আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাইব্রেরী অব আলেকজান্দ্রিয়া: জ্ঞানীদের তীর্থস্থান ও তার পতনের ইতিহাস

হু

আলেকজান্দ্রিয়া মিশরের অন্যতম বন্দর নগরী। বর্তমানের মতো অতীতেও এই নগরী ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণ কেন্দ্র। আলেকজান্দ্রিয়া শহরের নামকরণ করা হয়েছ মহামতি আলেজান্ডারের নামানুসারে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাকে এখানেই সমাহিত করা হয়। আলেকজান্দ্রিয়া নগরীটি প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রি পূর্ব: ৩৩৪ অব্দে।

এই নগরী প্রতিষ্ঠায় প্রধান স্থপতি হিসেবে কাজ করেন রোড্সের ডাইনোক্রেটাস নামের এক স্থপতি। আলেকজান্ডরের মৃত্যুপর এইনগরীর অধিকর্তা হন টলেমী। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীরর বর্তমান অবস্থা টলেমির (খ্রি পূর্ব ৩০৭-২৮৩) শাসনামলেই আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রচীন কালের জ্ঞানবিজ্ঞানের তীর্থভূমি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই আলেকজান্দ্রিয়া নগরী ও লাইব্রেরীকে। বিভিন্ন দেশের অসংখ্য পন্ডিতদের পদচারণায় মুখরিত থাকত এই লাইব্রেরী।

আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় ১০০ বছর পর সেরাপিয়ার মন্দিরকে কেন্দ্র করে আরেকটি ছোট লাইব্রেরী গড়ে ওঠে। একে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর ডটার লাইব্রেরী বলা হয়। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীতে প্রচুর পরিমানে প্যাপিরাসের স্ক্রৌল সংরক্ষিত ছিল যার মধ্যে গণিত, ধর্ম, ইতিহাস, দর্শণ, জ্যাতিবিদ্যা, ভূগোল, ব্যকারণ, চিকিৎসাবিদ্যার স্ক্রৌল বেশি ছিল। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীরর বর্তমান অবস্থা লাইব্রেরীর ইতিহাস: আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীটি রাজ পৃষ্ঠপোষকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মিশরের শাসন ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই লাইব্রেরীটি বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করেছে।

এই সময় একদল পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন যারা আইন ও বিচার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে অধ্যায়ন ও দেখাশুনা করতেন। এই লাইব্রেরীর ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। প্রচলিত মিথ ও ইতিহাসের মিশ্রন ঘটেছে লাইব্রেরীর ইতিহাসের সাথে। এই লাইব্রেরী সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাচীন বর্ণনা পাওয়া যায় হেলেনিস্টিক দার্শনিকদের লেখা Letter of Aresleas (খ্রি:পূ: ১৮০-১৪৫) বইয়ে। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীটি টলেমীর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হলেও এই লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠায় যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন দিমিত্রাস ফেলিরোন ।

ফেলিরোন ছিলেন অ্যারিস্টেটলের ছাত্র। এই লাইব্রেরীটি অনেকটা অ্যারিস্টেটলের লাইসিয়ামের আদলে গড়ে তোলা হয়েছিল। লাইব্রেরী সংরক্ষণ রক্ষনাবেক্ষণ করছেন পন্ডিতগন বই সংগ্রহের পদ্ধতি: আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বই সংগ্রহ করে তা অনুবাদ করে প্যাপিরাসের স্ক্রৌলে লিখে রাখত এবং সংরক্ষণ করতো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বই সংগ্রহের জন্য লাইব্রেরীটির আলাদা লোকবল ছিল। একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় যে তারা অ্যাথেন্স ও রোডেসের বইমেলা থেকেও বই সংগ্রহ করতো।

লাইব্রেরীতে শিক্ষার্থী/ পন্ডিতগন বই সংগ্রহের পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায় গ্যালেনের বর্ণনা থেকে। গ্যালেন তার বর্ণনায় বলেছেন- আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে নোঙ্গর করা কোন জাহাজে যদি কোন পান্ডুলিপি পাওয়া যায় তবে তা জোরপূর্বক হলেও লাইব্রেরীতে নিয়ে আসা হতো। এখানে তারা পান্ডুলিপিটির একটি অনুলিপি তৈরি করতো এবং মূল পান্ডুলিপিটি লাইব্রেরীতে সংরক্ষতি করা হতো এবং অনুলিপিটি মালিককে ফিরিয়ে দিতো। গ্যালেনের আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া যায়- টলেমী-৩ অ্যাথেন্সের শসককে অনুরোধ করেন Aeschylus , Sophocles ও Euripidus এর গ্রন্থ গুলো ধার দিতে লাইব্রেরীর জন্য। অ্যাথেন্সের শাসক বই গুলো ধারদিতে রাজী হয় তবে তার বিনিময়ে ১৫ টেলাস (৪৫০কেজি) মূল্যবান ধাতু দাবি করেন মূল্য হিসেবে।

টলেমী-৩ এই মূল্য হাসিমুখে পরিশোধ করে বই গুলো সংগ্রহ করেন। এছাড়াও টলেমী পরিবারের অনেকেই পর্যটক ছিলন। তাদের হাত ধরে এসেছে অনেক বই। আবার এই লাইব্রেরীতে অনেক পন্ডিত আসতেন বিদেশ থেকে তাদের হাত ধরেও এসেছে কিছু বই। আবার অনেক সময় দেশী বিদেশী পন্ডিতগন এখানে গবেষনা করতেন এবং তারা যে বই গুলো লিখেন সেগুলোও এখানে সংরক্ষন করা হতো।

লাইব্রেরীতে অধ্যায়নরত পন্ডিতগন সংগ্রহীত স্ক্রৌলের সংখ্যা: আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীতে ঠিক কতগুলো স্ক্রৌল ছিল সে সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। যেহেতু এই সময় বই গুলো প্যাপিরাসের স্ক্রৌলে লিখে রাখা হতো তাই একটি বই বা বিষয়কে লিখে রাখার জন্য একাধিক স্ক্রৌল ব্যবহার করা হতো। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন এখানে প্রায় ৬০০০০০ স্ক্রৌল ছিল। তবে অনেকই ভিন্নমত পোষণ করে বলেছেন এখানে ৫০০০০০ স্ক্রৌল ছিল। সেরাপিয়ার ডটার লাইব্রেরীতে প্রায় ৪০০০০ স্ক্রৌল ছিল বলে ধরণা করা হয়।

লাইব্রেরী অব আলেকজান্দ্রিয়ার সংগ্রহশালা আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর ধ্বংস: আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীটি কি ভাবে ধ্বংস হয়ে ছিল সে সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। যে তথ্য পাওয়া যায় তার মধ্যেও বির্তক রয়েছে। এই বির্তকের মধ্যেও আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী ধ্বংসের পিছনে তিনজন ব্যক্তিকে দায়ী করা হয়- এরা হলেন জুলিয়াস সিজার, বিশপ থিওফিলাস ও খলিফা ওমর (রা)। প্রচলিত ইতিহাস অনুসারে জানায় যে, আলেকজান্দ্রিয়ায় কখনো বড় ধরণের অগ্নিকান্ড সংগঠিত হয়নি যার কারণে লাইব্রেরীটি ধ্বংস হতে পারে। তবে কয়েক শতাব্দী ব্যাপী বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকবার আগ্নিকান্ড সংগঠিত হয় যার ফলে লাইব্রেরীটি ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

গৃহযুদ্ধ: লাইব্রেরী ধ্বংসের প্রথম ঘটনাটি ঘটে খ্রি:পূ: ৮৯-৮৮ অব্দে। এই সময়ে টলেমী-৮ আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন। তার সময়ে দেশে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় এবং দেশ ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে লাইব্রেরীর কিছু অংশে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এই সময় অনেক পন্ডিত প্রাণ বাঁচাতে নিরাপদ স্থানে চলে যায়।

আবার কথিত আছে টলেমী-৮ অনেক বিদেশী পন্ডিতদের লাইব্রেরী থেকে বের করে দেন। অ্যথেনিয়াস খ্রি ২০০ অব্দে এই লাইব্রেরী পরিদর্শন করেন। এবং তিনি তার এক বর্ণনায় বলেছেন- অনেক পন্ডিত ব্যক্তি বিশেষ করে ব্যকরণবিদ, দার্শনিক, ভূগোলবিদ এবং চিকিৎসকগণ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা শিক্ষকতার মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। টলেমী-৮ এর সময় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়ে যায়। গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি হলেও এই লাইব্রেরীটি পুনপ্রতিষ্ঠার কোন উদ্যেগ নেয়া হয় নি।

জুলিয়াস সিজারের আক্রমন: পরবর্তী অগ্নিসংযোগ হয় রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের সময় খ্রি:পূর্ব ৪৭ অব্দে। এই সময় রোমান সেনাবাহীনি মিশর জয় করেন। মিশর ও রোমের এই যুদ্ধে অংশ হিসেবে সিজার আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেনেকার (খ্রি:পূর্ব ৩ - খ্রি: ৬৫) মনে এই অগ্নিসংযোগে প্রায় ৪০০০০ টি স্ক্রৌল আগুনে ভষ্মীভূত হয় এবং এই লাইব্রেরীর অনেক স্ক্রৌল রোমান সেনাবাহিনী লুট করে রোমে নিয়ে আসেন। এই কারণে হয়তো অনেকেই আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী ধ্বংসকারী হিসেবে সিজারের নামই উচ্চারণ করে।

যাই হোক এই পর্যায়ে লাইব্রেরীটির কিছুটা ক্ষতিসাধন হলেও লাইব্রেরীটি সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস হয়ে যায় নি। ৪০০০০ স্ক্রৌল লাইব্রেরীর একটি ক্ষুদ্রাংশ ছিল। আর যেখানে স্ক্রৌল গুলো সংরক্ষিত ছিল সেখানে আগুন পৌছায় নি। অ্যারেলিয়ানের বিদ্রোহ দমন: পরবর্তী অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে প্রায় ৩০০ বছর পরে খ্রি ২৭৩ অব্দে। এই সময় পলিমারের রানী জেনেবিয়া সম্রাট অ্যারেলিয়ানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন।

এই বিদ্রোহ দমন করতে যেয়ে অ্যালেরিয়ান ও জেনেবিয়ার মাঝে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে অ্যারেলিয়ান লাইব্রেরীটির যে অংশ অক্ষত ছিল সেখানেও অগ্নি সংযোগ করেন। ফলে লাইব্রেরীটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। তবে এই সময় সেরাপিয়ার ডটার লাইব্রেরিটি অক্ষত থাকে। বিশপ থিওফেলাসের প্যাগান দমন: পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলে খ্রিষ্টান ধর্মের আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়।

এই অঞ্চলে খ্রিষ্টান ধর্মের আধিপত্য বিস্তারে প্রথম ও প্রধান বাধা হয়ে দাড়ায় প্যাগান মন্দির গুলো। এই সময় প্যাগান মন্দির গুলোতেও বিভিন্ন ধরনের স্ক্রৌল সংরক্ষন করা হতো। এই স্ক্রৌল গুলোর অধিকাংশই ছিল প্যাগান ধর্মের সাথে সম্পর্কিত। খ্রি ৩৯১ অব্দে বিশপ থিওফেলাস প্যাগানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন এবং তিনি প্যাগান মন্দির বন্ধের নির্দেশ দেন। প্যাগানরা তাতে অস্বীকৃতি জানালে থিওফ্যালাস তাদের সকল মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করেন।

এই সময় সেরাপিয়ার ডটার লাইব্রেরীটিও ধ্বংস হয় কারণ সেরাপিয়ার ডটার লাইব্রেরীটি ছিল একটি প্যাগান মন্দিরের অভ্যন্তরে। এই প্যাগান মন্দির গুলো ধ্বংসের মাধ্যমেই খ্রিস্টানরা প্যাগানদের বিরুদ্ধে জয়ী হয় এবং হারিয়ে যায় অমূল্য প্যাপিরাসের স্ক্রৌল। শিল্পীর চোখে থিওফেলাসের প্যাগন ধ্বংসের সময় লাইব্রেরী ধ্বংসের চিত্র ওমর (রা) এর মিশর বিজয়: সর্বশেষ অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয় খ্রি ৬৪৫ অব্দে। এই সময় খলিফা ওমর (রা) মিশর জয় করেন। মিশর জয়ের পরে তার সৈনিকগন তাকে জিজ্ঞাসা করেন লাইব্রেরীর স্ক্রৌলগুলোর কি হবে? এই সময় ওমর (রা) উত্তর দেন - যদি স্ক্রৌল গুলো কুরানকে সমর্থন করে তবে তা রেখে দাও আর যদি না করে তবে তার দরকার নেই, ধ্বংস করে ফেল।

বলা হয়ে থাকে যে সৈনিকদের গোসলের পানি গরম করার জন্য প্যাপিরাসের স্ক্রৌলগুলোকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। এবং এই স্ক্রৌলগুলো দিয়ে প্রায় ৬ মাস পানি গরম করা হয়েছে। এখন বলেন কাকে দোষারোপ করব এই লাইব্রেরীটির ধ্বংসকারী হিসেবে। আপনাদের কাছে প্রশ্ন রইল। তথ্যসূত্র What happened to the great library of Alexandria? Library of Alexandria Destruction of the Library of Alexandria


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.