ভবিষ্যতের আবরণ উন্মোচিত হয় ধীরে ধীরে, অথচ মানুষকে কাজ করে যেতে হয় দিন থেকে দিনে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমি শঙ্কিত নই। কিন্তু শঙ্কিতও। কেন? দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমি শঙ্কিত নই, কারণ নতুন দিনের লড়াই জোরদার করার মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত। কিন্তু একই সাথে শঙ্কিত, কারণ, লড়াইকে আরো অনেক বন্ধুর পথ পেরোতে হবে। সেই পথ পেরোনোর সাথীরা কি লড়াইকে এগিয়ে নিতে প্রস্তুত রয়েছেন?
বিপ্লবের বিধান এই নীতিমালাই নির্দেশ করে যে, নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টির ফলে শাসকশ্রেণীরই লাভ বেশী।
কোনো বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তির উত্থানকে ঠেকাতে এই নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির ব্যবহার খুবই ফলপ্রসূ হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে কি এমন পরিস্থিতি উপস্থিত যেখানে কোনো বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান সমাগত এবং তাকে রূখবার প্রচেষ্টাও অতি প্রয়োজনীয়?
এ বিষয়ে আলোচনার পূর্বে বর্তমান শাসকশ্রেণী আওয়ামীলীগ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা প্রয়োজন বলেই মনে করছি।
শাসকশ্রেণীর বর্তমান প্রতিভূ আওয়ামীলীগ বহুদিনের পোড় খাওয়া একটি সংগঠন। এই সংগঠন শাসকশ্রেণীর অংশভাগ হবার পূর্বে লড়াইয়ের ময়দানে থেকে যেমন লড়াইয়ের নীতি নিয়ম আয়ত্ত করেছে, তেমনি শাসনকাঠামোর সাথে থেকে শাসন করার নীতিনিয়মও আয়ত্তাধীন করার চেষ্টা করেছে। এই সংগঠনের মধ্যে পোড় খাওয়া ডেডিকেটেড সংগঠক-সমর্থকও রয়েছেন, যারা লড়াইয়ের সামনের কাতারে থেকে সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন।
যদিও সাম্প্রতিককালে সুযোগসন্ধানীরাই বেশী পরিামাণে আদরনীয়।
এই সংগঠন স্বাধীনতাযুদ্ধের পর যখন রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন কয়েক বছরের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা তলানীতে এসে ঠেকে। কিন্তু দীর্ঘ কয়েকবছর পর ৯০ দশকের শেষের দিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পরে আবার তার জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা উপস্থিত হয়। এই সংগঠন ছাইভস্ম হয়ে যাবার পরে আবার জ্বলে উঠেছে, এই জ্বলে ওঠার মধ্য দিয়ে তার শক্তিমত্তাও প্রদর্শন করতে পেরেছে বলেই মনেহয়।
এখন এই সংগঠন ২০১৩ সালের দিকে এসে ‘মুক্তিযদ্ধের পক্ষের শক্তি’ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেবার আয়োজন করার প্রেক্ষিতে এবং সাম্প্রতিককালে শাহবাগের জাগরণের শক্তি ও আদর্শকে নিজের কাছে টেনে নেবার প্রচেষ্টাও তারা চালিয়েছে।
কিন্তু আমি আমার পূর্বের লেখায় যা বলতে চেয়েছিলাম। তা হচ্ছে, ‘জয় বাংলা’র যে আদর্শিক ভিত্তি তার পরিণতি এক সময়ে ট্রাজেডিতে রূপ নিয়েছিল। বর্তমানে তার পনরাবৃত্তি হলে তা প্রহসনেই রূপ নেবে বৈ কিছু নয়।
যাহোক, সে প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এখন বর্তমান শাসকশ্রেণীর সাম্প্রতিক অবস্থান নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করি। আজ ৩ এপ্রিল, ২০১৩ ইং রাত ৯টা পর্যন্ত এই সরকার চারজন মুক্তমনা ব্লগারকে আটক করেছে।
সরকার একসাথে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে সামনে এনে বিএনপিসহ জামায়াতে ইসলামী’কে কোণঠাসা করার আয়োজন করছে। অন্যদিকে নির্বাচনী বৈতরনী পাড় হতে অন্য মৌলবাদী শক্তিকে নিজের কাছে টানার উদ্যোগও নেবার চেষ্টা করছে। মূলতঃ এই-ই হচ্ছে বর্তমান আওয়ামী
শাসকের অবস্থান।
আওয়ামীলীগের হঠাৎ করে মুক্তমনা এবং ব্লগারদের উপর স্টীমরোলার চালানোর ঘটনা নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ এবং একই সঙ্গে হতাশাই প্রকাশ করছেন। অথবা অনেকেই মনে করছেন, আওয়ামীলীগ চরম একটি ভুলই বোধহয় করে বসলো।
প্রথমত, বলে রাখি এই আটক করার ব্যাপারটি আকস্মিক হলেও আওয়ামীলীগের শ্রেণী। অবস্থান বিবেচনা করলে অপ্রত্যাশিত ছিলো এটা বলা যাবে না। দ্বিতীয়ত, আওয়ামীলীগ কোনো ভুল বা চরম কোনো ভুল করেছে বলে আমার অন্তত মনে হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে, আওয়ামীলীগ শ্রেণী অবস্থান বিবেচনায় ঠিক সময়ে ঠিক কাজটিই
বোধহয় করেছে বা করার চেষ্টা করেছে!। দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া এই সংগঠন শত্রু-মিত্র, সময়বোধ চিনবে না তা কিন্তু ভাবা যায় না।
আওয়ামীলীগ এটা বা শাসকশ্রেণীর এই অংশটি এটা ভালো করেই জানে যে, দেশের মধ্যে একটি নতুন একটি শক্তি উদ্বোধনের সম্ভাবনা উপস্থিত হয়েছে। আওয়ামীলীগ ভালো করেই জেনে গেছে এই শক্তির উদ্বোধন জোরদার হলে তার নিজের পায়ের তলার মাটিই ক্ষয়ে যাবে। এই শক্তির আদর্শ হচ্ছে, তারা শুধূ কথা বলেই ক্ষান্ত থাকে না। কোনো কথাকে কাজে রূপান্তর করার জন্যও তারা চেষ্টা চালায়। তারা যা বলে তা করার চেষ্টা করে।
সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতেই ভালোবাসে। তারা যেকোন অনিয়মকে অনিয়মই বলে থাকে। তারা কারো লেজুড় করেনা অথবা করতে চায় না। তারা এই দেশকে ভালোবাসে, তারা এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পাশে থাকার চেষ্টা করে। তারা নীতি-নৈতিকতাকে সবার আগে তুলে ধরে।
তারা কোনো দল বা গোষ্ঠীকে অন্ধভাবে বা লোভে পড়ে সমর্থন করে না।
এই প্রতিবাদী শক্তিটি এই সময়ে এসে একটি কাঠামোর মধ্যে মিলিত না হলেও চিন্তার ঐক্যের এক বন্ধনের মধ্যে নিজেদের মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। ঠিক এই মিলিত হবার চেষ্টাকালীন সময়েই এই আটকের ঘটনা ঘটলো। এই আটকের ঘটনা ঘটলো, যেন এই চিন্তার ঐক্যের শক্তিটি হোঁচট খেয়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। তারা যাতে শকড হয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যায়।
তারা যাতে নিজেদের এক করার চেষ্টা না করে। কিন্তু দ্বান্দ্বিক এই বিশ্ব ইতিহাসের এই এক নিয়তি যে, শাসকশ্রেণী স্বয়ং নিজের নিয়তি নিজেই রচনা করে থাকে, যতক্ষণ তার নিজের নিয়তি তাকে সেখানে নিয়ে না যায় যেখানে তার সমাপ্তি ঘটবে।
ব্লগারদের এই আটক হবার ঘটনা এটাই আমাদের সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, লড়াই কোনোদিনই কুসুমাস্তীর্ন হতে পারে না। সরকারের এই অবস্থান গ্রহণের কারণে আগামীর লড়াইকামীদের জন্য নতুন এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে বলেই বিশ্বাস। এখন সেই সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না।
চিন্তা এবং আদর্শের নব উদ্বোধনের এই লড়াইকে এখন জোরদার করার উপর নির্ভর করছে আগামী দিনগুলো। পণ্য-নগন্য-রোবট-মেশিনারিজ যন্ত্রাংশ-জ্বি হ্যাঁ হয়ে জীবন কাটিয়ে দেবো নাকি সত্যিকারের মানুষ হিসেবে, আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে জীবনকে সাজাবো তা এই লড়াইকে জোরদার করার উপরই নির্ভর করছে। সুতরাং, এই সময়ের করণীয় নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হবার কোনো কারণই নেই।
কিন্তু বর্তমান সময়ের একটিই মাত্র সমস্যা তা হচ্ছে, শুণ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে কোনো কিছু গড়া যায় না। ভিত্তিকাঠামোটি তো অন্তত গড়ে নিতে হয়।
আজ যারা শুধুমাত্র ভার্চুয়ালী ফেসবুক-ব্লগে জড়িত থেকে এই লড়াইকে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করেছেন, তাদের এই সময়ে সত্যিকারভাবেই মাঠে নামার সময়ক্ষণ উপস্থিত হয়েছে। এখন সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারা বা না পারার উপরই নির্ভর করছে আগামী লড়াইয়ের ভবিষ্যত। বাস্তব মাঠে, বাস্তবেই এবং জনগণের মাঝে থেকে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেই এই লড়াইকে সংগঠিত করতে হবে। এ ভিন্ন অন্য কোনো পথ নেই। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।