একজন শব্দ শিকারি । । ১। ।
অস্থির ভাই এলাকায় এক নামে পরিচিত, একনামে পরিচিত না হয়ে উপায় আছে উনার বাবা মা উনার আর কোন নাম রাখেই নাই।
অন্য নাম না রাখার কারন আছে অবশ্যই। কারনটি হলো অস্থির ভাই জন্মের পর থেকেই অস্থির, কারো কোলে স্থির থাকেননি। উনার বাবা উনার নাম দিতে চেয়েছিলেন ভারতের ক্রিকেটার আজহার উদ্দিনের নামে, কিন্তু তা উনার স্ত্রীর পছন্দ নয়। আবার উনার স্ত্রীর পছন্দের নাম অন্য কারো পছন্দ নয়। নাম নিয়ে এক অস্থির অবস্থা।
শেষে সব নাম ধুলীস্যাত করে নাম রাখা হলো অস্থির।
পৃথিবীতে নামের সাথে চরিত্র মিলে যায় এমন ঘটনা খুব একটা ঘটে না। যেমন যার নাম শান্ত দেখা যায় সেই হয় সবচেয়ে অশান্ত, আবার যার নাম নীরব সে হয়ে উঠে বাচাল, আবার সুনাম নামের লোকজন ডেকে আনে দুর্নাম। , কিন্তু আমাদের অস্থির ভাই নামে যেমন কাজেও তেমন। অস্থির সব চিন্তা ভাবনা সবসময় উনার মাথায় গুরুপাক খায়।
আড়ালে অনেকে উনাকে হুজুগে মাতাল বললেও উনি যুগের সাথে তাল দিয়ে চলেন। যেকোনো দিবসের জন্য তিনি র্অডার দিয়ে ঐ দিবসের সাথে মিল রেখে পোশাক বানান ও তাই পড়েন। যেমন গত বৈশাখে পরেছেন লাল পায়জামা আর সাদা পাঞ্জাবি সাথে ইলিশ মাছের আইচ দিয়ে তৈরি করা স্পেশাল লকেট। বিজয় দিবসে পরেছিলেন পায়জামা ও পাঞ্জাবী, পায়জামার একপায়ের রং ছিল সবুজ ও আরেক পায়ের রং ছিল লাল। আর পাঞ্জাবীতে প্রিন্ট করিয়েছিলেন সবুজ মাঠের উপর লাল সূর্যের ছবি।
ভাষা দিবসের জন্যও তৈরি করিয়েছেন কালো রঙের একহাতা পাঞ্জাবী তাতে রক্তের ছাপ সাথে সাদা পায়জামা, পায়জামায় অক্ষর আকা।
অস্থির ভাই সবসময় আপডেটে-ট থাকতে পছন্দ করেন। বাজারের সবচেয়ে ল্যাটেস্ট মডেলের সেট ব্যবহার করতে না পারলে উনার ঘুম হারাম হয়ে যায়। অস্থির ভাই আবার প্রেমও করেন, তবে উনার প্রেম করার ধরনও অস্থির। মোবাইল সেট পাল্টানোর সাথে সাথে উনার গার্ল-ফ্রেন্ডও পাল্টে যায়।
নতুন গার্ল-ফ্রেন্ড নিয়ে উনি আবার নতুন ভাবে শুরু করেন সবকিছু।
। । ২। ।
এভাবে উনার দিনগুলো ভালই চলছিল। কিন্তু কথায় আছে সুখে থাকলে ভুতে কিলাই তেমনি উনিও ভুতের কিল খেলেন। কিন্তু ভুতের কিল উনি একা খেলে-তো কথা ছিলনা কিন্তু তিনি তা না করে আমাকে নিয়ে ভুতের কিল খেতে গেলেন। কিল খেয়ে বদহজম হলে ঐ দায়ভার তিনি নিবেন বলে আমাকে রাজি করালেন।
ঘটনাটি হলো তিনি নতুন প্রেমে পরেছেন।
যদিও উনার হাতে নতুন মোবাইল দেখে আমি আগেই ব্যাপারটি আচ করতে পেরেছিলাম কিন্তু এবারের ঘটনা ভিন্ন। আগে দেখা যেত মেয়েরা অস্থির ভাইয়ের সাথে নিজ থেকেই আসত কিন্তু এই মেয়ে চরম সুন্দরী (অস্থির ভাইয়ের মতে) অস্থির ভাইকে পাত্তাই দিচ্ছেনা। আমাদের অস্থির ভাই এমনিতেই অস্থির মানুষ তার উপরে যদি কেউ উনাকে পাত্তা না দেয় তাহলে-তো অস্থিরতা কোন পর্যায়ে যাবে বোঝা মুশকিল। অস্থির ভাই বলল মেয়েটি সাহিত্যপ্রেমী, আমিতো অবাক আরে এই ডিজিটাল যুগে সাহিত্যপ্রেমী সুন্দরী মেয়ে থাকে নাকি! অস্থির ভাই জোর দিয়ে বলল তাই বিশ্বাস না করে উপায় থাকলনা। আবার সে নাকি কবিতা ভালবাসে।
আর এলাকায় কবি হিসেবে আমার নামটিও খারাপ না তাই অস্থির ভাই অস্থির হয়ে আমার কাছে এসেছেন সুস্থির হওয়ার জন্য।
আমি উনাকে বললাম এখন আমি কি করতে পারি।
তিনি বললেন তোর কিচ্ছু করতে হবেনা শুধু আমাকে শিখিয়ে দে কিভাবে কবিতা লিখতে হয়, আমি তাকে বলেছি আমিও কবিতা লিখি আর এবারের বইমেলায় আমার কবিতার বই আসছে। এখন যদি সে জানতে পারে কবিতার ক’ও আমি জানিনা তাহলে মান সম্মান কিচ্ছু থাকবেনা। যে করেই হোক এই বইমেলায় আমার কবিতার বই আনতেই হবে।
উনার আবদার শুনে আমি ঠোক গিললাম, যে লোক কলম ধরতে গেলে কলম দৌড়ে পালায় তিনি লিখবেন কবিতা। লেখাপড়া চাঙে তুলে দিব্যি চলছিলেন বাপের টাকায়। এখন আমি কি করি উনাকে না করতেও পারছিনা। তারপর উনাকে রবীন্দ্রনাথের কাব্য সমগ্র দিয়ে বললাম পড়ে দেখুন কোন ধরনের কবিতা আপনি লিখতে চান। কিছু পড়ে উনি উত্তর দিলেন এসব কবিতা হবেনা রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতাটি দে সেটি পড়ে সেখান থেকে আমার শুরু হোক।
আমি বললাম শেষের কবিতা নামে উনার কোন কবিতা নেই ঐটি একটি উপন্যাসের নাম। তিনি বললেন রবীন্দ্রনাথ দেখি ধুরন্ধর লোক, কবিতা বলে মানুষদের মাঝে উপন্যাস চালিয়ে দেয়।
তারপর অনেকক্ষণ ধ্যান ধরে তিনি কি যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন একটা কবিতা মাথায় আমার এসেছে শুনে দেখ কেমন হলো,
“আকাশে বৃষ্টি আসে,
দাদা খুক খুক করে কাশে,
পা কাটল পচা ঘাসে”
আমি বললাম, আকাশে বৃষ্টি আসে বুঝলাম, দাদা খুক খুক করে কাশে এটাও বুঝলাম, পচা ঘাসে পা কাটল কিভাবে তাতো বুঝলাম না।
আমার কথা শুনে তিনি খেপে গিয়ে বললেন তার মানে আমার কবিতা হয়নাই, তুই যাই বলিস কবিতার বই আমার বের করতেই হবে।
এই বলে গজরাতে গজরাতে তিনি চলে গেলেন। যাক শান্তি পেলাম বলে আমি নিশ্বাস ছাড়ি। তবে মেয়েটিকে দেখার আগ্রহ আমার বাড়ল। যেই অস্থির ভাই উনার ভাষায় মেয়েদের নিয়ে খেলা করত সেই অস্থির ভাইকে পাগল করে দিয়েছে কে সেই সাহিত্যপ্রেমী মেয়ে?
। ।
তিন। ।
কয়দিন পর এক সকালে আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলল অস্থির ভাই, চোখ খুলে দেখি উনার হাতে অনেকগুলো কাগজ আর তাতে কিছু আকাঝোকা উনার ভাষায় এগুলোই হলো কবিতা। একটি কাগজ হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।
“আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা
উকি দেই আকাশে
ফুলের গন্ধের ঘুম আসেনা
আমার যদি না জাগিমা
ঐখানে যেয়ো না তুমি”
এটি পড়া শেষ করে অন্য আরেকটি কবিতা হাতে নিলাম।
“তোমাকে চাই আমি দিনে
তোমাকে চাই আমি রাতে
তোমাকে চাই চায়ের সাথে খেতে”
আমি বললাম কবিতা সুন্দর হয়েছে, তবে গণধোলাই খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম এরকম কতগুলো কবিতা লিখেছেন। “২০টি হবে” উনি উত্তর দেন। চল প্রকাশনীতে যাই লেখা জমা দিয়ে আসি। আমি বললাম প্রকাশনীর সাথে কথা হয়েছে নাকি তোমার, তারা ছাপবে তোমার লেখা? তিনি বলেন আরে এ জন্যইতো তার কাছে আসা তোকে নিয়ে যাব প্রকাশনীতে।
আমার অবস্থা তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। উনার কথার উপর কথা বলার মত সাহস কারো নেই, আমিওতো অন্য কেউ না তাই বাধ্য হয়ে যেতে হলো উনার সাথে।
অনেকগুলো প্রকাশনী ঘুরে বেড়ালাম উনার কবিতাগুলো নিয়ে কিন্তু কোন প্রকাশনীই রাজি হলোনা। শেষে ভাঙা তরী প্রকাশনীতে গিয়ে অস্থির ভাই বলল কতটাকা হলো আপনারা এই লেখা ছাপাবেন? টাকার কাছে যখন পৃথিবী নস্যি সেখানে প্রকাশকতো ছাড়। শেষে ভাঙা তরী প্রকাশনী অনেক টাকার বিনিময়ে রাজি হলো।
বইটির নাম দেওয়া হলো “জলের তলে অন্ধকার”।
। । ৪। ।
অবশেষে বইটি বইমেলায় আসল। যা পাওয়া যাচ্ছে ৪২০নম্বর স্টলে ভাঙা তরী প্রকাশনীতে। তাই অস্থির ভাই উনার সেই চরম সুন্দরীকে নিয়ে গেলেন বইমেলায়। চরম সুন্দরী মেয়েটিকে দেখার জন্যও আমিও স্টলের আশেপাশেই ছিলাম তিনি আমাকে দেখে ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জানলাম সেই সুন্দরী মেয়েটির নাম ছন্দা, যার চুলে ছন্দ দোলে।
তার হাসিতে তারাগুলো যেন মাটিতে ঝরে পরে। উনার চোঁখের দিকে তাকিয়ে যেকোন কবি হাজারটি কবিতা লিখে ফেলতে পারবেন। যাই হোক অস্থির ভাইয়ের পছন্দের তারিফ না করে পারলাম না। আরো কিছুক্ষণ থেকে কয়েকটি বই নিয়ে উনারা চলে গেলেন আর গেলাম আমিও।
পরদিন সকাল।
অস্থির ভাই আমার সামনে অস্থির ভাবে বসা। মুখে রাজ্যের মেঘ জমেছে, যেকোনো মুহুর্ত্বে যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরতে পারে। জিজ্ঞেস করলাম ঘটনা কি?
উনি বললেন, ছন্দা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। আমার সব কবিতা নাকি কপি পেস্ট। এখন তুই বল দেখি কেউ যদি আমার আগেই এই লাইনগুলো লিখে ফেলে তখন আমার কি করার থাকে।
তবুও আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি তারপর সে বলেছে যদি লোক মুখে আমার কবিতা শুনে সে তাহলে আমার সাথে সে কথা বলবে না হলে সম্পর্ক শেষ। এখন বল কি করা যায়।
আমি বললাম তাহলে আপনি আপনার বইয়ের প্রচার চালান, মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন। ফ্রি অফার দিতে পারেন যেন সবাই আপনার বই কিনে এবং মানুষের মুখে মুখে আপনার কবিতা উঠে আসে।
-আচ্ছা মাইকিং নাহয় করলাম কিন্তু কি ফ্রি দিব?
-ফ্রি কলম দিতে পারেন, কিন্তু এসব তো অনেকেই দেয় তার চেয়ে বরং আপনি ফ্রি অটোগ্রাফের অফার দিন, আপনার সব বইগুলোতে আগে থেকেই অটোগ্রাফ দিয়ে রাখবেন যেন পাঠকদের অটোগ্রাফের জন্য না ঘুরতে হয়।
-হুম ভাল বুদ্ধি।
-তাহলে ঘোষণা দিয়ে দিন “জলের তলে অন্ধকার কিনলে অটোগ্রাফ ফ্রি। ”
। । ৫।
।
এই ফ্রি অফার দেওয়ার পরেও দেখা গেল কেউ বইটি কিনছেনা। অনেকে হাতে নিয়ে দেখছে শুধু।
তারপর অস্থির ভাই আমার কাছে এসে বললেন কাজতো হলোনা এখন তাহলে কি করা যায়?
আমি বললাম তাহলে এবার প্রচ্ছদ ও নাম পাল্টাতে হবে।
-কেন?
-সবার আগ্রহ থাকে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি তাই আপনার বইটিরও এমন কোন নাম দিতে হবে আর লিখে দিতে হবে বয়স্কদের জন্য।
তাহলে দেখবেন সবার আগ্রহ আপনার বইটির প্রতি থাকবে এবং এতে সবার মুখে মুখে আপনার কবিতা উঠে আসতে পারে।
-তাহলে কি নাম দেওয়া যায়?
-নাম দিতে পারেন “দোলা দে রঙিলা”
-আচ্ছা ঠিক আছে।
তারপর বইটি নাম পরিবর্তন করে আবার আনা হলো। বিতর্কে জড়িয়ে গেলেন অস্থির ভাই। দেখা গেল উনার বইয়ের বিক্রি বেড়েছে এবং উনার নামও বেড়েছে।
আগে ছিলেন শুধু অস্থির, আর এখন সবাই উনাকে দেখলেই ডাকে “বস্তির কবি অস্থির, পচা লেখাও থাকেনা স্থির। ”
ছন্দের দোলায় ছন্দা, অস্থির কবির সাথে আর স্থির থাকেনি। সে ঠিকই এক কবির সাথে নিজের ঠিকানা ঠিক করে চলে গিয়েছে অস্থির ভাইকে অস্থিরেই রেখে। এখন অস্থির ভাইয়ের কাছে নারী মানে মস্ত হাড়ি যে চুলোয় বসে পাকায় খিচুড়ি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।