ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প অনুসারে, ভারতের উত্তর-পূর্বদিকের হিমালয় অঞ্চলের বিভিন্ন নদীর “বাড়তি” পানি বিভিন্ন সংযোগ খালের মাধ্যমে ভারতের দক্ষিণের শুষ্ক এলাকার নদীগুলোতে সরবরাহ করে সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হবে। ভৌগলিক ভাবে এই প্রকল্পকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে- হিমালয় অঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চল বা পেনিনসুলার অঞ্চল। হিমালয় অঞ্চল থেকে মোট ৬ হাজার ১০০ কিমি দৈর্ঘ্যের ১৪টি খাল ও ১৬টি জলাধার ব্যবহার করে ১৪১.৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার(বিসিএম) পানি দক্ষিণের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং দক্ষিণের বিভিন্ন নদীর মধ্যে ৪,৭৭৭ কি,মি দৈর্ঘ্যের আরো ১৬টি খাল ও ৫৮টি জলাধার ব্যাবহার করে ৩৩ বিসিএম পানি সংগ্রহের মাধ্যমে হিমালয় ও দক্ষিণাঞ্চল মিলিয়ে মোট ১৭৪.৩ বিসিএম পরিমাণ পানি স্থানান্তর করা হবে। মুশকিল হলো, উজানের দেশ ভারতের শাসক শ্রেণী ও উন্নয়ণ বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে যে নদীগুলোর পানি ‘বাড়তি’ হিসেবে অযথাই বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়ে ‘অপচয়’ হচ্ছে, ভারতের গোটা হিমালয় অঞ্চলের জনগণ ও প্রকৃতির জন্য কিংবা গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ভাটির দেশ বাংলাদেশের জনগণের জন্য তাই অপরিহার্য, কারণ নদী অববাহিকার জনগণ ও প্রকৃতির কাছে নদী কেবল কিউমেক/কিউসেকে পরিমাপ যোগ্য পানির আধার নয়, নদী একটি প্রবাহমান জীবন্ত সত্ত্বা যার সজল-সজীব-বাধাহীন অস্তিত্বের উপরই নির্ভর করে গোটা অববাহিকার কৃষি-মৎস-বনাঞ্চল-জলাভূমি সহ সমগ্র জীবন ও প্রকৃতির স্বাভাবিক সজীব অস্তিত্ব।
যদিও নদী সংযোগ প্রকল্পটি রাষ্ট্রীয় সীমা নির্বিশেষে ভয়ংকর এবং সার্বিক ভাবেই ক্ষতিকর, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আমরা এখানে আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের মধ্যে কেবল বাংলাদেশে প্রবেশের আগে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা নদী অববাহিকার পানি যে প্রক্রিয়ায় স্থানান্তর করা হবে তার একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করব যেন বিপর্যয়ের একটা আদল আমাদের কাছে ষ্পষ্ট হয়।
আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ভারতের হিমালয় অঞ্চল থেকে ভারতের দক্ষিণে স্থানান্তরের জন্য নির্ধারিত মোট ১৪১.৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার(বিসিএম) পানির মধ্যে ৪৩ বিসিএম পানি নিয়ে যাওয়া হবে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে যে নদীটি শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ৮০% পানির উৎস। এ কাজে ব্যাবহার করা হবে মানস-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ খাল যার একটি বিকল্প হলো ব্রহ্মপুত্রের জোগিঘোপা-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ খাল। এই সংযোগ খাল গঙ্গার ফারক্কা ব্যারেজের ৬০ কি.মি উজানে গঙ্গার সাথে মিলিত হবে যা থেকে ১৫ বিসিএম পানি ফারক্কা ব্যারেজের দিকে প্রবাহিত করে বাকি পানি বিভিন্ন সংযোগ খালের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতে সরবরাহ করা হবে। পানি স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি নিম্নোক্ত উপায়ে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করেছে ভারত:
১) ব্রহ্মপুত্র নদের উপনদী মানস নদীর উপর ভারত-ভুটান সীমান্তের প্রায় ৫ কি.মি উজানে ৮৭৫০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার(এমসিএম) পানি ধারণক্ষম জলাধার সহ একটি ড্যাম নির্মাণ।
২) ভুটানে অবস্থিত ব্রহ্মপুত্র নদের আরেকটি উপনদী সংকোশ নদীর উপর ভারত-ভূটান সীমান্তের ১২ কিমি উজানে ২৫৩ মি উচ্চতার ৪৯৩০ এমসিএম ধারণ ক্ষমতার জলাধার সহ আরেকটি ড্যাম নির্মাণ।
এবং সংকোশ ড্যামের ১১ কিমি ভাটিতে সংকোশ ব্যারেজ নির্মাণ।
৩) পানি ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে গঙ্গায় নেয়ার জন্য মোট ৪৫৭ কিমি দীর্ঘ, ১০ মিটার গভীরতা ও ১:২০০০০ ঢাল সম্পন্ন মানস-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ খাল (লিংক-১০) নির্মাণ করা। এই প্রক্রিয়ায় পানি মানস ও সাংকোশ নদী থেকে ব্রহ্মপুত্রে পৌছানোর আগেই তিস্তা হয়ে গঙ্গায় পাঠিয়ে দেয়া হবে।
সংযোগখালটি নিম্নোক্ত ভাগে বিভক্ত:
ক) মানস-সংকোশ খাল: মানস ড্যাম থেকে সংকোশ ড্যাম পর্যন্ত এই খালটির দের্ঘ্য ১১৪ কিমি, প্রস্থ ৬৬ মিটার এবং পানি পরিবহন ক্ষমতা ১৩৭০ কিউবিক মিটার পার সেকেন্ড(কিউমেক)।
খ) সংকোশ-তিস্তা খাল: সংকোশ ড্যাম থেকে তিস্তা ব্যারেজ পর্যন্ত খালটির দৈর্ঘ্য ১৩৭ কিমি, প্রস্থ ১২১ মিটার এবং পানি পরিবহন ক্ষমতা ২৩৫৫ কিউমেক।
গ) তিস্তা-গঙ্গা খাল: তিস্তা ব্যারেজ থেকে গঙ্গা নদীর ফারক্কার ব্যারেজের ৬০ কিমি উজান পর্যন্ত এই খালটির দৈর্ঘ্য ২০৬ কিমি, প্রস্থ ১২১ মিটার এবং পানি পরিবহন ক্ষমতা ২৩৫৫ কিউমেক।
৪) পানি ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে গঙ্গায় নেয়ার জন্য মানস-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ খালের একটি বিকল্প হলো জোগিঘোপা-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ খাল(লিংক-১১)।
এক্ষেত্রে পানি ব্রহ্মপুত্রের উপনদী মানস ও সংকোশ থেকে সংগ্রহ করার বদলে মূল নদীতে জোগিঘোপা নামক স্থানে ব্যারেজ নির্মাণ করা হবে এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি জোগিঘোপা ব্যারেজ থেকে ৯৭.৫৩ কিমি সংযোগ খালের মাধ্যমে সংকোশ ব্যারেজে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে পথে পানি স্থানান্তরের জন্য পানিকে ৫টি স্তরে মোট ১০৫৯ ক্ষমতার পাম্পের মাধ্যমে ১০০ মি উচ্চতায় উঠানো লাগবে বলে এ বিকল্পটি বাস্তবায়নের সম্ভবনা কম।
৫) ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে পানি গঙ্গায় আসার পর ১৫ বিসিএম পানি ফারাক্কার দিকে প্রবাহিত করা হবে যা ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্পের আওতায় সেচ কাজে ব্যাবহার করা হবে।
তাছাড়া ফারক্কা থেকে ফারাক্কা-সুন্দরবন সংযোগ খালের(লিংক-১২) মাধ্যমে ৯ বিসিএম পানি স্থানান্তিরত হবে যার মধ্যে ২ বিসিএম ব্যাবহার করা হবে যমুনার পুনরুজ্জীবন ও কেষ্টপুর ভাঙ্গারাকাটা খাল উন্নয়ণ এবং বাকি ৭ বিসিএম হুগলীতে স্থানান্তর করে কলকতা বন্দরের নাব্যতা বাড়ানোর কাজে লাগানো হবে।
৬) গঙ্গা অববাহিকা থেকে পানি গঙ্গা-দামোদর-সুবর্ণরেখা সংযোগ খালের (লিংক-১৩) মাধ্যমে সুবর্ণরেখা নদীতে এবং সুরর্ণরেখা নদী থেকে সুরর্ণরেখা-মহানদী সংযোগ খালের(লিংক-১৪) মাধ্যমে পানি মহানদীতে স্থানান্তর করা হবে।
৭) এছাড়া ফারক্কা থেকে আরো উজানে মধ্যপ্রদেশের মির্জাপুর জেলার চুনার থেকে ১৪৯.১০ কিমি দীর্ঘ চুনার-সোন ব্যারেজ সংযোগ খালের(লিংক-৮) মাধ্যমে ৬ বিসিএম পানি গঙ্গা থেকে সোন নদীতে স্থানান্তর করে বিহার ও উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন প্রদেশে সেচের কাজে ব্যাবহার করা হবে।
নদী সংযোগের হিমালয় অঞ্চলের পরিকল্পনাটা এরকম-
৮) মহানদী থেকে এরপর দক্ষিনাঞ্চলের নদী সংযোগ প্রকল্পের(Peninsular component) লিংক ১- লিংক ৪ – লিংক ৭- লিংক ৮-লিংক ৯ হয়ে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের কাবেরী নদী অববাহিকা অঞ্চলে স্থানান্তরিত হবে।
সবমিলিয়ে উত্তর-পূর্বের হিমালয়ান এবং দক্ষিণের পেনিনসুলার উভয় অংশকে একসাথে দেখলে গোটা পরিকল্পনার চেহারাটা দাড়ায় এরকম-
গঙ্গা ও তিস্তার উজানে ভারতীয় ব্যারেজের ফলে এমনিতেই বাংলাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশেরও বেশি এলাকায় মরুকরণ ঘটেছে, ছোট বড় অনেক নদী মরে গেছে, লবণাক্ততা বেড়েছে, কৃষি ও মৎস সম্পদের বিপর্যয় ঘটেছে।
সেই সাথে আছে মেঘনার উজানে টিপাইমুখ বাধ ও ফুলের তল ব্যারেজের হুমকী। বাকি ছিল ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা। এখন ব্রহ্মপুত্রের উজানে ড্যাম ও ব্যারেজ নির্মাণ করে আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে পানি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে সরিয়ে নেয়ার মানে হলো অবশিষ্ট পানি প্রবাহটুকু থেকেও বাংলাদেশের বঞ্চিত হওয়া এবং গোটা বাংলাদেশেরই মরুকরণ ও লবণাক্ততার ঝুকিতে পড়া। গঙ্গা ও তিস্তার উজানের ফারাক্কা আর গজলডোবা ব্যারেজের কারণে যেমন শুকনো মৌসুমে পানির পাওয়া না পাওয়া আর বর্ষা মৌসুমে বন্যা হওয়া না হওয়া ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ ও মর্জির উপর নির্ভর করে, আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে গঙ্গা, ব্রম্মপুত্র ও তিস্তা নদীর উপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মানে হলো গোটা বাংলাদেশের জল-জমি-জীবন প্রবাহের নিয়ন্ত্রণ ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের হাতে চলে যাওয়া। তাই সময় থাকতেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সুষ্পষ্ট অবস্থান নিতে বাধ্য করতে হবে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীকে এবং সেই সাথে জনগণের পক্ষ থেকে খোদ ভারতেই এই আগ্রাসী প্রকল্পের বিরুদ্ধে ফুসে উঠা জনগোষ্ঠীর সাথে সংগ্রামের সাথে আন্ত:সংযোগ স্থাপন করে রুখে দিতে হবে সাম্রাজ্যবাদী দখলদারির আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পকে।
রেফারেন্স:
১) Web site for Strategic Analysis of India's National River-Linking Project
http://nrlp.iwmi.org/main/Default.asp
২) National Water Development Agency of India
http://nwda.gov.in/
৩) Interlinking of Rivers in India: Dimensions of Social Impacts- Himanshu Thakkar
Click This Link
৪) Dams, Rivers & People-vol-2,issue-2,Jan-2005
http://www.sandrp.in/drp/jan05.pdf
৫) Intralinking of Rivers
http://wrd.bih.nic.in/intralinking.htm
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।