আমার এই ব্লগের কোনো লেখা বা লেখার কোনো অংশ আমার লিখিত অনুমতি ছাড়া যে কোনো প্রকার মিডিয়াতেই প্রকাশ করা যাবেনা। যদি তা করা হয়, তাহলে আমি আইনগত এবং অবস্থাভেদে ব্লগের আইন/প্রসিজিওর অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিতে বাধ্য হব
আইয়ুব বাচ্চুর একটা ভিডিও দেখছিলাম ইউটিউবে বসে। ভদ্রলোক বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গনে এবং গিটার বাজানোর পারদর্শিতায় একজন জীবন্ত কিংবদন্তী, কোনো সন্দেহ ছাড়াই। ইউটিউবে বসে যে ভিডিও দেখছিলাম, সেখানে মন্তব্যের ঘরের মন্তব্য দেখে খানিকটা হাসলাম। কারন সেখানে কেউ কেউ বাচ্চুকে উপদেশ দিচ্ছেন, বাচ্চুর সাথে যে ভদ্রলোকটি ড্রাম বাজাচ্ছেন তাকেও উপদেশ দিচ্ছেন, এইভাবে না বাজিয়ে ওভাবে বাজাতে।
“এই আপনার অরিজিনালিটি কই?, স্যাট্রিয়ানির মত বাজান কেন? এই বাজনা সান্তানার মত কেন? “কিরে ব্যাটা গিটার লয়া খাড়ায়া থাকলে চলবে? ই মাইনর ধর ব্যাটা!! তারপর জি তে যা, সি ধইরা আবার ই তে আয়” “ এই তুই কি বেইস বাজাস রে স্বপন? বিট মিস হয় কনে রে গাধা?” ইত্যাদি...ইত্যাদি...
ইউটিউবের এই কথাগুলো আমরা যারা বাঙালী রয়েছি, তাদের জন্য নতুন কিছু নয় একেবারেই। এটা আমাদের নিত্য নৈমত্তিক এবং অতি চেনা ঘটনা। মায়ের পেট থেকে পড়ে যখন কিছুদিন পর বুঝতে শিখেছি তখন দেখি আমার আব্বা ডাক্তারি করেন। অথচ তিনি পেশায় একজন খ্যাতিমান আইনজীবি। ধরেন খেলতে গিয়ে পা কেটে দুইভাগ, বাবা হাঁক দিলো, “এই জাহাঙ্গীর নিঝুমের পায়ে সারাদিন গরম পানি ঢালবি, ওষুধ লাগবে না সারাদিন গরম পানি ঢালবি” আমার বাবার ধারনা সমস্ত রোগের প্রধান ওষুধ হচ্ছে গরম পানি।
এইদিকে আমি পায়ের যন্ত্রনায় অস্থির। না পারি বাবাকে ভয়ে কিছু বলতে, না পারি এই ভয়াবহ গরম পানি পায়ে দিতে। দুইদিন পর পা-টা ফুলে একাকার অবস্থা। পা কেটে ফেলতে হয় এমন। তারপরেও আমার আইনজীবি বাবা সেটা মানতে যাবে কেন? “ আরে ডাক্তার কি জানে? এই জাহাঙ্গীর নিঝুমকে দুইটা প্যারাসিট্যামল দে”
আমার বাবাই একা না, আমার ধারনা আমার এই লেখাটি যারা পড়ছেন তারা সকলেই এমন অবস্থার বা ঘটনার মুখোমুখি জীবনে সব সময় পড়েন বা পড়তে হয়।
ইনফ্যাক্ট আমরা নিজেরাও এই একি কান্ড অনেকের সাথেই করী। এই ডাক্তারী ফলানোর অভ্যেস আমাদের মজ্জাগত। বাংলাদেশের সবাই এক একজন ডাক্তার।
আপনি বাড়ি বানাবেন? এই কথা আপনার কলিগকে বলেই দেখেন। ধরেন আপনি একটা বায়িং হাউসে কাজ করেন।
আপনার কলিগ এই কথা শুনেই সাথে সাথেই একজন ইঞ্জিনিয়ারের ভূমিকায় চলে যাবেন কিছুক্ষণের জন্য। “আরে বদরুল ভাই ৩০ ফুট ফাউন্ডেশনের কি দরকার? শোনেন আমার পরিচিত দুইজন রাজ মিস্ত্রি আছে। এই লাইনে তারা ৫০ বছর। এদের নিয়ে নেন। এরাই বাড়ি তৈরী করে দিবে।
ফাউন্ডেশন দিবেন বড়জোর ১০ ফুট। রড এত দিয়া কি করবেন? ডিব্বা মার্কা সিমেন্ট কিনবেন আর কদু মার্কা ইট কিনবেন। দুই ফ্লাট করবেন কেন? আপনার তো জায়গা বড়। চারটা ফ্লাট করেন, বাথরুম রাখেন চারটা, বারান্দার দরকার নাই”...ইত্যাদি ইত্যাদি... কলিগের ইঞ্জিনিয়ারিং চলছেই...
আপনি সিনেমা বানাবেন? তাহলেই সেরেছে। আপনার বন্ধু "ফাতরা ঢাঁইচু" আপনাকে পেয়ে বসেছে।
ফাতরা ধরেন একটা পানের দোকান চালায় আর উত্তরাধুনিকা গাঁজা কবিতা লেখে। তিনি বলে বসবেন, “এই শোন, ক্যামেরা কিনেছিস? ক্যামেরা কিনবি “টারজান” কোম্পানির। আমাদের উত্তরাধুনিক চিড়িয়া আছে সিডনী তে। ওকে বলে দিব। ও কিনে দিবে চিন্তা করিস না।
এইটা কি স্ক্রিপ্ট লেখসস? দেখি... না না স্ক্রিপ্ট তো এইভাবে লেখে না রে...এই ভাবে লেখ। এই চরিত্র কেন? ওই চরিত্র নাই কেন? নায়ককে লুঙ্গি পড়তে হবে। হ্যাঁ...কত মিলিমিটারে করবি? কারে কারে লইসস? ধুরো, এইটা একটা কাহিনী হইলো?” চলতেই থাকবে...
ক্রিকেট খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে গিয়েছেন? ওরে বাবা!!!! চারিদিকে কলরব শুনবেন... “ঐ তামিম ঠেকাস কেনরে শালা? মার মার...ওই সাকিব অফে মাইরা একটা সিঙেল নে...এই মুশফিক লেগে খালি, ওইখানে মার... খাড়ায়া দেখস কিরে বা**চো* এই মাশরাফি কি বল করস? ইয়র্কার দে, অফে ফালা, চিপার তলে ফিল্ডার দে, বগলের তলে ফিল্ডার দে...” এইসব বিশিষ্ট পন্ডিতদের যারা কিনা পেশায় কেউ ছাত্র, কেউ কবিরাজ, কেউ ড্রাইভার, কেউ ব্যাবসায়ী...সবাই সেদিন বিরাট ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ...
আপনি ধরেন আইনী সমস্যায় পড়লেন, সেক্ষেত্রে তো আপনার কোনো চিন্তাই নেই। আপনার বিশিষ্ট বন্ধু , কাবাডি খেলোয়ার মজিদ খান আপনাকে উপদেশ দেয়া শুরু করবেন। “কি ঝামেলা? জায়গা জমি? পর্চা-খতিয়ান ঠিক আছে? ওয়ারিশ কারা কারা ছিলো? দেখি তো? খাজনার কাগজ কই? সি এস খতিয়ান টা কই? ভোগ দখলে কে ছিলো? রেজিস্ট্রি কবে করসস? আচ্ছা, দাঁড়া তোরে এক্ষুনি কইয়া দিতেসি কি সমস্যা হইসে”
আবার আরেক ধরনের কাহিনী আছে আমাদের বাঙালীদের।
ধরেন অনেক দিন ধরে সারা দেশের মানুষের দাবী হচ্ছে মোহাম্মদপুরে একটা স্টেডিয়াম চাই। ধরেন গত প্রায় ৫০ বছর ধরে সারা বাংলার মানুষ অসহযোগ আন্দলোন করলো, মিটিং করলো, হরতাল করলো, মানব বন্ধন করলো এই স্টেডিয়ামের জন্য। এক সময় সরকার সব কিছুর পর, সব আন্দোলনের পর শুরু করলো স্টেডিয়ামের কাজ। ব্যাস কাহিনী শুরু হোলো।
পরের দিন থেক পত্রিকার পাতায় রিপোর্ট আসা শুরু করবে।
কি লেখা থাকবে সেখানে? দেখে নিন-
- স্টেডিয়ামের জমি অবৈধ ভাবে দখল করেছে পুলিশ। স্টেডিয়ামের মুল নকশায় ভুল, খবরে প্রকাশ...
- এই স্টেডিয়ামটি ঠিক এই মুহুর্তে দেশের এই অর্থনৈতিক অবস্থাতে কেন দরকার, সরকার তা জনগণকে বলেনি।
- স্টেডিয়ামের রঙ কালো হবে বলে খবরে প্রকাশ... সরকার কি শোকে শোকে রাঙিয়ে দিতে চায় বাংলার প্রান্তর? সরকার কি বুঝাতে চায় যারা এই স্টেডিয়ামের জন্য এত বছর লড়াই করলো, তাদের মন কালো? ধিক্কার দেই সরকারকে...
- স্টেডিয়ামের কাজ কর্মে গাফিলতি...ঝানু ইঞ্জিনিয়ার না নিয়ে বাচ্চা ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ...খবরে প্রকাশ...
- স্টেডিয়াম নিয়ে ১০০ কোটি টাকার দূর্নীতি, খবরে প্রকাশ...
- মোহাম্মদপুরের মত একটি আবাসিক এলাকায় স্টেডিয়াম বানাবার বুদ্ধি সরকারকে দিলো কে? জনতার ক্ষোভ। ১০ তারিখে দৈনিক আমার দেশের সামনে মানব বন্ধন।
এভাবে চলতেই থাকবে, যতক্ষন পর্যন্ত স্টেডিয়ামের কাজ বন্ধ না হয়।
বন্ধ হলে আবার আন্দলোন...চলছে...চলবে...
আর কত বলব বলেন? আর কত বলা যায়?? আপনারাই বলেন?
গত ২৫ শে মার্চ ২০১০ সাল থেকে শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইবুনাল। ২৬ শে মার্চ থেকে শুরু হয়েছে টক শো। বাসার গৃহিনী, বুয়া, চাচা, মামা, আংকেল, ভিখারী, শিক্ষক, ছাত্র, কামার-কুমার, ইঞ্জিনিয়ার, এলাকার বড় ভাই, মুরুব্বি, তাঁতী, কৃষক, দিন মজুর, পতিতা সবাই এখন এই ট্রাইবুনাল নিয়ে আইনী সমালোচনা করে যাচ্ছে রাত ১২ টার পরের টক শোতে। সবচাইতে সরেস হচ্ছে পত্রিকার সাংবাদিকেরা। ধরেন পাশ করেছে গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ থেকে।
মামা-চাচার বদৌলতে ঢুকেছে অনলাইন একটা পত্রিকায়। ট্রাইবুনালের আইনজীবি একদিন তার সাথে কথা বল্লো না, ব্যাস আর যাবি কই রে বাছা?
পরদিন সকাল থেকেই...
-ট্রাইবুনালের আইনজীবি ভালো না, তার গায়ের রঙ কালো। এতে করে সাক্ষীরা তাকে দেখতে পায় না
-ট্রাইবুনালে এসব কি হচ্ছে? এত টাকা দিয়ে প্রসিকিউটর রাখা হলো, অথচ জেরা করে শুধু আসামীর আইনজীবি। প্রসিকিউটর দক্ষ না বলেই আজ এই হাল। খবরে প্রকাশ...
- প্রসিকিউটর জোয়াদ আল মালুমের চোখে সমস্যা।
উনি আমার মত মালকে দেখতে পাননা, তাহলে মামলা সামলাবেন কি করে...খবরে প্রকাশ...
সবশেষে এই যায়গায় যোগ হয়েছে নতুন আরেক অভিযোগ ও অনুযোগ। সেটি হচ্ছে, প্রসিকিউটররা বুড়ো, ১৮ বয়সের তরুনরা কেন আসলো না এই স্থানে? বুড়ো ঘোড়া দিয়ে কি বিলিয়ন ডলারের দৌড় দেয়া যাবে? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কুস্তি খেলোয়ার এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আজ সাংবাদিকের কাছে...খবরে প্রকাশ....
আর সেই সাথে তো আছেই আল্লাহর ওয়াস্তে সেই পুরোনো গান। প্রসিকিউটর রা সাক্ষী আনতে পারে নাই, সাক্ষীদের দেরী হচ্ছে কেন, মামলার এই অবস্থা কেন, বিচারপতি এইভাবে বসছে কেন? প্রসিকিউটর এইভাবে দাঁড়িয়েছে কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি...
অথচ বিচারে কোনো সমস্যা না হলে কি বলবে এই পন্ডিতেরা?
- কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলো না আওয়ামীলীগ...খবরে প্রকাশ...
- মানুষকে ফাঁকি দিলো হাসিনা...খবরে প্রকাশ...
- এই রাজাকাররা ছাড়া পেলে দেশ যাবে কোথায়? খবরে প্রকাশ...
- কেন সমস্যা হলো এই বিচারে? এইটাও খবরে প্রকাশ...
- এত অর্থ খরচ করেও, এত আন্দোলোন করেও সরকার ব্যার্থ...
যেই দেশে প্রতিটা মানুষ প্রত্যেকেই এক একজন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, উকিল, খেলোয়ার, আইনজীবি, গায়ক কিংবা গায়িকা, সেই দেশ নিয়ে ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি আমি।
বাংলাদেশের এই পন্ডিতেরা কি জানে রাতের পর রাত জেগে এই প্রসিকিউটররা মামলা সাজাচ্ছে, রিসার্চ করছে, সারাটাক্ষণ এই নিয়েই তারা আছে। তারা কি জানে কত শত তরুন-যুবক আইনজীবিরা এই প্রসিকিউশনের কাজ যাতে সুষ্ঠু ভাবে আগায় এর জন্য রাত কে রাত আর দিনকে দিন মনে না করে কুকুরের মত খাটছে? তারা কি জানে এরা সব জলাঞ্জলি দিয়েছে।
ভুলেছে পরিবার, ভুলেছে সন্তান, ভুলেছে টাকা উপার্জনের কথাও? এরা কি জানে কত গুলো হাত, কতগুলো মগজ অক্লান্ত প্ররিশ্রম করে যাচ্ছে রাত-দিন ২৪ ঘন্টা?
আর সকালে ঘুম থেকে উঠে কি-বোর্ড চেপে খুব সহজেই কোনো অবিবেচক ও নির্বোধ সাংবাদিক কিংবা ব্যাক্তি ট্রাইবুনাল নিয়ে গল্প ফাঁদে শুধু মাত্র তার হিট বাড়াবার জন্য। তারা জ্ঞান দেয়, তারা উপদেশ দেয়। হোম ইকোনোমিক্সের ছাত্রী ট্রাইবুনালকে হাইকোর্ট দেখায়। তারা বলে, ট্রাইবুনাল একটা বিলিয়ন ডলার ঘোড়ার রেস। এটি একটি অর্থের যন্ত্র।
এখানে বুড়ো উকিল চলবে না, চলবে না বুড়ো ঘোড়া...এখানে চাই তাগড়া জোয়ান...জাস্তি ঘোড়া...
হে প্রিয়...ট্রাইবুনাল পর্ন ছবি না, এটি বাংলা সিনেমার কাটপিসও না প্রিয়...নয় রেস্কোর্সের ময়দান প্রিয়তমা...
এইটা আমার ভাই-মা-বাবা-বোন হত্যার বিচার। এইটা রক্তের ঋন শোধ করবার চেষ্টা প্রিয়...রক্তের ঋন...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।