতীক মনে করি, এই কলমের শক্তি, শত তরবারীর শক্তির চেয়েও বড়। মানুষ যা জানত না, কলম তা মানুষকে জানায়।
জীবন ও জগত, সমাজ ও ভবিষ্যতকে জানবার যে ব্যাকুলতা আমাদের হৃদয়কে আলোড়িত করে, তার সান্ত্বনা এনে দেয় কলম এবং কালাম। কলম-লেখনী, কালাম-বাণী; পবিত্র বাণী এবং যারা জ্ঞানী তারা অনুধাবন করে, জ্ঞানীদের অনুধাবন করাই কাজ, আর মূর্খদের মুখফিরিয়ে চলাই স্বভাব।
অতএব যারা কলম ও কালামের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম তারাই জ্ঞানবান।
জ্ঞানীরা যুক্তিবাদী এবং ভাববাদী উভয় স্বভাবের, জানবার কৌতুহল তাদেরকে জ্ঞানপ্রেমী করেছে, তাই সতোজ্জ্বল লাবণ্যময়ী স্ত্রীর সান্নিধ্যও তারা তুচ্ছ করে দেখতে পারেন। স্রষ্টার ধ্যান কল্পনায় অভিভূত এসব প্রেমিক পাগল নিদ্রাহীন নয়নে আল্লাহর সৌন্দর্য উপলব্ধি করেন। কত সুন্দর তাদের এই স্বভাব। হৃতয় ও বিবেককে কেবল মহান করুণাময়ের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করার কাজে নিয়োজিত করে তারা কত ধন্য, এ সৌভাগ্য আল্লাহ যাদেরকে থাকেন সত্যি তারা মহাপুরুষ।
আবেগের প্রেরণা বাদ দিয়েও নিরেট যুক্তি ও বিজ্ঞানময়তার দিক থেকে ইসলামকে বিচার করলে একটি সত্য বেরিয়ে আসে যে ইসলাম আধ্যাত্মবাদের কথা যত ভাবাবেগের সঙ্গে তার মরমী শ্রোতার কাছে উপস্থিত করুক, একটি সরল বস্তুবাদীর নিকট ইসলাম তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য যথেষ্ট যুক্তি ও শৃঙ্খলার দাবী করতে পারে। কারন ইসলাম গড়ে উঠেছে জীবনের সর্বাধিক বাস্তবতার কেন্দ্র ভূমিতে। যারা চৌদ্দশ বছর পূর্বে, মহানবীর আগমনের সমকালে আরব মরুভূমির বাসিন্দা ছিল, তাদের কাছে আক্ষরিক শিক্ষার অভাব থাকতে পারে, কিন্তু অর্থনৈতিক সাম্য, সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক শৃঙ্খলা তথা ব্যাবসা-বানিজ্যে সততার তাৎপর্য উপলব্ধির জ্ঞান একেবারে কম ছিল না। ফলত মহানবী (স এর দৃষ্টিভঙ্গিতে যখন তারা ওয়াদা পলনের দৃঢ়তা, সাক্ষ্যপ্রদানে সততা, বিচারে বিচক্ষণতা ও ন্যায়পরায়নতা, মমতা এবং অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে ন্যায়ানুগ কঠোরতা দেখতে পেল তখন তারা দলে দলে আল্লাহর এ মহান শিক্ষকের পদ ছায়ায় আশ্রয় প্রার্থনা করল এবং শেষ বিদায় হজ্জ্বের ভাষনে আরাফাতের ময়দানে সমবেত উত্তাল জনতা কি প্রমাণ করে নি, একজন অসহায় মানুষ সত্য ও ন্যায়ের সম্প্রচার করে শেষ অব্দি সুমহান স্বীকৃতির ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি সেদিন সমগ্র পৃথিবীর সর্বত্র অন্দোলনের ঢেউ তুলেছিল। আজ বাংলাদেশের কোন কুটিরে বসে, চৌদ্দশ বছর পরে একজন অধম ও অজ্ঞ, জ্ঞান পাপী কোন নাস্তিক যদি সেই বিজয়ের মূহুর্তকে অনুমান করতে চায় তাহলে বার বার একটা অলৌকিকতার মোহনীয় ছায়ায় বাধাপ্রাপ্ত হবেন।
এতএব সত্যের বিজয় কত সুন্দর মানুষের মধ্যে, মহান করুনাময়ের প্রকাশ কত তীব্র ও উজ্জ্বল, তার সর্বশেষ ও সর্বাঙ্গ সুন্দর দৃশ্য চিরকালের জন্য একবার ঘটেছিল আরাফাতের ময়দানে, বিদায় হজ্জ্বের ভাষনে, আজ তা কেবল কল্পনা করাই সম্ভব।
একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্ল্যেখ করে বোঝাতে চেয়েছিলাম কীভাবে বাস্তবসম্যত কারণে একটি অজ্ঞ বর্বর সমাজও সত্য ও ন্যায়ের আহ্বানকে অগ্রাহ্য করতে পারে নি বরং কিয়ামত পর্যন্ত তারা মহান করুনাময়ের দান, জগতের সর্বশেষ পথ প্রদর্শককে লাভ করার গৌরব অর্জন করল। আজকের আরব- মাত্র একজন মানুষের জন্ম ও কর্ম ধারণ করার কারনে সমস্ত দুনিয়ার বিনম্র সদয় দৃষ্টি লাভ করছে। অতএব ইসলাম ধর্মকে আবেগ ও কল্পনার ধর্ম মনে করার কোন কারন নেই। আবেগ ও কল্পনা কবির কাব্য রচনার প্রেরণাশক্তি হতে পারে, তা দিয়ে একজন ধর্ম প্রচারকের মোটেই চলে না।
ধর্ম প্রচারককে অবশ্যই সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্রতুচ্ছ শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার সমস্যা ও তার নায্য সমাধান দিতে হবে। অত:পর তাদের কাছে মহান করুনাময়ের আশার বানী পেশ করতে হবে।
আমরা ইসলাম ধর্মকে জ্ঞানীর ধর্ম হিসেবে বিচার বিশ্লেষণ করে বুঝতে চাইলে পবিত্র কোরআনের বিষয়বস্তু অনুধাবনের পাশাপাশি নির্মোহ দৃষ্টিতে হযরত মুহাম্মদ (স এর জীবন যাপন প্রত্যক্ষ করতে হবে। কারণ পবিত্র কোরআন যে জীবন ব্যাবস্থার কথা বলে হযরত মুহাম্মদ (স তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করেছেন। পবিত্র কোরআন মানব জাতিকে আহ্বান জানায় অদৃশ্যমান মহান এক স্রষ্টার প্রতি নি:সংশয়ে বিশ্বাস আনবার এবং তিনি যা মানুষকে জীবিকারুপে দান করেছেন তা থেকে ব্যায় করার (কল্যাণ কাজে)।
অত:পর এ আদেশ মান্যকারীদের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় সুখকর আবাস স্থলের; এবং অবিশ্বাসীদের সতর্ক করা হয় এ বলে যে কেয়ামত অবশ্যই আসবে এবং তাদেরকে অবশ্যই আগুনের খাদ্য বানানো হবে।
এই পুরস্কার ও শাস্তি ঘোষণার মধ্যদিয়ে কোরআন ধীরে ধীরে জীবন জগত ও মানব সমাজের প্রতিটি অনুধাবনযোগ্য বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছে যা একজন মানুষের পক্ষে পাঁচশত বছরেও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। আমর যখন মানব জাতির উৎস ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত আয়াতগুলোর আবৃতি শুনতে থাকি, তখন মুহুর্তের জন্য মনে হয় এটি কোরআন নয়, নিশ্ছদ্র একখানা ইতিহাস গ্রন্থ; যখন কোরআন মানবদেহের গঠন কাঠামো নিয়ে কথা বলে তখন মনে হয় আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের একখানা পুস্তক আল-কোরআন। অথবা সামাজিক পরিমন্ডলে, ব্যাক্তিগত পরিবার বর্গের সঙ্গে মেলামেশা হাট বাজার ও ব্যাবসা বানিজ্য করার পথ ও পরামর্শ যখন কোরআন দিতে থাকে তখন মনে হয় সচেতন সামাজিক একটি অনিবার্য চলন্তিকা; আবার কোরআন তার নিগূঢ় সত্য ও তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য প্রকৃতির বৃক্ষরাজি, লতাগুল্ম, আকাশ, নক্ষত্র ও চন্দ্র সূর্যের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা যখন উপস্থিত করে তখন কে বলতে পারে কোরআন জ্যোর্তিবিজ্ঞান ও ভূগোল বিদ্যার গাইডবুক নয় ? তাহলে বলুন, যে গ্রন্থ বিশ্ব প্রকৃতির ব্যাপক পরিচয়, মানবদেহের গঠন কাঠামো, প্রত্যাহিক দিন যাপনের রুটিন করে দেয়, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রতিটি জাতি বর্ণ ও সম্প্রদায়ের নিজস্বতা অক্ষুন্ন রেখে বাস্তবসম্মত বিধিবিধান বলে দেয়-এমন একটি গ্রন্থকে যদি একজন প্রতিভাবান নবী বা রাসূলের নিজস্ব খেয়াল খুশীমত কিছু গল্প-শল্পের বর্ণনা বলে উড়িয়ে দেয়া হয়, তাহলে বিবেকবান মস্তিস্ক ব্যথিত না হয়ে পারে না।
আমরা স্বভাবত মনে করি ইসলাম তার ঐতিহ্য হারিয়েছে এবং সেটা এখন বড্ড পুরানো জিনিস।
অতএব ইসলামের কথা শোনা, তার নির্দেশ মাফিক জীবন যাপন করা নেহায়েত সময় নষ্ট। আসলে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন- "সিজদাকারীদের সঙ্গে সিজদা কর, তবে এটা করা বেশ কঠিন। " আল্লাহ নিজেই তাঁর প্রতি বিশ্বাস রেখে নামাজ আদায় করা একটা কঠিন কাজ বলে অভিহিত করেছেন। কেন তিনি এটাকে কঠিন কাজ বলে অভিহিত করলেন ? মানুষ যেহেতু খুব সামান্য জ্ঞানের অধিকারী, এবং তার মধ্যে বিবেকের চেয়ে প্রকৃতির দাপট বিশি; ফলে নামাজ যে নির্মোহ জীবানুভূতির দিকে আহ্বান করে সাধারন অজ্ঞ মানুষ সেদিকে ধাবিত হতে পারে না। আর যদি বা ধাবিত হয় তাহলে সেটা বর্তমানের অনেকটা লোক দেখানো প্রার্থণা যা তার হৃদয় থেকে উৎসারিত নয়।
একারনে বর্তমানে নামাজীর সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু অন্যায় ও জুলুমের মাত্র কমেনি। আল্লাহর আলোকিত অস্তিত্ত্ব স্বীকার করলে তাঁর ইবাদত করা বিশ্বাসী মুমিনের জন্য অবধারিত হয়ে যায় এবং তৎসঙ্গে সৎকর্মও। সৎকাজ ও প্রার্থণা এ দুটো হচ্ছে উপরে উঠার ধাপ বসানো সিড়ির দুপাশের দুটো খুটি। একটিতে কখনো পূণার্ঙ্গ সেড়ি তৈরী হয় না এবং কোন উর্ধ্ব আরোহনকারী উপরে উঠতেও পারে না।
সৎকাজ কিছু ফল দেয়; শুধু প্রার্থনা কোন ফল দেয় না।
প্রার্থনাযুক্ত সৎকাজ সর্বাধিক ফলপ্রসু। কারণ মানুষ প্রথমত আল্লাহর অস্তিত্ত্ব স্বীকার করবে এবং তার ইবাদত করবে এবং সেই সাথে সৎ কাজ বা অপরের কল্যাণকর্মকে একাত্ম করে নিতে হবে। যেহেতু মানুষের কল্যাণকর্মে অধিকতর ধর্মনিষ্ঠার পরিচয় প্রকাশ পায়। অপরের কল্যাণ ভাবনা আল্লাহরই ইবাদত করা।
ইসলাম একটি বিশেষ জাতি সম্প্রদায়ের প্রতি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করলেও, তার উদ্দেশ্য গোটা মানব জাতি, কারণ ইসলামের পরে আর কোন ধর্মের উদ্ভব মানুষের জন্য ঘটবে না।
অতএব ইসলামের ভিতর দিয়েই আল্লাহ সমগ্র মানবজাতির প্রতি কল্যাণের দিকে আগমনের আহ্বান জানান। - "হে মানবজাতি ! তোমাদের পালনকর্তার যথার্থ বাণী নিয়ে তোমাদের নিকট রাসূল এসেছেন, তোমরা তা মেনে নাও, যাতে তোমাদের কল্যাণ হতে পারে। আর যদি তোমরা তা না মান, জেনে রাখ আসমান সমূহে ও যমীনে যা কিছু রয়েছে সে সবকিছুই আল্লাহর। আর আল্লাহ হচ্ছেন সর্বজ্ঞ, প্রাজ্ঞ। "
এখানে একটি বিষয় চিন্তাশীলদের চিন্তার খোরাক যোগাবে।
মানব জীবনকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালনার জন্য আল্লাহর হুকুম ও হেকত প্রাপ্ত বহু নবী ও রাসূল পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের কাছে আগমন করেছিল এবং ঐ একই উদ্দেশ্যে আল্লাহ পৃথিবীর শেষ যুগে, মানবজাতীর সামনে সর্বশেষ সতর্ককারী সুসংবাদদানকারী রাসূল প্রেরণ করলেন। যারা এই শেষ নবীর সতর্ককরণে বিশ্বাস আনল, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করল এবং সকল জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেসে সম্প্রীতি ও শান্তি রক্ষা করে চলল তাদেরকে মুসলমান নামে অভিহিত করা হল। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল, শুধুমাত্র বিশ্বাসী বা মুত্তাকীদের উপকারেই আসবে কোরআন ও কোরআনের বাণী, তাই বলে কোরআনে মাত্র কয়েকটি আয়াতে মুসলমান শব্দের উল্লেখ আছে। অর্থৎ মুসলমানদের লক্ষ্য করে যতবার বক্তব্য এসেছে, তার চেয়ে অনেক অনেক বার হে মানব সমাজ, হে মানব জাতি, হে মানুষ প্রভৃতি সম্বোধনে গোটা মানবজাতিকে আল্লাহ ডেকেছেন। আর এ জন্যেই কুরআনের বাণী সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে পৌছে দেয়া মুসলমানদের জন্য আবশ্যকীয় কর্তব্য।
এখানই কোরআনের বিশ্বজনীনতা। যদিও বৌদ্ধরা কিংবা হিন্দুরা কোরআনের ব্যাপারে আমলই দেয় না তবে আল্লাহরও তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ আল্লাহ যেমন দয়ালু, তেমনি প্রতিশোধগ্রহণকারী। সমস্ত মানব জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহকে অস্বীকার করলে তাতে আল্লাহর বিন্দুমাত্র যেমন ক্ষতি নেই তেমনি স্বীকার করলেও আল্লাহর কোন উপকার নেই। মানুষ তার নিজের মঙ্গলের জন্য আল্লাহকে ডাকবে এবং তার প্রশংসা করবে।
আল্লাহ মানুষের সর্বপ্রকার প্রশংসার উর্দ্ধে।
যে কোরআনে এই বিশ্বজনিনতা রয়েছে, সেটি কেন অপরাপর জাতি গ্রহণ করছে না ? এভটি নিশ্চয়ই চিন্তার বিষয়। যে গ্রন্থ মানব জীবনের সম্ভাব্য সর্বপ্রকার অবস্থার বিবরণ নিখুঁত ভাবে প্রকাশ করে দেয় এবং পূণ্য আত্মা কোরআনের সঙ্গে কথা বলতে পারে, সে গ্রন্থ কেন সর্বসাধারনের চিন্তা, গবেষণা ও নতুন কিছু উদ্ভাবনের অবলম্বন হবে না ? কোরআন বলে দেয়, মানুষ কিভাবে শীতের গরম পোষাক পায়, সমুদ্রে জলযান চালায়, আকাশে পাখি উড়ে বেড়ায়, জমীনে নানা প্রজাতির ফসল উৎপন্ন হয়, কিভাবে মেঘ বৃষ্টি দেয়, শস্য বৃদ্ধি পায়, কৃষকের চক্ষু শীতল হয়, কীভাবে ধনী মূর্খ দম্ভ করে, অত্যাচারী শাসক ধ্বংস হয়, কিভাবে দিনের পিছনে রাত, রাতের পিছনে দিন, আবর্তিত হয়, এবং মানুষের কর্ম প্রবাহ ও বিশ্রামকে নিয়মানুবর্তি করে দেয়। এ সবই রয়েছে এই আলোকিত মহাগ্রন্থে। এবং কোরআনের এসব বর্ণনা এত সরল ও নিখুত যে চক্ষুষ্মান পাঠক মাত্রই হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন।
প্রতিটি আয়াত কত সরল ব্যঞ্জনায় ভারপুর, কত চমৎকার শব্দ সুষমা, কত সুন্দর এর অলংকারশয্যা এবং ধ্বনি লালিত্য।
বলছিলাম কোরআনের বিশ্বজনীনতার কথা। বিশ্বজনীনতা বলতে আমরা কি বুঝি ? আমরা বুঝি সে নিয়ম ও শৃঙ্খলার কথা যা একটি দেশ জাতি ও কালের হয়েও সকল দেশের, সকল জাতির এবং সর্বকালের। ইংরেজীতে যাকে বলে Generalization বা সাধারণীকরনণ। মানব সমাজে সকল ধনী অত্যাচারীর গুণাগুণ প্রায় এক, সকল ধর্মপ্রাণ আল্লাহভীরুর কন্ঠস্বরের বিনয়-নম্রতাও সমান, সকল হিংসুটে অহংকারী মানুষের চেহারা সমান।
গুণের সাদৃশ্য গণনার মাপকাঠি। অতএব যখন কোরআন বলে, এভাবেই কাফেররা ধ্বংস হয়ে থাকে তখন আর বুঝতে আমাদের বাকি থাকেনা যে কোরআনের ঘোষণা কেবল একটি গোষ্ঠী গোত্র বা সম্প্রদায়যুক্ত কাফের নয় সারা বিশ্বের যে কোন সমাজের, যে কোন জাতির ভেতরে লুকিয়ে থাকা কাফিরকে বুঝায়। আবার কোরআন যখন একটি শিশুর ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর শৈশব থেকে কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্য পর্যন্ত ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পেয়ে মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে পোঁছানোর বর্ণনা দেয় এবং বাস্তবের সঙ্গে মিলে মিশে যায় তখন কি করে অস্বীকার করি, কোরআন বিজ্ঞানময় কোরআন নয় ? মানবদেহের গঠন বর্ণনা করে কোরআন তো শরীরতত্ত্ব পুস্তকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। চক্ষুষ্মান ব্যাক্তির কাছে এ তথ্য কোরআনের নির্ভেজাল সত্যতা প্রমাণের এক অনবদ্য দলীল।
আমরা পবিত্র কোরআনের বশ্বজনীনতা বিষয়ে কথা বলছিলাম।
কোরআনের এ বশ্বজনীনতা ও সত্যতা অস্বীকার করার কারণ ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। মানুষ সামাজিক জীব, দেহ ও আত্মার সমন্নয়ে জীবন গঠিত। আত্মার ক্ষুধার চেয়ে সাধারণ মানুষের দেহের ক্ষুধা প্রবল এবং দৈহিক ক্ষুধার তাড়না মিটায় ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয় সঞ্চালনের মাধ্যমে আমরা দৈহিক ক্ষুধা প্রকাশ ও সমাধান করে থাকি্ এই ইন্দ্রিয় যখন আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তখন আত্মার সাভাবিক বিকাশ ও প্রত্যাশা মরে যায় এবং আত্মা দেহের অনুগামী হয়ে উঠে। দেহ যা চায় আত্মা গোলামের মত তা সামনে হাজির করে।
দেহ ভোগ করে আত্মা অসুস্থতার ক্লান্তি নিয়ে ঘুমায়। এভাবে দেহের প্রাধান্যদানকারী মানুষের কাছে খোদায়ী জ্ঞান আসে না। যদিও তারা সামাজিক উচ্চ শিক্ষায় বড় বড় ডিগ্রীধারী, তথাপিও তারা আত্মার নয়, দেহের গোলাম হয়ে অন্ধ মুশরিকে পরিণত হয়েছেন।
আত্মাকে পবিত্রকরনের উপায় কোরআন ব্যাপকভাবে বর্ণনা করেছে । কারন আত্মা যদি পবিত্র না হয়, মহান সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে তাহলে তার সাক্ষাৎ হতে পারে না।
আত্মা অপবিত্র হয় যে কারনে তা আগে আমাদের জেনে নেয়া ভাল। যে চুরি করেনি কখনো, সে যখন চুরি করে তখন তার মন চৌর্যবৃত্তির অপরাধে আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ তার মনের উপর অপরাধের একটা কালো ছায়া পড়ে, যে ডাকাতি করল, তার মন আরো কঠিন অপরাধের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। যে খুন করল তার অন্তকরণ খুনের রক্তে রঞ্জিত হয়ে একেবারে কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেল। এভাবে অপরাধের মাত্র যত বাড়তে থাকে অপবিত্রতার মাত্রাও ততটা বাড়তে থাকে।
কিন্তু পাপ কর্মের এ অপবিত্রতা ক্ষমার মাধ্যমে সংশোধন যোগ্য। কিন্তু আল্লাহর অস্তিত্ত্বকে যারা বেমালুম ভুলে গেছে, এবং অস্বীকার করছে আল্লাহ সর্বশক্তিমান পবিত্র সত্ত্বা, জ্যোতির্মময়। তারাই মারাত্মকভাবে অপবিত্র এবং তাদের এ অপবিত্রতা অমার্জণীয়। "যারা আল্লাহর কালামকে অস্বীকার করে তাদের চেয়ে বড় জালেম আর কে ?"আল্লাহর এ জিজ্ঞাসার মধ্যে আত্মিক অপবিত্রতার চুড়ান্ত নিদর্শন লুকিয়ে আছে।
যারা জ্ঞানী নয় অদৃশ্য বিষয়ে, যারা কেবল দেহ রক্ষা, ভোগ লিপ্সা, আর পৃথিবীতে অনন্তকাল বেচে থাকার লোভে অন্ধ তারা কিভাবে জানবে, এই কোরআনের ঘোষণা মোতাবেক একদিন অবশ্যই তাদের সর্বপ্রকার কামলিপ্সাসহ মূহুর্তের ধুলো ঝড়ের মত এই জীবন নি:শ্চিহৃ হয়ে যাবে।
কি অদ্ভুত এই পৃথিবীর মানব সমাজ ? একদল বিশ্বাস করে হৃদয়ের সমস্ত উপলব্ধি দিয়ে যে, তাদের পালনকর্তা মহান আল্লাহ আছেন এবং তারা একদিন এই মহিমান্বিত সৃষ্টিকর্তার কাছে উপস্থিত হবে, আর একদল আদৌ বিশ্বাস করে না যে আল্লাহ বলতে একজন আছেন এবং তিনি আমাদের কর্মফল দেবেন যা কেয়ামতের মত একটি ভয়ংকর ঘটনার মাধ্যমে মানুষের সামনে উপস্থিত হবে। মানুষকে সত্যিই খুবই সামান্য জ্ঞান দান করা হয়েছে।
"যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত, তারা আপনার পালনকর্তার নিকট থেকে অবতীর্ণ কোরআনকে সত্য জ্ঞান করে এবং এটা মানুষকে পরাক্রমশালী আল্লাহর পথ প্রদর্শণ করে। "
সৃষ্টিকর্তা নিজেই যখন বলেন জ্ঞানপ্রাপ্তরা তাদের পালনকর্তার আদেশ মেনে চলবে এবং তার ঐশীবাণী আল-কোরআনকে সত্য মনে করবে, তখন এটা বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, মুর্খের জন্য কোরআন নয়, এবং ইসলামের বিধান পালন করার মানসিক ধৈর্যও তার থাকে না। কোরআন উপলব্ধি ও ইসলামের মর্মার্থ বোঝার জন্য একজন সাধকের অন্তত তিনটি বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
১. পৃথিবীর ক্ষণকালের জীবন আখেরাতের তুলনায় কিছুই না।
২. একজন সৃষ্টিকর্তার সীমাহীন প্রজ্ঞা থেকে কোরআনের বানী সমূহ আগত।
৩. ঐশী বিধান ব্যাক্তি সমাজ ও পরিবারে শান্তির গ্যারান্টি দিতে পারে।
এই তিনটি উপলব্ধি নিয়ে যখন কেউ কোরআন পাঠ করবে, নি:সন্দেহে তার মানসিক বিকাশ ধারা ইসলামের খাটি পথ অনুসরণ করবে। অজ্ঞ লোকের স্থান ইসলামে নেই।
অর্থাৎ আল্লাহকে অস্বীকারকারীর প্রতি কোন করুনা নেই। ফলে বলতে হয়, ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান মানে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে জ্ঞান, সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে জ্ঞান মানে বিশ্বজগত সম্পর্কে জ্ঞান, বিশ্বজগত সম্পর্কে জ্ঞান মানে আপন সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি এবং প্রশান্তির দিকে যাত্রা। "জ্ঞানীর কলমের কালি েশ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।