আনন্দবতী মেয়ে আমি হাওয়ায় উড়াই চুল,চোখের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ মনের ভেতর নীল ঘাসফুল নিয়নীর গাড়ী যখন পিচের রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তায় পড়লো আর এগুচ্ছিলো না। ওখানেই নেমে পড়লো । সেই পথ আর নেই । শুধু দুই পাশের ধান ক্ষেত এখনো তার সবুজ-হলুদ রঙ দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে । অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে ।
মাথার ওপর প্রখর রৌদ্র,কিন্তু খেয়াল নেই । এসব জমি নিয়নীর বাবা মানস চৌধুরীর ছিলো । কতো বৎসর পরে এলো এখানে ?হিসেব নেই । শেষ যখন আসে অনেকগুলো কাজ নিয়ে তাই গ্রামের বাড়ীতে সময় দেয়া হয়নি ,বাপি বারবার বলছিলো এরপর যখন আসবি আমি থাকবো না রে । অনেক অনুরোধ আর কি দুটো দিন থেকে যেতে পারিস না ?বন্ধু প্রিয় নিয়নী অনেকদিন পরে বন্ধুদের পেয়ে মেতে উঠেছিলো আনন্দে ।
কতো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে । “কার বাড়ী যাইবেন আপনে ?” হঠাৎ ডাকে চমকে গেলো নিয়নী ।
মানস চৌধুরীর বাড়ী,চেনেন ?
উনি তো আর নাই । আর তাঁর জায়গা-জমিও দখল করসে তাঁর জ্ঞাতি-গুষ্টি ।
আমি জানি ।
আমি উনার মেয়ে বাড়ী দেখতে এলাম । আপনি কে ?উনার তৈরী মন্দিরটা তো আছে সেটাই দেখবো ।
আপনি নিয়নী ? আহারে জেঠা আপনারে খুব দেখতে চাইসিলো । কতো কইসে আমার মেয়েটারে খবর দেও খুব দেখতে ইস্যা করতেসে । কেন আইলেন গো বইন ? আমি আপনাগো জমিতে কাম করতাম ।
যান বইন মন্দির দেখেন । কেবল নিজেরে শক্ত কইর্যা রাইখেন ।
ফটোসান চশমার জন্যে চোখের জলের ঝিলিক দেখতে পেলো না কেউ । এগিয়ে গেলো সামনের দিকে । অল্প পথ তবুও যেনো শেষ হচ্ছিলো না ।
এই জায়গা বিক্রীর জন্য কম দৌঁড়ায়নি নিয়নী । শেষদিকে এসে হার মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না । আর বাপিও কম দামে ছাড়বে না । এই দেশে হিন্দু আইনে মেয়ে জায়গা পায়না । তাই বাপি উইল করে দিতে চেয়েছিলো , কিন্তু নেয়নি সে ।
অরূপ চেয়েছিলো । আহ্ অরূপ ! ভুল সিদ্ধান্তে জীবন যে কতোটা বদলে যায় । আর এই অরূপের জন্যই বাপি কে হারাতে হলো । জীবনে কখনো ভেবে-চিন্তে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সে । শুধু অরূপ কে বিয়ের আগে ছয়টি মাস অনেক ভেবে তারপর জানিয়েছিলো নিয়নী তার সিদ্ধান্তের কথা ।
আর এতো বড়ো সিদ্ধান্তের পরিণতি শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ তখন যদি জানতো ! একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে পড়লো অগোচরে । চোখের সামনে কচুরীপানা ভরা পুকুর , নিস্তরঙ্গ চেয়ে আছে আকাশের দিকে । পুকুর পাড়ে সেই কড়ই গাছের সারির মাত্র একটি-ই দাঁড়িয়ে আছে । নিঃসঙ্গ গাছটা যেনো তারই মতো । চারিদিকে ঝিম মেরে বসে আছে , একটুকরো বাতাসের ছোঁয়া নেই ।
অথচ দুলে উঠলো গাছটা । গাছটা কি চিনেছে তার মালিকের মেয়েকে ? মামনি বলতো গৃহপালিতরা ঠিক তার মালিককে চিনতে পারে শুধু মুখ খুলে বোঝাতে পারেনা । এই গাছটিও হয়তো চিনে ফেলেছে । পুকুর ঘাটের অস্তিত্ত্ব নেই বললেই চলে । অথচ এই ঘাটেই কতো জলকেলি ।
সাঁতার না পারা মেয়েটা কি চিৎকার জলে নেমে । যদিও এই বাড়ীতে খুব কমই থাকা হয়েছে । বাপি চাকরী করতো শহরে । বৎসরে একবার আসা হতো তাও ভরা পূর্ণিমায় । আর বাপির চাকরী শেষ হবার পরে তো এই গ্রামেই ঘর তুলে থাকা শুরু করলো ।
কোনোভাবেই আর শহরমুখী করা গেলো না । আর হবেইবা কি করে জীবনে এতোটাই সৎ ছিলেন মানস চৌধুরী যে উনার ঘুষবিহীন জীবনে কিছুই করা সম্ভব হয়নি । তাই তো শহর থেকে গ্রামে। এসবের কিছুই হতো না যদি নিয়নীর বিয়ে না হতো , যদি দেশ ছেড়ে প্রবাসী জীবনকে গ্রহণ না করতো । আর সবচেয়ে যে ভুলটা তাড়িয়ে ফেরে এখনো সেটা হলো স্বদেশের চাকরী ছেড়ে দেয়া ।
শুধু অরূপের জন্য সবকিছু ফেলে ছুটে যাওয়া নিয়নী না পেলো অরূপ কে , না বাপিকে । ঘাটের পাশে বসলো নিয়নী । এই ক্ষয়ে যাওয়া ঘাট দেখে কে বলবে এ একসময় কতো অপরূপ ছিলো ! কতোটা জৌলুষ ছিলো এই পুকুরের সবুজ জলের । অনেক চেষ্টা করেও সাঁতার শেখা হয়ে ওঠেনি নিয়নীর । জলে নেমেই শুরু হতো চিৎকার ।
যারা জানতো না ওর আগমনের কথা সেই চিৎকারে তারাও বুঝে ফেলতো আনন্দবতী , উচ্ছ্বল মেয়েটি এসেছে । সেই জলে নেমে একটা ডুব তারপর ভেঁজা কাপড়ে পাড়ে বসে শুরু হতো গল্প । কখনো যদি কাকু বা দাদু চলে আসতো জোরে শুরু করা আদুরে গালমন্দ । সবাই ওর এসব কথায় হেসে ফেলতো , আচ্ছা রে মা তুই থাক , আনন্দ কর । আর দাদু এসেই বলতো ঠান্ডা লাগবে তো ! যা রে দিদিভাই আর ভেঁজা কাপড়ে থাকিস না ।
কে শোনে কার কথা ! যারা চলে যেতে চাইতো আটকে রাখতো , থাকো না পিসি আবার তো চলেই যাবো । ওই মায়াময়ী কন্ঠের আবেদন অগ্রাহ্য করে কার সাধ্য !
ভাঙ্গা ঘাট থেকে নিজেকে উঠিয়ে নিয়ে পা বাড়ালো বাড়ীর দিকে। দক্ষিণের ঘরে আগেই বিল্ডিং ছিলো , এখন আরো হয়েছে । শুধু ভেঙ্গে গেছে ভাইদের একতা । দাদু আর দিদা থাকার সময় যে বৌয়েরা একসাথে থাকতো , এখন আর মুখ দর্শনও করে না একে অপরের ।
ওই দিদা বাপির কাকী ছিলো , যার জন্যে এক হাঁড়ী ভিন্ন হতে বাধ্য হয়েছিলো । যদি উনি বেঁচে থাকতেন আজ হয়তো তাঁর নিজস্ব অতীত কর্মকান্ডের রেশ দেখতে পারতেন । শেষদিকে অবশ্য একটু নাকি দেখা হয়েছিলো ! নিয়নী মৃত্যুর পরের স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস করেনি কখনো । ওর মতে মানুষের সমস্ত ভুল আর শুদ্ধের ফল বেঁচে থাকা অবস্থাতেই পেয়ে যায় । নিজের আজকের এই দিনের জন্য নিয়নী ভাবে এও তার কর্মফল ।
তবে একটুকুও খারাপ নেই । বরং ভালোই আছে । সেই কবে দিদিমা নিয়নী কে বলেছিলো , দেখিস তোর শেষ জীবনটা খুব ভালোই কাটবে । তাইতো হচ্ছে । অরূপ কে ছেড়ে দেবার পরে বেশ কিছুদিন খারাপ লেগেছিলো ।
ছেলেটা কে নিয়ে অনেক বন্ধুর পথ পার করতে হয়েছে । সেই সময়টা কি যে দুঃসহ ! তবে বন্ধু নিখিল নিঃস্বার্থভাবে নিয়নীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো । ছেলেটার মুখের দিকে চেয়েই কষ্ট হতো । বিয়ে করেনি শুধু রাজের কথা ভেবেই । অবশ্য নিজেরও একটা ভয় ছিলো যদি আবার সেই জীবনের মতো সময় চলে আসে ! আর চিন্তা করতো যদি কখনো রাজ তার মাকে এসে অভিযোগ করে তুমি দোষী মামনি ।
এই ভয়ে দিনগুলোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো । অবশ্য কখনোই নিয়নী রাজের থেকে তার বাবাকে দূরে রাখেনি । যখন চেয়েছে বাবা-ছেলে দেখা করেছে । কিন্তু অবাক ব্যাপার এতো কয়টা বৎসরেও কখনো রাজ জিজ্ঞাসা করেনি কেন নিয়নী আলাদা হয়েছে । বরং মা কে অনেকটুকু সময় সঙ্গ দিয়েছে যা আজকের ছেলেদের থেকে আশাও করা যায়না ।
প্রবাসী জীবন থেকে যখন দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ আর ওর বৌ এষা ছাড়তে চায়নি নিয়নী কে । মেয়ের শখ মিটিয়ে দিয়েছে এষা ।
আদরের স্থানগুলো বড্ড তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায় । উত্তরের ঘরের দাদু বেঁচে থাকার সময় বাড়ীতে বেড়াতে এলেই পিসিমনি কে বলতেন , আমার দিদিভাই এসেছে রে । ছোট্ট আলু কড়া করে ভাঁজি কর রে মনি ।
ঘন ডালও রান্না করিস । আজ কোথায় সেই দাদু আর সেই আলুও বাজার থেকে হারিয়ে গেছে । সেই দরিদ্র দশা এখনো কাটেনি । বাড়ীতে এলেই লুকিয়ে পান-সুপুরি খাওয়া হতো দিদার কাছে গিয়ে । সেই দিদার হাসি যা সুন্দর ছিলো এককালে ।
শেষ যখন দেখে ফোঁকলা দাঁত কিন্তু সেই হাসিটুকু ছিলো তখনো । বাড়ীতে অনেক মানুষ শুধু সবাই তাকে দেখেই যাচ্ছে , কিন্তু কেউ কোনো কথা জানতে চাইছে না । কাকাত ভাই অমিত কে সে ঠিকই চিনে ফেলে । শরীর কতো ভারী হয়ে গেছে । পুরোদস্তুর সংসারী ।
কি রে কেমন আছিস ? চিনতে পারিস আমাকে ?
দিদিভাই তুমি ! কবে এলে বিদেশ থেকে ? দিদিভাই ঘরে আসো । এই রানী দেখো কে এসেছে ! প্রণাম করো ।
নিয়নী সত্যি অবাক হলো । তার মানে এখনো কেউ মনে রেখেছে । নইলে দক্ষিণের ঘরের অনেকেই দেখলো কেউ তো জানতেই চাইলো না ।
বললো , না রে বাপি-মামনির ঘরটা দেখতে এসেছি । মন্দিরটায় কে পুজো দেয় রে ? নীরব হয়ে গেলো অমিত । দিদিভাই সেই মন্দির তো আর নেই । দখল হয়ে গেছে জেঠু চলে যাবার পরেই । থমকে গেলো নিয়নী ।
এমন করেই কি হারিয়ে যায় ? চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবীটা একেবারে জন-মানবহীন । বড়ো নিঃসঙ্গ লাগছিলো । অনেক কিছুই তো হারিয়ে গেছে জীবন থেকে । কিন্তু তবু এমন কষ্ট হয়নি ।
ধীর পায়ে আবার যে পথ দিয়ে এসেছিলো মাথাটা নীচু করে বয়সী শরীর নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো ।
পেছন থেকে অমিত ডাকছে দিদিভাই কোথায় যাও ? কিন্তু ওর কানে সেই ডাক যাচ্ছেইনা । ড্রাইভার দরোজা খুলে দিলো । করিম গাড়ী ঘোরাও । করিম জানে তাকে কোথায় যেতে হবে । নিয়নী কে তার নিজের আশ্রম ডাকছে ।
যেখানে সে এখনো আড্ডা দেয় , গান গায় । নাচতে গেলে হাঁপিয়ে যায় । মাতিয়ে রাখে সমস্ত নিঃসঙ্গ বন্ধুদের । এখানে সে অভিনয় করে না , তবে অনেক রাতে দৃষ্টি কিছু খোঁজে । কি জানি কি খোঁজে বুঝে পায়না নিয়নী ।
দেওছড়া চা’বাগান,শমশেরনগর,মৌলভীবাজার
০৭ আগষ্ট , ২০১০ ইং । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।