আমি সত্য জানতে চাই
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, আদর্শবাদী, পন্ডিত এবং কূটনীতিবিদ জওহরলাল নেহেরু। তিনি মোট পাঁচবার ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। বৃটিশ সরকারের নীতির বিরোধিতা করায় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদান করায় তিনি বহুবার কারারুদ্ধ হন এবং প্রায় ১৭ বছর জেল খাটেন। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করলে তিনি প্রথম সে-দেশের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বাবস্থায় গান্ধীজীর সহযোগী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুদিন আজ।
১৯৬৪ সালের ২৭ মে ভারতের এই মহান নেতা তার নিজ কার্যালয়ে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।
জওহরলাল নেহেরু ১৮৮৯ সালের আজকের দিনে গঙ্গা নদীর তীরে এলাহাবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মতিলাল নেহেরু এবং মা স্বরুপ রানি। মতিলাল নেহেরু একজন ধনী ব্রিটিশ ভারতের নামজাদা ব্যারিস্টার ও রাজনীতিবিদ ছিলেন।
আইন ব্যবসার কারণে মতিলাল নেহেরু এলাহবাদে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানে একজন আইনজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। জওহরলাল নেহেরু ও তার দুই বোন বিজয়া লক্ষ্মী ও কৃষ্ণা "আনন্দ ভবন" নামক বিশাল বাড়িতে পশ্চাত্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় হযে উঠেন। ইংরেজির সাথে সাথে তাদের হিন্দী ও সংস্কৃতি শিক্ষা দেওয়া হয়। তৎকালীন ভারতের সব থেকে আধুনিক স্কুলে পড়ার পর প্রায় ১৫ বছর বয়সে নেহেরু ইংল্যান্ডের হ্যারোতে চলে যান। এরপর তিনি কেমব্রীজেই ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেন।
ইংল্যান্ডে পড়ার সময় নেহেরু ভারতীয় ছাত্র সংসদের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এই সময়েই তিনি সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন।
(নেহেরু পত্নী কমলা কাউল)
ভারতে ফিরে আসবার পরে ১৯১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জওহরলাল নেহেরু কমলা কাউলকে বিয়ে করেন। তখন তার বয়স মাত্র ২৭ আর তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ১৬। পরের বছরেই কমলা কাউলের গর্ভে তাদের একমাত্র কন্যা ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনির জন্ম হয়।
মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি ভারতের সুযোগ্য ভাবী নেত্রী হিসেবে গড়ে তোলেন। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পর ইন্দিরা গান্ধীও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালীন সময়ে একজন আইনজ্ঞ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সাথে সাথে নেহেরু ভারতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। জাতীয়তাবাদী কর্মকান্ড স্থগিত রেখে সামাজিক সমস্যা ও স্থানীয় সরকারের প্রতি নজর দেন। তিনি ১৯২৪ সালে এলাহবাদ মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।
তিনি দুই বছর এই পদে আসীন থাকেন। ১৯২০ সালে নেহেরু নিখিল ভারত শ্রমিক ইউনিয়ন কংগেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ঐ সময় সুভাষ চন্দ্র বসু যথেষ্ট প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। ১৯২৮ সালে মতিলাল নেহেরুর "নেহেরু রিপোর্ট" প্রকাশিত হয়। ১৯২৯ সালের লাহোর সম্মেলনে গান্ধীর পরামর্শে নেহেরুকে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
১৯২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কংগ্রেস সভাপতি নেহেরু রাভি নদীর তীরে এক জনসভায় ভারতের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ আন্দোলনের ডাক দেয়। লবণের উপর করারোপ করায় নেহেরু গুজরাট সহ দেশের অন্যান্য অংশে সফর করে গণআন্দোলনের ডাক দেন। তিনি এসময় গ্রেফতার হন। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫ সালের মাঝে মাত্র চার মাস ছাড়া বাকি সময় তিনি, তাঁর বোন ও স্ত্রীসহ কারাগারে ছিলেন।
১৯৩৫ সালে জেল থেকে মুক্ত হয়ে নেহেরু সপরিবারে ইউরোপ যান। সেখানে কমলা,নেহেরু চিকিৎসা নেন। তবে স্বাস্থ্যের অবনিত হলে ১৯৩৮ সালে কমলা নেহেরু মৃত্যু মুখে পতিত হন। ১৯৩৬ সালে নেহেরু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এর লক্ষ্মৌ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সে সম্মেলনে ভবিষ্যত ভারতের জাতীয় অর্থনৈতিক নীতি হিসেবে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করার পক্ষে নেহেরু বক্তব্য রাখেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সরকার ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট নেহেরু ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতাকে গ্রেফতার করে। তারা প্রায় সকলেই ১৯৪৫ এর জুন মাস নাগাদ কারাবন্দি রাখেন। নেহেরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী এবং তার স্বামী ফিরোজ গান্ধীও কয়েক মাসের জন্য গ্রেফতার হন। ১৯৪৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র রাজীব গান্ধীর জন্ম হয়। ১৯৪৫ সালে জেল থেকে বের হয়ে তিনি ১৯৪৬-এ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
নির্বাচনের আগে থেকেই নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবি জানাচ্ছিলেন। নেহেরু ভারত বিভাগকে সমর্থন করেন। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়।
১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে নেহেরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনামলে ভারতে ব্যাপক শিল্পায়ন হয়।
এই সময়ে একটি ভারত-পাকিস্তান ও একটি ভারত-চীন যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ভারত-পাকিস্তানের শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি করেন। ২৭ মে, ১৯৬৪ পর্যন্ত তিনি ভারতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ব্যক্তিজীবনে অত্যান্ত রূচিবান পুরুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন জওহরলাল নেহ্রু। তাঁর পরিধেয় বহুল ব্যবহৃত প্রিয় কোটটি "নেহেরু কোট"নামে পরিচিত।
নেহেরু ফ্যাশনের সবচেয়ে চমকপ্রদ অধ্যায়টি হচ্ছে যে-কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে স্বতন্ত্রধর্মী এই কোটটি পরতেন তিনি।
নিউইয়র্কের জনপ্রিয় ট্যাবলয়েড টাইম ম্যাগাজিনের নতুন ফ্যাশন তালিকায় কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো'র ট্র্যাকস্যুট এবং চীনের অবিসংবাদিত নেতা মাও সেতুংয়ের ব্যবহৃত চার পকেটবিশিষ্ট মাও স্যুটের পাশাপাশি স্থান পায় জওহরলাল নেহ্রুর কোটটি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, আদর্শবাদী, পন্ডিত এবং কূটনীতিবিদ নেহরু ছিলেন একজন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। লেখক হিসেবেও নেহরু বিশেষ দক্ষ ছিলেন। জেলে বসেই তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন।
ইংরেজীতে লেখা তাঁর তিনটি বিখ্যাত বই- 'একটি আত্মজীবনী'(An Autobiography), 'বিশ্ব ইতিহাসের কিছু চিত্র'(Glimpses of World History), এবং 'ভারত আবিষ্কার'(The Discovery of India) চিরায়ত সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে।
১৯৬২ সালের ১ম ভারত-চীন যুদ্ধের পরে নেহেরু অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কাশ্মীরে কিছুদিন বিশ্রাম নেন। ১৯৬৪ সালের মে মাসে কাশ্মীর থেকে ফেরার পরে নেহেরু হৃদরোগে আক্রান্ত হন। অবশেষে ১৯৬৪ সালের ২৭ মে নেহেরু তার কার্যালয়ে মৃত্যু বরণ করেন। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, আদর্শবাদী, পন্ডিত এবং কূটনীতিবিদ জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুদিনে আমাদের শুভেচ্ছা
বিঃদ্রঃ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কোন কালেই সকল মানুষের প্রিয় ভাজন হতে পারেনাই।
এক পক্ষে তার সব কিছুর অন্ধ সমর্থক হলেও বিপক্ষে থাকে বৃহৎ একটা দল। সকলের মন যুগিয়ে চলা রাজনীতিবীদদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বলে ইতিহাসকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নাই। কারণ সাগর আর ইতিহাস বিশাল ও উদার বলেই তার বুকে ধারণ করে ভালো মন্দ উভয়কেই। সমুদ্রের অতলে যেমন আছে বিশাল রত্ন ভাণ্ডার তেমনি তার বুকে আশ্রয় দিতে কুণ্ঠিত হয়না কোন উচ্ছিষ্ট নোংরা আবর্জনা।
তেমনি ইতিহাসও তার হৃদয়ে ধারণ করে নিন্দিত নন্দিত সবাইকে। ইতিহাস বড়ই নির্মম, কেউ তাকে পছন্দ করুক আর নাই করুক সে চলে তার নিজস্ব গতিতে। জওহরলাল নেহেরুও একজন রাজনীতিবীদ সুতরাং তার পক্ষে বিপক্ষে মন্তব্য থাকবে, কেউ শ্রদ্ধা আবার কেউ নিন্দাও জানাবে তাকে এটা অস্বাভাবিক নয়। তবে ইতিহাসকে অস্বীকার করার দ্বায় প্রত্যেকের নিজের। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।