ক্লাস হচ্ছে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং –এর। লেকচার শুরুর আগে স্যার একটা গল্প বললেন:
এক বিদেশি গিয়েছেন এক গভীর জঙ্গলে। উদ্দেশ্য- সেখানকার স্থানীয়দের মাঝে কিছুদিন থাকবেন। এখন যেহেতু শেতাঙ্গ, তাই তার প্রতি স্থানীয়দের উৎসাহের অন্ত নাই। উনার সকল কাজকর্মে তারা ভীষণ আনন্দিত হয়।
একদিন সাহেব বললেন তিনি বানর কিনবেন, প্রতিটি ৫ ডলার করে। গ্রামবাসীরা যারপরনাই আশ্চর্য! বানর কেনে নাকি কেউ? যাই হোক ৫ ডলারের আশায় সবাই যতগুলো সম্ভব বানর এনে দিলো। সাহেবও প্রত্যেককে পাওনা বুঝিয়ে দিলেন।
পরের মাসে সাহেব দাম আরও বাড়িয়ে দিলেন, প্রতিটি বানরের মূল্য এখন ১০ ডলার। এবার তো গ্রামবাসীরা সব কাজ ফেলে শুধু বানরের খোঁজে বেরিয়ে পড়লো।
ছেলে-বুড়ো-মেয়ে সবাই মিলে শ’য়ে শ’য়ে বানর এনে দিলো সাহেবকে। এর মধ্যে সাহেবের উদ্ভট খেয়ালের কথা বহুদূর ছড়িয়েছে; অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ কষ্ট করে বানর নিয়ে আসে।
এখন যেহেতু সবাই ধরে ফেলছে তাই জঙ্গলে বানরের সংকট দেখা দিলো। বানর খুঁজতে অনেক গভীরে যেতে হয়। অবস্থা বুঝে সাহেব তাই দাম আরও বাড়িয়ে দিলেন।
একেকটা বানরের জন্য এখন থেকে ২৫ ডলার পাওয়া যাবে। এদিকে সাহেবের বাসার সামনে খাঁচায় রাখা বানরের সংখ্যা এখন হাজার ছাড়িয়েছে। এতগুলো বানর সামলানোর জন্য সাহেব শহর থেকে এক অ্যাসিসটেন্ট আনালেন।
কিন্তু অচিরেই দেখা গেল বানর আর পাওয়া যাচ্ছে না। ২৫ ডলার থেকে দাম বাড়াতে বাড়াতে সাহেব ৭০ ডলার পর্যন্ত দাম হাঁকালেন।
টাকার লোভে গ্রামবাসীর এখন রাতের ঘুম হারাম। সবাই সর্বস্ব ছেড়েছুড়ে এখন জঙ্গলে শুধু বানর খোঁজে। কিন্তু ভাগ্য ভালো থাকলে দিনশেষে মাত্র এক/দুইটা বানর জোটে। তো একদিন সাহেব বললেন তিনি কিছুদিনের জন্য শহরে যাবেন। এসে তিনি প্রতিটি বানরের জন্য ২০০ ডলার করে দেবেন।
অতএব সবাই যেন বানর জোগাড় করে রাখে। সাহেবের কথায় লোকজনের তো মুখে লালা ঝরে! ২০০ ডলার! –এ তো সারা বছরের ইনকাম! কিন্তু প্রস্তাব যতই লোভনীয় হোক বানর তো পাওয়া চাই।
বানর না পেয়ে সবাই যখন দিশেহারা তখনই সাহেবের অ্যাসিসটেন্ট নিয়ে এলো চমৎকার এক প্রস্তাব। গ্রামবাসীকে সে বললো, সাহেবের খাঁচা থেকে সবাইকে সে একটা করে বানর দেবে, কিন্তু তাকে বিনিময়ে ১৫০ ডলার করে দিতে হবে। এতে করে পরে ২০০ ডলারে বিক্রি করলে তাদের ৫০ ডলার লাভ থাকবে।
সবাই তো তক্ষুনি রাজি। লোকজন যে যেমন পারলো টাকা জোগাড় করলো, কেউ জমি বিক্রি করলো- কেউ গরু বা গয়না, কেউবা পাশের গ্রাম থেকে ঋণ নিলো। এভাবে গ্রামের প্রত্যেকে অ্যাসিসটেন্টের কাছ থেকে বানর কিনে নিলো। সাহেবের রেখে যাওয়া বানরের খাঁচা তখন শূন্য।
-এই গল্পর শেষটাও কী বলতে হবে? পরদিন সকালে ঐ অ্যাসিসটেন্টকে আর পাওয়া যায়নি।
আর সাহেব? উনি তো কবেই চলে গেছেন। শেষ পর্যন্ত সাহেব আর তার এসিসটেন্ট হলেন কোটিপতি, আর গ্রামের লোকজন হলো কপর্দকশূন্য।
এই গল্পটা শুনলে হাসি পায়না? মনে হয় না- ‘আহারে, লোকগুলো কতই না বোকা’? এ সহজ ফাঁকটুকু ধরতে পারলো না? কী নির্বোধ, কী আহাম্মক!
আচ্ছা, এখন আসি পেছনের ঘটনায়। এ গল্পটা স্যার বলেছিলেন আমাদের শেয়ার মার্কেট বোঝানোর জন্য। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে শেয়ার বাজার, বিশেষত বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটের কলাকৌশল বোঝানোর জন্য।
কী? হাসি এখনও আছে মুখে? থাকার কথা না। কারণ গল্পের লোকগুলোর বদলে যখন নিজেদের ‘আহাম্মক’ ভাবতে যাই তখন মন সায় দেয় না, হজম করতে কষ্ট হয়।
এই আহাম্মকী আমরা করি কারণ আমরা শর্টকাটে বড়লোক হতে চাই। অফিসের ফাইলপত্র ঘাঁটার চেয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে যদি দিনশেষে লাভ করা যায় –তাইলে সেটা তো স্বর্গ! –এই যে লোভ –এটাই হলো আমাদের বরবাদির কারণ। বাংলাদেশে শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্ট করেন ঘরের গৃহিণীরা।
বছরের পর বছর ধরে জমানো টাকা তারা বিনিয়োগ করেন। কোথায়? বিচার-বিশ্লেষণ করে বের করা কোনও কোম্পানিতে? না; অমুক ভাবী অমুক কোম্পানিতে টাকা খাটিয়ে বছর শেষে ৪০,০০০ টাকা লাভ করেছিলেন –অতএব তারাও ওখানে বিনিয়োগ করবেন। মতিঝিলে দেখবেন একেবারে কমবয়েসি ছেলেরা ঘোরাঘুরি করছে। কেউ বাবার পেনশনের টাকা, কেউ জমি বা মায়ের গয়না বিক্রির টাকা বিনিয়োগ করতে এসেছেন। কেন? সব্বার লোভ হলো কীভাবে টাকা দ্বিগুণ-তিনগুণ করা যায়।
অনেক মাঝবয়েসী লোক একটা নিরাপদ চাকরি ছেড়ে দিনরাত শেয়ারে পড়ে থাকেন। ছেলেমেয়ে বা স্ত্রীর ভবিষ্যতের কথা বেমালুম ভুলে তারা সমস্ত সঞ্চয় ঢেলে দেন। এবং বিনিয়োগের ব্যাপারেও কেউ কী চিন্তাভাবনা করেন? সবাই চলি হুজুগে। অমুকের অমুকের অমুকের এক পরিচিত ভাই আছেন এক জায়গায়, উনি বললেন শেয়ার কিনতে অতএব সবাই মিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ি।
সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি বেতনের চাকরিগুলোর একটি হলো স্টক-মার্কেট এনালিস্টদের চাকরি।
দেশের সেরা প্রতিষ্ঠান থেকে সেরা রেজাল্ট করা ছেলেমেয়েরা এই পেশায় ঢোকে। বাংলাদেশেও ফিন্যান্স/ইকোনমিক্সের সবচেয়ে মেধাবী তরুণরা এই পেশা বেছে নেয়। কারণ অন্য পেশায় যে বেতন আমার হয়তো হবে ১০ বছর পর, তারা ঐ বেতন নিয়ে চাকরিতে জয়েন করে। এটা বলার কারণ হলো, এত টাকা দিয়ে ক্ষুরধার বুদ্ধির ছেলেদের কখন একটা চাকরি দেয়া হবে? যখন সেটার দায়িত্ব ততটা ভারি হবে -তখন। কাজেই যে কাজটা এতটা কঠিন, যেটা বুঝতে এতটা যোগ্যতা লাগে সেটা আমরা কীভাবে অবলীলায় করে ফেলি? কীভাবে ভাবি যে “অমুক ভাই” বলছে দেখে অমুক শেয়ারের দাম বাড়বে? এটা বুঝিনা বলেই তো সর্বস্ব হারাই, অনশন করে রাস্তায় বসে থাকি, রাগের বশে গাড়ি ভাঙচুর করি –কিন্তু যা চলে গেছে তা কি ফেরত আসে?
উল্টো ঘটনাও কি ঘটে না? ঘটে।
কলোনিতে এক সরকারি অফিসার ছিলেন। তাকে খুব কমই দেখেছি নতুন শার্ট গায়ে দিতে। সংসারও ছিলো সাধারণ; তার বড়ছেলের জামা মেজটা গায়ে দিত, মেজটার পরা হলে ছোটটা। -এই যার অবস্থা তাকে মাত্র ২ বছর পর দেখে চিনতে পারিনি। বাসায় তার ফার্নিচার আসে মালয়েশিয়া থেকে, গ্যারেজে শুধু গাড়িই আছে ৪/৫ কোটি টাকা দামের।
রহস্য কী? শেয়ার মার্কেট তার ভাগ্য খুলে দিয়েছে। এখন সবাই যদি ভাবি যে তার মত আমারও ভাগ্য খুলে যাবে আর সবকিছু তুলে শেয়ারে ঢেলে দেই, তাহলে সেটা কী বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
যারা প্রচুর টাকার মালিক, যাদের খাওয়া-পরা-বাসাভাড়া বা বাচ্চার স্কুল নিয়ে চিন্তা করতে হয় না শেয়ার মার্কেট তাদের জন্য। কারণ বড়লোক হওয়ার পর ইচ্ছেমতো বিনিয়োগ তাদের মানায়। কিন্তু আমরা যারা খুব সাধারণ মানুষ, শেয়ার মার্কেট তাদের জন্য কখনও না। কারণ শেয়ার মার্কেট শর্টকাটে বড়লোক হওয়ার পথ না, ওটা হলো জুয়া খেলার বিলাসিতা- যা আমাদের সাধ আর সাধ্যের বাইরে থাকলেই ভালো।
বিঃদ্রঃ এত সুন্দর কথাগুলো আমার নিজের নয়, তবে আমার প্রচণ্ড ভাল লেগেছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।