গত রাতে আড়াইশ’র বেশি মানুষ নিয়া ডুইবা যাওয়া লঞ্চটাতে তারেক মাসুদের মতো কোন স্টার, কোন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব বোধ হয় নাই। ছিলো না। থাকলে এতক্ষণে মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তের মধ্যে মাতম শুরু হইয়া যাইতো। অপূরণীয় “জাতীয় ক্ষতি” হইতো। নানান বাণি বর্ষিত হইতো।
মায় জাতীয় শোক দিবসও হইতো। এই আড়াই শতাধিক মানুষ যারা মরছে তার তো আর ইষ্টার না, ভিভি আইপি না। এরা কেবলই সংখ্যা। জনসংখ্যা। সুতরাং জনসংখ্যা কিছু কমছে বলা যাইতে পারে।
হা হা! শাপে বর!
সড়ক পথে নদী পথে এই মানুষগুলা নিয়মিতই দুর্ঘটনা নামের সিস্টেমিক হত্যাকান্ডের শিকার হইয়া পত্রিকার পাতায় “সংখ্যা”য় পরিণত হয়। আমরা মানুষের বদলে সংখ্যা গুনি। যেন এই মানুষগুলার কোন জীবন ছিল না, যেন এদের কোন পরিবার ছিলনা, বাপ-মা-ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র-কণ্যা ছিলনা, যেন এই মানুষগুলার মৃত্যুতে কারো ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ক্ষতি হইতে পারে না এবং সেই ক্ষতি “অপূরণীয়ও” নয়!
হ্যা এদের জীবন হারানোর ক্ষতি সহজেই পূরণীয়। বেশি না ৩০ হাজার লাগে। একই পরিবারের একাধিক লাশ হইলে সেই লাশের দাম একটু বেশি ৪৫ হাজার।
নৌপরিবহন মন্ত্রী ক্ষতিপূরণ করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সাবাশ। দ্বায়িত্ব শেষ।
অথচ, নদী পথে সঠিক দিক নির্দেশনা থাকলে একটা কার্গো আরেকটা লঞ্চকে ধাক্কা দেয়ারই কথা না। কেন ধাক্কা বা সংঘর্ষ হলো সেটা একটা সমস্যা।
আরেকটা সমস্যা হইলো ধাক্কা লাগলেই লঞ্চ ডুবে যাওয়ার কথা না যদি এর নকশায় সমস্যা না থাকে। লঞ্চের দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও উচ্চতার মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকলে ধাক্কা লাগলে লঞ্চ সহজে কাত হয়ে যাওয়ার কথা না। সঠিক মেটেরিয়ালে তৈরী থাকলে তলাও ফেটে যাওয়ার কথা না।
লঞ্চের নিজস্ব ওজন, যাত্রী ও মালামালের ওজনসহ সব মিলিয়ে লঞ্চের কতটুকু অংশ পানির নিচে থাকবে, তা নিরূপিত হয়। এর সঙ্গে লঞ্চের ভারসাম্য রক্ষার জন্য দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা প্রভৃতি নির্ধারিত থাকে।
তলদেশে গভীরতা কম থাকলে লঞ্চ হয় ঝুঁকিপূর্ণ। লঞ্চের যে পরিমাণ অংশ পানিতে ডোবার কথা, প্রয়োজনীয় সেই অংশ না ডুবলে লঞ্চের ভারসাম্য রক্ষা পায় না। এর ফলে অন্য লঞ্চের সাথে সংঘর্ষে, ডুবোচরে ধাক্কা খেয়ে বা অন্য দুর্ঘটনায় তলদেশ সহজেই ফেটে যেতে পারে বা লঞ্চ সহজে কাত হয়ে ডুবে যেতে পারে। গত ২০০৯ সালে এমভি কোকো-৪ ডুবে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই কারণ গুলো দায়ী ছিল।
এমভি শরিয়তপুর-১ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার যে নকশা সঠিক ছিল কি-না, সঠিক না থাকলে কেন ছিল না, এর দায় কার, কেন বার বার নকশার ত্রুটির জন্য শত শত মানুষের জীবন অকালে ঝরে যায়....
তবুও এদের মৃত্যুর প্রতিবাদে প্রেসক্লাব, শহীদ মিনারে মানববন্ধন হইবে না, অনশন হইবে না, সরকার দলীয়- বিরোধী দলীয় কিংবা 'নির্দলীয়' সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীয় বাণী বর্ষিত হইবো না।
এদের জন্য একটা পাচ সদস্যের তদন্ত কমিটি হইলেই যথেষ্ট। এদের লাশের মতোই সলিল সমাধি হয়ে যাবে যে তদন্ত কমিটির তদন্ত রিপোর্টের।
তারপর আবারও একদিন, অনেক দিন... বাস-ট্রাক উল্টায়া, কিংবা কোন লঞ্চ ডুবি হইয়া এইসব গরীব গুর্বা মানুষ গুলা লাশ হইয়া পত্রিকার পাতায় ব্লগে ফেসবুকে সংখ্যা হিসেবে আবারও আমাগো বিবেকি নাকি কান্দার উপকরণ হইবো, লাশ হইয়া উন্নয়ণের জোয়ারে ভাসবো, ডুববো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।