আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাহসী নারী তসলিমা নাসরিন অথবা নারী এক প্রকার বৃক্ষ -১১

কেউ কেউ তো থাকে এমন যার কেন ঘর হয় না, উঠোন হয় না। কেউ কেউ তো থাকেই এমন শহর ভর্তি মানুষ, অথচ ভালোবাসর একজন মানুষ জোটে না। কেউ কেউ কি এমন থাকে না সারা জীবন পাখি এবং আকাশ দেখতে দেখতে মানুষ এবং অরণ্য দেখতে দেখতে সমুদ্র এবং শূণ্যতা দেখতে দেখতে বয়স বাড়ে! আর বয়স বাড়তে বাড়তে এমনও কি হয় না যে ধসে যাবার আগ মুহুর্তে আর একটি জীবন চায় - জীবন - যাপনের? হয় না এমন তো নয়, হয়। ( তসলিমা নাসরীন ) মানুষকে মানুষের থেকে আলাদা করে দেয় যে ‘ধর্ম’ আর যে পুরুষ (তন্ত্র), সেই অন্ধকারের বিরুদ্ধে তসলিমা নাসরিনের আজীবন সংগ্রাম যেন সফল হয়, আর সেই সুন্দর পৃথিবীটি যেন তিনি তাঁর জীবদ্দশাতেই দেখে যেতে পারেন । পুরুষের চরিত্র আগের মতোই আছে, আমি যতখানি বুঝি, তাতে মনে হয়, পুরুষের কুকীর্তিগুলো তাৎক্ষণিকভাবে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে চূড়ান্ত লজ্জা দেয়া ছাড়া আর কিছু সম্ভবত এদের বিরুদ্ধে করার নেই ।

পুরুষের ‘সার্বজনীন’ চরিত্রহীনতা, কপটতা দেখে দেখে সেই ছোটবেলা থেকেই, আমি নিজে পুরুষ-প্রজাতিভুক্ত হয়েও নিজের কাছেই নিজে মাথা তুলতে পারি না । ( যাদের তসলিমার "নির্বাচিত কলাম" পড়া নেই, সেটা দেখে নিতে পারেন । ) পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার কলম চলেছে, অনেক অপ্রিয় সত্যি কথা বলেছেন, অনেকের বিরাগভাজন হয়েছেন । তসলিমা নাসরিন, ধর্মের বিরুদ্ধে লেখেন- তাতে কি ? যাদের ঈমান মজবুদ তাদের ঈমান কমবে না বরং আরও বাড়বে । তসলিমা নাসরিনের কত বই তো বের হলো- নিষিদ্ধ হলো ঠিক কিন্তু পাঠক তো হাতে পায়েছে সেসব বই ।

এইসব বই পড়ার পরে কি বাংলাদেশের কেউ তসলিমা নাসরিনের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েছে ?উত্তর হবে না । তাহলে ভয়ের কি আছে আর তাকে বাধা দেওয়ার কি আছে । আমাদের অনেকের তসলিমার নাম শুনলে গায়ে আগুন ধরে । তসলিমাকে দেশ থেকে বাহির করে দেয়া হয়েছে কারন সে ধর্ম কে অবমাননা করেছে । পাঠক বলুনতো আজ ফজরের নামাজ কজন পরেছেন ? ধর্মে নামাজ পরতে বলা হয়েছে বিনা কারনে নামাজ না পড়া কি অপরাধ না ? বসে আছেন কেন চলে যান দেশ থেকে ।

হাজার হাজার ধর্ষণ কারি আশে পাশে মাথা উচু করে ঘুরে বেরাচেছ,... রাজাকার রা ঘুরে বেড়েচ্ছে তাদের চেয়ে কি তসলিমা বেশি পাপি ? রাস্তার আশে পাশে ফুটপাথে পর্ণ ম্যাগাজিন হরহামেশা বেচাকেনা হচেছ এগুলোর চেয়ে কি তসলিমার বই বেশি খারাপ ছিলো ? হুমায়ুন আজাদের নারী বই পরেছেন ? খুবকি শালিন বলবেন এই বই কে ? নাকি নারী বলেই আপনাদের সহ্য হয় না ? তসলিমা ধর্ম সম্পর্কে কিছু বললে তাতে যদি আমার ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত আসে, তাহলে বলতে হবে আমার ধর্মের প্রতি বিশ্বাস কম । যারা ঈমানদার না, তাদের তসলিমাকে সহ্য হয় না । কেননা, ঠুনকো ঈমান দিয়ে তো আর তসলিমাকে মোকাবেলা করা যায় না । ( বোমা দেখে যারা ভয় পায় তারা কিন্তু বোমাতেই মারা পড়তেছে ইসলাম ওলা, লোকদের - দুআ করা উচিতঃ "হে আল্লাহ, তুমি তসলিমাকে ইসলামের পক্ষে এনে দাও, সে যেন ইসলামের পক্ষে থেকে সুন্দর সুন্দর লেখা লিখতে পারে । " আমাদের অনেক ক্ষতির কারন প্রতিমুহুর্তে ঘটে যাচ্ছে ।

বাজারের তরকারীর বিষক্রিয়ায় মানুষ তার জীবন থেকে জীবন হারাচ্ছে । ব্যাঙ্ক, শেয়ার বাজার গুলো লুট করে মানুষের পয়সা নিয়ে যাচ্ছে । আমলাদের দুর্নীতির কারনে বৈদেশীক বিনিয়োগ বাধা গ্রস্থ হচ্ছে । মিনিবাস ওয়ালা আর রিকশাওয়ালারা রাস্তায় জ্যাম সৃষ্টি করে রাখছে । ফুটপাথ গুলো দোকানদারদের দখলে চলে গেছে ।

মানুষ সন্ত্রাসীদের দ্বারা জিম্মি হয়ে গেছে । আমরা তসলিমাকে বাদ দিয়ে এইসব নিয়ে ভাবলে লাভ হবে। এই সব সমস্যার জন্য আমারা মরে যাচ্ছি। প্লিজ জাতী পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবার আগে কিছু করেন । রবীন্দ্রনাথ ও বলেছিলেন, 'রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি'..." এটা বলে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সমগ্র বাঙালি জাতিকে হেয় করেনি বা তার ইনটেনশনও তা ছিলো না ।

কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলরা চাইলেই যায়গায় যায়গায় এটাকে কোট করে রবীন্দ্রনাথকে হেয় করার চেষ্টা করতে পারে । নিজেকে এই সমাজের চোখে আমি ‘নষ্ট’ বলতে ভালবাসি। …নারীর শুদ্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত ‘নষ্ট হওয়া’। ‘নষ্ট’ না হলে এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনও নারীর মুক্তি নেই । সেই নারী সত্যিকারের সুস্থ ও মেধাবী মানুষ, লোকে যাকে নষ্ট বলে ।

’ ‘প্রেম’ শব্দটি তসলিমার শৈশব ও কৈশোরে ছিল নিষিদ্ধ একটি শব্দ। সেই পরিবেশে থাকার দরুনই নিষিদ্ধ বলেই হয়তো তিনি বেশি আগ্রহী হতেন প্রেমে । প্রেম করার অপরাধে তাঁর চিকিৎসক বাবা তাঁকে চাবুক দিয়ে পেটাতেন, ঘরবন্দী করতেন, ভাতবন্ধ করতেন, ইস্কুল কলেজও বন্ধ করে দিতেন । ‘তারা ঠগ। প্রতারক।

হিপোক্রেট। ভীতু। ভন্ড। তারা প্রেমিক ছিল না একজনও। আজ বেলায় এসে দুখের দিনগুলোকেও যে সুখের দিন ভেবে সুখ পেতাম, টের পাই।

হৃদয় নিংড়ে প্রেম দিয়েছি, যাদের দিয়েছি, বুঝি তারা পুরুষ ছিল সবাই, প্রেমিক ছিল না । ’ (‘নারীর কোনো দেশ নেই’, পৃষ্ঠা ৪১) । তসলিমা নাসরিন প্রচুর পুরস্কার ও সম্মান অর্জন করেছেন । পৃথিবীর ত্রিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর গ্রন্থসমূহ। মানবতাবাদ, মানবাধিকার, নারীস্বাধীনতা ও নাস্তিকতা বিষয়ে তিনি বর্তমান পৃথিবীতে নিজেই একটি আন্দোলনের নাম ।

জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, A reasonable man adopts himself to the world. An unreasonable man persists in trying to adopt the world to himself. therefore, all progress depends upon the unreasonable man. _বুদ্ধিমান বা যুক্তিশালী লোকরা পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে চলে৷ নির্বোধ বা যুক্তিহীনরা চেষ্টা করে পৃথিবীকে তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে৷ । নারী নির্যাতনকে কোনো না কোনো যুক্তিতে যারা মেনে নেয়, তারা দিব্যি দাবি করে মেয়েরা স্বেচ্ছায় পতিতা হতে চায়। কিন্তু মেয়েরা স্বেচ্ছায় পতিতা হয় না। কোনো মেয়েই শখ করে, পছন্দ করে, ইচ্ছে করে, সংগ্রাম করে পতিতা হয় না। অন্য কোনো বৃত্তিতে যাওয়ার সংগ্রামে ব্যর্থ হয়েই পতিতা হয় ।

মেয়েরা স্বেচ্ছায় অসম্মানিত, অপমানিত আর অত্যাচারিত হতে চায় না । মেয়েরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে না যৌন নির্যাতন! পতিতা বানাতে মেয়েদের বাধ্য করে পুরুষেরা । যদি চায় তারা পতিতা হতে, নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণে বাধ্য হয়ে চায় । বাধ্য হয়ে চাওয়া আর স্বেচ্ছায় চাওয়ার মধ্যে এক সমুদ্র ব্যবধান । কোনো মেয়ে শখ করে আগুনে ঝাঁপ দেয় না ।

সতীদাহের আগুনে মেয়েদের ছুড়ে দিয়ে বলা হতো মেয়েরা স্বেচ্ছায় ওই আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে । ( এই সিরিজটা ১০ পর্ব পর্যন্ত লিখে বন্ধ করে দিয়েছিলাম । আসলে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়ে ছিলাম । অনেক ঝাড়ু-জুতা পেয়েছিলাম বন্ধুদের কাছ থেকে । গতকাল রাতে ভাবলাম, ঝাড়ু-জুতার কারণে প্রিয় মানূষকে নিয়ে লেখা বন্ধ করবো কেনব ? আজ নির্বাসনে, অপমানে, অশ্রুজল/ কাটে তার দীর্ঘরজনী, দীর্ঘদিন ।

/ সে স্বদেশ থেকে হয়েছে বিতাড়িত/ তবুও মিথ্যার কাছে, অন্যায়ের কাছে- করেনি তার উন্নত শির নত । / সেই অকুতোভয়,দৃঢ় চিত্তের মেয়েটির নাম’ তসলিমা নাসরিন’। তসলিমাকে স্যালুট । তাকে সসম্মানে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি । বাঙ্গালী মুসলিম যে ভণ্ডরা তসলিমার ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার স্বাধীনতা হরণ করে তাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে, পশ্চিমাদের দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, সেই একই স্বাধীনতা তারা পশ্চিমা দেশে এসে ভোগ করতে লজ্জা করেনা ।

তাঁকে শুধু সসম্মানে ফিরিয়ে আনলেই সরকারের দায়িত্ব শেষ নয় । তাঁর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্ব । তাঁকে লেখার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে, যারা তাঁকে প্রকাশ্যে হত্যা করতে চেয়েছে তাদের বিচার করতে হবে । তসলিমা সম্পর্কে যারা কুরুচিপূর্ণ কথা বলে তারা কি ইসলামের জঘন্যতাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মেনে চলে? নিশ্চই না। তাহলে তারাও তো ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী কাফের ।

) ( চলবে ) ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।