প্রকীর্ণ করি অর্ণে আলোক বিসর্গী বীথিকায় নাইট্রোজেনের চলাচলপথ প্রশস্ত করার জন্যে, সকাল বেলায় বাগানের মাটি নিংড়ে দেন তিনি । অতঃপর, সযত্ন জলসেচন । আজও তাই করছিলেন । এমন সময়, ঘরের দরজায় টোকা পড়ল । সাজিদুর রাহমান ভেবে পেলেন না, এসময় কে আসতে পারে ।
তিনি কলে হাত ধুয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন । তাঁর দরজায় এমন কোন ফুটো নেই, যা দিয়ে বাহিরটা দেখা যেতে পারে । তবে, দেখার জন্যে তাঁর একটা জানালা আছে । জানালা গলে তিনি বাহিরে তাকালেন । কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না ।
তিনি কি ভুল শুনলেন ? মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব উত্তেজিত হলে, মানুষ নাকি এলেবেলে অনেক রকম শব্দ শোনে ।
অথবা, মনের অজান্তে তিনি হয়ত, খুব করে চাইছিলেন, কেউ একজন আসুক । একজন নিঃসঙ্গ মানুষের সহজাত প্রিয় কল্পনা ।
তিনি ঘুরে চলে যাচ্ছিলেন । এমন সময় কেউ একজন খুক খুক করে কাশল ।
শব্দটা তাঁর ভীষণ পরিচিত । তিনি তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে বাইরে তাকালেন । সূর্যের আলো সরাসরি পড়ল তাঁর চোখে । হাত দিয়ে চোখ আড়াল করতে হল । যাকে দেখার ইচ্ছে ছিল, তাকে আর দেখতে পেলেন না ।
-বাবা । কেমন আছো ।
চিরচেনা প্রিয়কণ্ঠটি কথা বলে উঠল ।
সাজিদুর রাহমান, ছোট সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন । চোখ থেকে হাত সরালেন ।
বহুদিন পর দেখলেন সেই প্রিয় মুখ । তাঁর ছেলে কামাল দাঁড়িয়ে আছে । পরনে চিরায়ত পোশাক, পাঞ্জাবি । কামাল, বাবার জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারল না । ব্যাগটা রেখে এসে জড়িয়ে ধরল ।
-কোথায় লুকিয়ে ছিলি !
-তোমার জানালার নিচে । জানতাম তুমি জানালা দিয়ে তাকাবে । তাই ভাবলাম, ওটাই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ।
-হুম । তাই তো দেখছি ।
-কি করছিলে ?
-এই, বাগানের মাটি নিংড়ে দিচ্ছিলাম ।
-বাহ । চমৎকার । কামাল হেসে বলল ।
-নাশতা করেছো ?
-করেছি ।
-কি দিয়ে ?
-কি দিয়ে যে করেছি, তা তো মনে করতে পারছি না ।
এখন আবার মনে হচ্ছে, নাশতাই করিনি ।
-বেশ । ভেতরে চল । স্টেশনে নেমেই রেস্টুরেন্ট থেকে দু জনের পরোটা আর কাবাব কিনেছি ।
তুমি যদি একবার খেয়েও থাকো, আমার কিচ্ছু করার নেই ।
কিছুক্ষণ পর । সাজিদুর রাহমান দুটো চেয়ার নিয়ে, উঠোনের পাশে পুরনো আম গাছটার ছায়ায় পাতলেন । তারপর বসলেন তার একটিতে । গাছের পাতায় আলোছায়ার খেলা দেখলেন কিছুক্ষণ ।
একটা পাখি নিয়মিত বিরতিতে ডেকে যাচ্ছে । ডাকটা অনেকটা এমন- রৃং... রৃং... । তিনি পাখিটার নাম মনে করতে চেষ্টা করলেন । পারলেন না । কিছু মনে পড়তে না চাইলে, আগে রোখ চেপে যেত ।
এখন আর অমন হয়না ।
গাছপালাগুলো চারপাশে অপরূপ স্বর্গীয় ছায়া ফেলে রেখেছে । আলোকিত উঠোন । উঠোনের ওপারে- লেবু গাছের পাতায়, সূর্যের আলো পড়ে সবুজাভ দ্যুতি ছড়াচ্ছে । পেছনে উঁচু উঁচু বৃক্ষেরা ।
আম, কাঁঠাল আর গাব । তাদের চুড়োয় আলোর প্রতিফলন দেখতে হলে, তাঁকে পাখি হতে হবে ।
সাজিদুর রাহমান চোখ বন্ধ করলেন । ভাবলেন, তিনি একটা পাখি হয়ে গেছেন । হলদে পাখি ।
ডাকছেন রৃং... রৃং... স্বরে । উড়তে উড়তে গাছগুলোর চুড়োয় উঠে গেলেন । দেখলেন, চুড়োগুলো কচি পাতায় ছেয়ে আছে । কিছু সবুজ হয়ে উঠেছে, কিছু খয়েরি ।
কাচারি ঘরের পুরনো টিনের চালের ওপর দিয়ে, দেখা যাচ্ছে ঘাট পুকুরের জল ।
সে জলে সহস্র মানিক-রতন ঝিকমিক করছে । কুলে, বাঁশঝাড় নুয়ে এসে জল ছুঁয়েছে । সেখানে বসতে হবে তাঁকে । তিনি ফের মানব শরীরে ফিরে এলেন ।
দু হাতে মগ ভর্তি চা নিয়ে, কামাল তাঁর পাশের চেয়ারে এসে বসে পড়ল ।
একটা মগ বাড়িয়ে দিল বাবার দিকে । লেবুর চমৎকার ঘ্রাণ আসছে । সাজিদুর রাহমান দু হাতে মগটা চেপে ধরলেন । শীর্ণ শীতল হাতে, উষ্ণতা ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা ।
-কি ভাবছিলে, বাবা ?
-উম ? ভাবছিলাম, আজ বাংলা কত তারিখ ।
- একত্রিশে মাঘ । কাল পহেলা ফাল্গুন ।
- ও । তাই বুঝি এতো আয়োজন ।
-হুম ।
তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে প্রকৃতিতে ।
সাজিদুর রাহমানের মনে হল, হঠাৎ, এক ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন সময়ে এসে পড়েছেন তিনি । পহেলা ফাল্গুন । চারপাশে বিপুল কোলাহল । কিন্তু এতটুকু খারাপ লাগছে না ।
বরং, ভীষণ ভাল লাগছে । বকুল তলার গান থেমে গেছে । তিনি তাকিয়ে আছেন স্টেজের দিকে । বন্ধু বিক্রম দাস, একজন প্রৌঢ় লোকের সঙ্গে, সসম্ভ্রমে কথা বলছে । চোখ পড়তেই হাত নেড়ে, কাছে যেতে ইশারা করল ।
রোকেয়া হাতের বাঁধন আলগা করে বলল, ‘যাও । দেখে এসো । ’
তিনি বললেন, নাহ । যাবো না । কি হবে গিয়ে ? তারচেয়ে, এখানে তোমার পাশে থাকি ।
সহস্র বারের মত, আরও একবার রোকেয়াকে দেখলেন তিনি । একটা বাসন্তীরঙা শাড়ি পড়েছে সে । শাড়িটা তার নয় । কোন এক বান্ধবীর । আজকের জন্যে চেয়ে এনেছে ।
কথাটা মনে হতেই, তাঁর মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল ।
রোকেয়া হেসে ফেলল । যেন তার মনের কথা পড়ে ফেলেছে ।
-রোকেয়া, সন্ধ্যায় চল ।
-কোথায় ?
-নিউ মার্কেট ।
তোমাকে একটা শাড়ি কিনে দেব । বাসন্তীরঙা ।
রোকেয়াকে একটা হলদে পাখির মত দেখাচ্ছে । ভীষণ চঞ্চল সে পাখি । হাত ছেড়ে দিলেই যেন উড়ে চলে যাবে ।
সে চপলা কিশোরীর মতন হেসে উঠে বলল, ‘তা তো দেবেই । কিন্তু আজ নয় । ’
-কেন নয় ?
-বলেছি তাই !
-তাহলে কবে ?
-আগামী বসন্ত আসবার আগে, কোন একদিন । অন্য কোনদিন । আজ আমরা কোথাও যাবো না ।
-বাবা । তুমি বারবার আনমনা হয়ে পড়ছো ।
চিন্তায় ছেদ পড়ল । কামালের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন তিনি ।
-হুম ।
বহুদিন পর পেলাম তোকে ।
-সেটাই তো । একটু কথা বল আমার সঙ্গে ।
-তুইই বল । আমার সব কথা ফুরিয়েছে ।
কামাল বলল, এসব বলে কাজ হবে না । মায়ের কথা বল । তাঁর কথাই ভাবছিলে তুমি ।
-বুঝলি কি করে ?
কামাল হাসতে হাসতে বলল, তোমার চোখে জল, বাবা ।
সাজিদুর রাহমান বললেন,তাই নাকি ! যাক ।
বাঁচা গেল ।
-কেন বলো তো ?
-ভেবেছিলাম, আমার চোখের জলও বুঝি শুকিয়েছে ।
গাছে গাছে চলছে পাখিদের কিচির মিচির । পাশের ঝোপে সর সর শব্দ করে ঢুকে পড়ল, একটা মেটে রঙা গিরগিটি । দূরে কারো বেঁধে রাখা বাছুর, মা- বলে ডেকে উঠল ।
পেছনের মজা ডোবার জল থেকে, আশীষদের সবুজ-সোনালী গলার হাঁসগুলো উঠে পড়েছে । প্যাঁক প্যাঁক করেই চলেছে, একটানা ।
একসময়, কামালের কাঁধ ছুয়ে এসে, রোদ তাঁর বুকের ওপর পড়ল । কামালকে মনে হল, শুভ্র পোশাকের এক জ্যোতির্ময় পুরুষ । সাজিদুর রাহমান দেখলেন, কামাল মিটিমিটি হাসছে ।
ও বুঝে গেছে আমি কি ভাবছি, বললেন মনে মনে ।
-সবাই চিরটাকাল, আমার চোখের ভাষা ধরে ফেলল । আমি কি এতই অনুমেয় ?
-হা হা হা । না বাবা । সবাই ধরতে পারেনি ।
শুধু, যারা তোমাকে ভালবেসেছে, তারাই পেরেছে ।
বাবা চল । নদীর ধারে ঘুরে আসি ।
-যাবি ! উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন তিনি ।
আমিতো প্রতিদিনই একবার ভাবি, যাবো ।
কিন্তু, শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়না । নদীর ধারে বড় বেশি একা লাগে ।
বাঁশি এনেছিস সাথে ?
-এনেছি বাবা ।
-তাহলে সাথে নিয়ে চল । আর ইয়ে ওই ; সিগারেট আছে তোর সাথে ?
কামাল সঙ্কোচের সাথে বলল, আছে ।
-নিয়ে চল । বহুদিন বাদে, ধূমপানে জেগেছে সাধ । হা হা হা ।
কুল কুল শব্দে বয়ে চলেছে নদী । অদূরে, বাঁকের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে নীলাভ পানির ধারা ।
ভীষণ স্রোত । স্থানে স্থানে জলের ঘূর্ণি । অর্ধসমকোণে ঝুঁকে পড়া এক গাছের পাশে, দাঁড়াল দুজন । কালচে খয়েরি কাণ্ডের বয়েসী চিড়গুলো, সূর্যের আলোয় দৃশ্যমান । সাজিদুর রাহমান তাঁর কপালের-চোখের পাশের বলিরেখা গুলোর সঙ্গে, তার মিল খুঁজে পেলেন ।
অগ্রভাগের পাতাগুলো জল ছুঁয়েছে এখানেও । নতুন কচি কচি পাতা । নদী যে বাঁকে অদৃশ্য হয়েছে, সেখানে অজানা অন্ধকার । গাছপালা-ঝোপঝাড়ের ঘনত্ব খুব বেশি । এই অন্ধকার, কাছে ডাকে ।
মনে পড়ে বান্দরবান আর খাগড়াছড়ির দুর্গম পথগুলো । মোদকমুয়ালের বাঁক । বন্ধুদের সহযাত্রী করে, কত বন্ধুর পথেই না পায়ের চিহ্ন রেখে এসেছেন । তখন মনে হত, এসব এমন কিছুই নয় । এখন মনে হয়- সে দিনগুলো ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ বসন্ত-উপহার ।
ভয়ঙ্কর সুন্দর অতিপ্রাকৃতিক একটা স্বপ্ন !
-পাড় ধরে যে হাঁটবো, তারতো কোন উপায় দেখছি না ।
-হুম । সেটাই ।
-আয়, এখানেই একটু বসি ।
সাজিদুর রাহমান সিগারেট ধরালেন ।
খুব চমৎকার সাড়া দিল অভ্যস্ত- পুরনো ফুসফুস ।
-আহ ! কতদিন পর !
কামাল !
-বাবা ?
-তোর বাঁশিতে সুর তোল না । শুনতে ইচ্ছে করছে ।
-কি তুলব বাবা ?
-ভাটিয়ার বা ললিত । সময়তো এখনও ভোর এখনাটায় ।
অবরোহণ থেকে আয় । ওটা আমার বেশি ভাল লাগে ।
খানিক বাদে, আশ্চর্য সুর উঠল কামালের বাঁশিতে । ভোর যেন আরও ঘনীভূত হল । নদীর নীল জল, সুরের তালে তালে তরঙ্গায়িত হতে থাকল যেন ।
তিনি দেখলেন, নদীর অপর পাড়ের বনে রোদ নেমেছে । সবুজ ঘাসগুলো দূর থেকে ডাকছে যেন সুরে-
আয়, আয়, আয় !
খানিক সময় পিঠটা রেখে, যা রে এখানটায় !
সাজিদুর রাহমানের ইচ্ছে হল, সাঁতরে ওপাড় চলে যান । তারপর, ওই ঘাসে পিঠ রেখে, দূর থেকে শোনেন পুত্রের বাঁশির সুর ! নীল ধোঁয়া বাতাসে মিশে যায় । অদ্ভুত এক প্রেমে ছেয়ে যায় তাঁর মন । মনে হয়, অনন্তকাল ধরে তিনি যেন, ঠিক এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলেন !
দুপুরের খাবারের পর পিতা পুত্র দাবা খেলতে বসল ।
গুটি সাজাতে সাজাতে বলল কামাল ।
-বাবা । ছোটবেলায় তুমি ইচ্ছে করে আমার সাথে হেরে যেতে । অনেক সময় নিয়ে, ভেবে চিন্তে ভুল চালটা দিতে । যেন, ভুলক্রমেও আমি হেরে না যাই ।
-হা হা হা । ওটা তো সাময়িক । তোর আত্ম বিশ্বাস বাড়াতে চেয়েছিলাম । পরে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে খেলছি, যেন তোর কৌশল গড়ে ওঠে ।
-তাহলে, তারপরও কেন বারবার জিতে যেতাম আমি ! ব্যাখ্যা দাও ।
-আত্মবিশ্বাসের জোরে জিততি তুই ! আর, আমি হেরে হেরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম । সেটাও একটা কারণ ।
ব্যাখ্যা পেয়েছিস ?
-না পাইনি । কি নেবে তুমি ? শাদা না কালো ।
-বরাবরের মতই ।
কালো ।
-আমি নিজেও এখন কালো নিয়ে খেলি ।
-তাহলে আমাকে শাদাই দে ।
-উহু । তোমাকে কালোই দেয়া হচ্ছে ।
বাই দা ওয়ে, বাবা । আমাদের তুমি ফেরদৌসির কথা বলেছিলে, মনে আছে ? সেই যে ইরানের কবি ? বাদশাহর উপহার যখন পৌঁছুল তাঁর বাড়িতে, তখন তাঁর লাশ বেরুচ্ছিল ?
-হুম মনে আছে । ফেরদৌসির গল্প শুনে তুই কেঁদে ফেলেছিলি, সেটাও মনে আছে ।
-বেশ । কিছুদিন আগে আমি সে শাহনামার বাংলা অনুবাদ পড়েছি ।
সেখানে দাবা সংক্রান্ত এক ভারি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আছে, এবং তার সাথে ভারতবর্ষ জড়িত ।
-তাই নাকি ।
-হ্যা । সে গল্পটা এখন শোনাবো তোমাকে ।
-শোনা ।
কামাল দাবার ছকে গুটি বসানোর ফাঁকে বলতে শুরু করল ।
ইরানের সম্রাট নওশেরওয়া । তিনি ভারতবর্ষের কনৌজ রাজের কাছে কর দাবি করলে, কনৌজ রাজ এক অভিনব কূট চাল চাললেন । সম্রাটের দরবারে বিপুল বিপুল উপঢৌকন সহ একজন দূত পাঠালেন । দূতের সাথে দিয়ে দিলেন একটা দাবা ।
দূত দরবারে পৌঁছুলে, ওই বিপুল উপঢৌকন সম্রাট গ্রহন করলেন । তারপর কনৌজ রাজের পাঠানো চিঠি, তাঁকে পাঠ করে শোনানো হল । শুনে সম্রাটের ভুরু কুঁচকে উঠল । কারণ, চিঠির বিষয়বস্তু ছিল বিচিত্র ।
-ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে ।
বাবার গুটি সাজিয়ে দেয়া শেষ । কামাল নিজের গুলো সাজাতে সাজাতে বলল, চিঠিটা ছিল অনেকটা এরকম । মাননীয় । আমি আপনার দরবারে বিপুল উপঢৌকনসহ আমার দূতকে পাঠিয়েছি । আরেকটি জিনিষ পাঠিয়েছি তার সঙ্গে ।
এর নাম দাবা । আমাদের দেশে, এটা জ্ঞানীদের খেলা । এখন, এর ওপরই নির্ভর করছে, আমার দেশ আপনাকে কর দেবে, কি দেবে না ।
সাজিদুর রাহমান নড়ে চড়ে বসলেন । বললেন, বাহ ! দারুণ তো ! ঐতিহাসিক কৌশল ।
মনে হচ্ছে তিনিই উলটো কর চেয়ে বসবেন ।
-বাবা, উফফ । তুমি এতো ভাল কূটনীতি বোঝো কেন !
-সরি । আচ্ছা বল ।
-তারপর লেখা, আপনার জ্ঞানী সভাসদদের মাঝে কেউ যদি এ খেলার রহস্য ভেদ করতে পারে, তখনই আমরা কর দেব ।
অন্যথায়, মনে করে নেব, আপনি নন, বরং আমরাই কর পাবার যোগ্য । আপনাকে তখন, ধার্যকৃত করের দিগুন পরিমাণ শোধ করতে হবে । আমি বিশ্বাস করি, কোন রাজ্য, শক্তিশালী হয় মূলত জ্ঞান গরিমার বলে । সৈন্য বা অর্থবলে নয় ।
-দারুণ ।
তারপর ?
-সম্রাট এ চ্যালেঞ্জ গ্রহন করলেন এবং এক সপ্তাহ সময় চাইলেন । দিনের পর দিন চলে যেতে লাগল, কিন্তু জ্ঞানীদের কেউই দাবা রহস্যের কোন সমাধান করতে পারল না । শেষ মুহূর্তে সম্রাটের মন্ত্রী বুজুরচেমেহের, এই রহস্য উন্মোচনের ভার হাতে নিল । এবং সপ্তম দিনে এর রহস্য উন্মোচন করলো ।
পরদিন দরবারে, বুজুরচেমেহেরের কেরামতি দেখে তো কনৌজের দূত তো অবাক ।
-ওহহো ।
-বাবা । দুর্গতি এখানেই শেষ নয় । তারপর, আরও দুদিন সময় নিয়ে বুজুরচেমেহের আরেকটা খেলা আবিষ্কার করলো । সেটা দাবারই আরেকটা অপভ্রংশ ।
সে খেলার নাম দেয়া হল ‘নরদ’ । সেখানে দু পক্ষ একই সাথে খেলে । কোন গুটি একই সাথে দুটি আক্রমণের মুখে পড়লে, তা বাদ পড়ে । সেখানে সৈন্যদলকে আট ভাগে ভাগ করা হয় । বুজুরচেমেহের এই খেলাসহ, বিপুল পরিমান উপঢৌকন আর একইরকম আরেকটা চিঠি নিয়ে, রওনা হল কনৌজ ।
কনৌজ রাজের সভাসদ জ্ঞানীদের কেউই, সাতদিনে ‘নরদ’ রহস্যের কোন সুরাহা করতে পারল না ।
-দুঃখজনক । তারপর কি ।
-কনৌজের রাজা জ্ঞানানুরাগী । তিনি বুজুরচেমেহেরের অনেক প্রশংসা করলেন ।
তারপর দিগুন এবং আরও এক বছরের অগ্রিম করসহ তাঁকে ইরানে পাঠিয়ে দিলেন । সাথে দিলেন একটা গুনমুগ্ধ চিঠি । উপঢৌকন তো আছেই ।
-আহা । জনগণের টাকাগুলো বুঝি এভাবেই যায় ।
-এই হল ইতিহাস । কিন্তু বাবা, আমার ঠিক বিশ্বাস হতে চায়না যে, যারা দাবার মত একটা খেলা আবিষ্কার করল, তাঁরা এর সামান্য বিবর্তিত রূপটা ধরতে পারল না । আগাছা, বৃক্ষ থেকে পুষ্টি নিয়ে মহীরুহ বনে গেল । বুজুরচেমেহের বিপুল অর্থ- উপঢৌকন গুনে নিয়ে ইরানে চলে গেল ।
-মনে হচ্ছে, শাহনামায় ইতিহাস বিকৃতির ওপর একটা তদন্ত কমিটি আহ্বান করতে হবে ।
আয় আমরা তাহলে নরদ খেলি ।
-কিন্তু, সৈন্য আট ভাগে সাজাবে কিভাবে ?
-তা তো জানিনা ।
-তাহলে বাদ । দাবাই ভাল ।
বিকেল গড়িয়ে আঁধার নামলো ।
শেষ খেলাটা অসমাপ্ত রেখে, উঠে গেল দুজন । ফের শোনা গেল, নিথর প্রকৃতিতে জীবনের অন্যতম অনুসঙ্গ, পাখির কিচির মিচির । সকালের সাথে পার্থক্য একটাই । তখন ছিল- নীড় ছাড়ার ডাক । এখন নীড়ে ফেরার ।
সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার মাঝে এক গাঢ় বিষণ্ণতা আছে । তখন মনে পড়ে না,এই সূর্য ফের উঠবে কাল । মনে পড়েনা এই একই সূর্যটা, এখন পৃথিবীর অপর প্রান্তে উঠেছে । উপস্থিত আঁধারটুকুই শুধু মুখ্য হয়ে ধরা দেয় । এর পেছনে ঠিক কোনটি কাজ করে ।
মানুষের আবেগ প্রবণতা, নাকি স্বার্থপরতা !
সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, চিরায়ত এ নিয়মের বিপরীতে তো কোন বিষণ্ণতা খাটে না ।
রাতে পিতাপুত্র একসাথে খেতে বসল । ইলিশ মাছ ভাজা আর মুগডাল । খেতে খেতে কামাল বলল, বাবা তোমার মাছ ভাজা দারুণ হয়েছে । মনে হচ্ছে সব ভাত খেয়ে ফেলব ।
-হা হা হা । তোর ডালও ভাল হয়েছে ।
-সত্যি বলছ ?
-হুম ।
-তুমি কিন্তু সাঙ্ঘাতিক মাংস রাঁধতে বাবা । মায়ের ভীষণ প্রিয় ছিল, মনে আছে ?
-হুম ।
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে গেল তাঁর । সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য এক অস্থিরতা ঘিরে ধরল তাঁকে । মনের বিপরীতে, বড় কষ্টে নিরুত্তাপ রাখলেন কণ্ঠটাকে ।
-কামাল ।
-বাবা ?
-তুই কি কালই চলে যাচ্ছিস ?
কামাল হ্যা-না কিছু না বলে, মুখ নিচু করে খেতে লাগল ।
তিনিও আর কিছু বললেন না ।
মনে বললেন, একদিনের জন্যে না এলেও পারতিস । কেন এলি ?
সবই ক্ষণস্থায়ী অনুভূতি । কামাল আসা ছাড়া কি আর দিন কাটেনি ? কেটেছে । এই উঠোনের গাছগুলি, পুকুর, বাঁশঝাড়, হলদে পাখিটা, নদী এরাই তো তাঁর পরিজন ।
মানুষের চেয়েও এরা ঢের কাছের । এদেরকে ঘিরে এই নির্জনবাসই তাঁর স্বর্গ । প্রেমে, বন্ধুত্বে, ঘৃণায়, প্রতারণায় বহু দুরন্ত দিনরাত্রি কেটেছে তাঁর, মানুষের ভিড়ে । সে তৃষ্ণা একদিন মিটেছে বলেই তো, তিনি আসতে পেরেছেন, পূর্বপুরুষের এই একদাচঞ্চল নির্জন গৃহে ।
আজ কেন ফের মন- কাঁদছে এমন ? উচিৎ নয় ।
রাতে পুকুর ঘাটে বসে, এক সাথে তারা দেখলো দুজন ।
কামাল বলল,
-বাবা । গ্রামের আকাশ কত অপরিচ্ছন্ন । দেখেছ ?
-হ্যা রে । একটু ঝাঁট দেবার কেউ নেই ।
তারায় তারায় কেমন নোংরা হয়ে আছে ।
আজ বসন্তের প্রথম দিন । প্রকৃতি চপলা কিশোরীর মত কলকল রবে জানাচ্ছে সে কথা । গাছে গাছে ছড়িয়ে পড়েছে নীড় ছাড়ার ডাক । যারা বিগতবসন্ত, প্রকৃতির এ বাসন্তী আহ্বান তাদের জন্যে নয় ।
নীড় ছাড়ার ডাকে, প্রৌঢ়দের সাড়া দিতে নেই । সাজিদুর রাহমান, তাই একা বসে আছেন চৌকাঠে । আর পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে, কামাল হেঁটে চলেছে পথে ।
চলে যাবার আগে, অনেকটা সময় তাঁকে জড়িয়ে ধরে ছিল কামাল । চোখের জলের অত ক্ষমতা ছিল না, দুজনের মনের ভাবকে বোঝাবে ।
তাদের চোখ তাই শুকনোই ছিল ।
কামাল বলেছিল, বাবা । আমি শত শত মানুষের ভিড়ে, ব্যস্ততায়, নিজেকে ছাড়া সবাইকে ভুলে যাবো হয়ত । কিন্তু তুমি?
-আমার তো নিত্য অবসর । কাউকে ভুলবার জো নেই ।
এই তো বলবি ?
-আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বাবা ।
-শোন । তোর মায়ের একটা নিয়মের অভিধান ছিল । সেই অভিধান অনুযায়ী, বিচ্ছেদে কষ্ট পাবার নিয়ম নেই । কেননা, ‘এমনি বহে ধারা ।
’
-আমি মায়ের এ নিয়ম মানি না বাবা । মা নিজেও কখনও মানেননি ।
-হা হা হা । হুম, তা বটে ।
-বাবা ।
তুমি চল না আমার সাথে ! একসাথে থাকবো দুজন !
-নারে । শহরের ওপর আমার অনেক আভিমান । তুই যখনই সময় করতে পারিস, চলে আসিস ।
তুই আসবার অপেক্ষায় আমি বেঁচে থাকব, মনে রাখিস ।
একটা হলদে পাখি এসে গাব গাছটার ওপর বসে ডাকতে লাগলো, রৃং... রৃং... ।
তিনি নীরবে চৌকাঠ ছেড়ে, ভেতরে গিয়ে কবাট ভেজালেন । প্রকৃতির এ বসন্ত-প্রভাত মাঝে, আজ তাঁর সেচ্ছা নির্বাসনের দিন ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।