আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাবু ভাইয়ের কীর্তিকাহিনী

বাবু ভাই আমাদের থেকে বয়সে বড় হলেও বন্ধুর মতই । কখন কিভাবে তার সাথে আমাদের পরিচয় ঘটল তা এখন আর কারো মনে নেই। রোগা মানুষ, গড় উচ্চতা। চুল গুলো পরিপাটী করে সামনে দিকে আচড়ানো থাকে। আমাদের ধারণা নব্য টাক ঢাকার জন্য এই প্রয়াস।

বাবু ভাই অবশ্য এটা স্বীকার করেন না, বলেন “তোরা ফ্যাশন এর কি বুঝিস ? “আগে নাকি বাবুভাই আরো মোটা ছিল, কি এক কারণে তিনি হঠাৎ রোগা হয়ে গেলেন (সেটি অবশ্য আরেক গল্প) ভীষণ আড্ডা প্রিয় মানুষ। আমরাও আড্ডায় বাবু ভাইকে না পেলে অস্থির হয়ে যাই। ঐদিন কিভাবে কিভাবে যেন আড্ডায় সোমালিয়ার কথা উঠল। ফট করে বাবু ভাই প্রশ্ন করে উঠলেন “ বলতো সোমালিয়ার রাজধানী কোথায় ?” আমাদের সবাইর বিভিন্ন বিষয়ে অমিল থাকলেও সাধারন জ্ঞানের অজ্ঞানতায় মিল রয়েছে। সবাই মাথা চুলকাচ্ছে।

সবাইর ভাবটা এমন পেটে আছে, মুখে আসছে না। কে একজন মিনমিনে গলায় বলার চেষ্টা করল “ হনুলুলু নাকি !” আমরা হাসতে লাগলাম। শরীর অনুপাতে বাজখাই গলার খামোশ শব্দে চমকে উঠলাম। “সোমালিয়ার রাজধানী এই সহজ প্রশ্ন পারিস না, আবার হাসছিস, গাধার দল ! “আমরা চুপ হয়ে রইলাম। বাবু ভাই পকেটে হাত ঢুকিয়ে চলে যাচ্ছেন।

আমরা হা হা করে উঠলাম,” আরে আরে না বলে কোথায় চলে যাচ্ছেন?” বাবু ভাই বললেন, “"কি না বলে !”" “ আজব, সোমালিয়ার রাজধানী কোথায় বলে যাবেন না ! “। “ আমি জানলে কি আর তোদের জিজ্ঞেস করি - গাধার দল সব “ আমরা তো অবাক, আমরা ভেবেছিলাম উনি জানেন ! বাবু ভাইয়ের কৌতুক বোধ প্রবল। কেউ কোন কৌতুক বললে কেউ মজা পাক বা না পাক, বাবু ভাই খুব মজা পায়। ভয়ংকর সে মজা পাওয়া। হাসির দমকে ফুলে ফুলে উঠেন ।

মনে হয় এই বুঝি দম আটকে গেল। টেবিলে দুই রাম চাপড় দিবে। টেবিল না থাকলে কার পিঠেই চালিয়ে দিবে। এইজন্যে কেউ কোন কৌতুক বলার সামনে টেবিল থাকুক আর না থাকুন, আমরা একটু দুরেই থাকি। কৌতুক শুনতে গিয়ে অন্যের কৌতুকে পরিনত হবার প্রয়োজন কি ? সেও মাঝে মাঝে কৌতুক বলে ।

শুনে আমরা খুব হাসি। হাসি এই কারণে নয় যে, কৌতুকটা খুব মজার ছিল। তার কৌতুক বলার ভঙ্গী এত ভয়ানক, আগের লাইন পরে, পরের লাইন আগে কৌতুকটাকে একটা ভজঘট লাগিয়ে তড়িগড়ি করে শেষ করে হাফ ছেড়ে বাচেন। তারপর নিজেই হাসতে থাকেন হা হা করে। ওর হা হা শুনেই বুঝি কৌতুক শেষ হয়েছে, এবার আমাদের হাসির পালা।

কৌতুকের কোন অংশটুকু হাসির তা না বুঝেই সবাই একসাথে হাসি আর বলি, কৌতুকটা যা ছিল না মাইরি ! সেবার কোন এক কনসার্টের ফ্রি টিকেট ছেড়েছিল একটি কোমল পানীয় কোম্পানি। আমরা ফ্রি টিকেটের জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলাম। শেষ পর্যন্ত, দশ বারোজনের জন্য টিকেট ম্যানেজ হয়ে গেল বিশটা। হায় হায়, এখন কনসার্ট দেখার জন্য বাকি লোকও খুঁজে পাচ্ছি না। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, ঠিক আছে, বাকিগুলো বিক্রয় করে আমাদের ভুরিভোজ হবে।

সবই মাগনা। কনসার্ট শুরুর আগেই ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌছে গেলাম। গিয়ে দেখি সর্বনাশ। ‘কাতারে কাতার, বান্দা হাজার’ হাজির এন্ট্রি গেটের সামনে। ঢুকতে দিচ্ছে কিনা, কে জানে ! সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়ালাম।

জনতা একটু পর পর উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। গলা ফাটিয়ে একটু পর পর চিৎকার করছে আর সামনের দিকে ধাক্কা দিচ্ছে, যেন ধাক্কা দিলে সামনের গেট ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে যাবে। শুধু গানটাই বাকি ছিল , ‘কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট ‘ পুলিশ একটু পর দাবড়ানি দিচ্ছে । দাবড়ানি দেবার কৌশল দারুণ। ছাগল খেদানোর মতো হাতের মোটা লাঠি দিয়ে রাস্তায় বাড়ি দিতে দিতে সাথে মুখে কিত কিত করে দাবড়ানি।

কি জানি, তখন কি হয় ! লাঠির টাক টাক আর মুখের কিত কিত আওয়াজ শুনে শরীর তার জায়গায় থাকতে চায় না। কেবল দৌড়াতে চায়, গেছিও বার কতক। আবার, নিরাপদে লাইনের পিছনের গিয়ে দাঁড়াই। বানরের তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্কের মতো দুই ফুট এগোই আবার আড়াই ফুট পিছাই। বানর তাও বাঁশ উত্তরণ সম্পূর্ণ করে, আমাদের মনে হচ্ছে না আমরা বাঁশের আগায় উঠতে পারব।

বাবু ভাই বললেন, “ধুর, এভাবে ভিতরে ঢোকা যাবে না। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। পুলিশ দেখবি বাইরের দিকে কেবল তাড়া দিচ্ছে । স্টেডিয়ামের দোকানগুলোর সামনের জায়গায় যাচ্ছে না । ঐদিকটা একটু অন্ধকারও আছে।

আর দ্যাখ, পুলিশ কাউকে মারছে না । কেবল ভয় দেখাচ্ছে । এবার যদি দৌড়ানি দেয়, আমরা আর বাইরের দিকে দৌড় দিব না, ভেতরের দিকে চেপে যাব। তারপর, লাইন শুরুর দিকে দাঁড়াব“ ভাল বুদ্ধি। দুয়েকজন গাঁই গুই করার পরও , সবাই রাজি হয়ে গেলাম।

লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাবড়ানীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঠিকই পুলিশের সময় হল দাবড়ানির। পুলিশ রে রে করে তেড়ে এলো। সবাই আমাদের গ্রুপ নাটক সার্থক করার জন্য যে যার মতো ছুটছে। আমরা ভিতরের দিকে চেপে রইলাম।

এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু পুলিশের মতি-গতি যে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের পারফরমেন্স এর মত আনপ্রেডিক্টেবল,তা কে জানত ? পুলিশের ধৈরজ চ্যুতি ঘটবে কেন ? আমাদের প্ল্যানে তো পুলিশের ধৈর্যচ্যুতি ছিল না। নাটক আমাদের ডিরেকশন ছাড়াই নিজস্ব গতিতে চলতে লাগল। পুলিশের মোটা লাঠি উঠানামা করতে লাগল। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে আহা-উহু, ও মারে, আওয়াজ আসতে লাগল।

আমরা তো ভেতরের দিকে চেপে আছি। পরিস্থিতি যে আমাদের প্ল্যানের বাইরে চলে গেছে এটা প্রথমটায় বুঝতে পারি নাই। বুঝার পরও সহজে বের হতে পারে নি, কারন বাইরের লোকগুলো কান্ডজ্ঞানহীনের মত ভেতরের দিকে আসার চেষ্টা করছে আর আমরা বেরোবার চেষ্টা করছি। যখন বের হলাম, পুলিশ তখন হাত তিনেক দূরে। খিঁচে দৌড় লাগালাম।

সামনে কে একজন পড়ে গেল, তার সাথে সাথে আমিও হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। হাত মনে হয় অন্য কাজের ব্যস্ত ছিল। হুড়মুড়িয়ে গিয়ে নাকের উপর গিয়ে পড়লাম। নাকের অবস্থা দেখার সময় কই ? পিছনে তাকিয়ে দেখি একজন জলজ্যান্ত পুলিশ লাঠি বাগিয়ে আছে। নাটকটা হঠাৎ করে স্লো মোশনে চলা শুরু করল।

লাঠিটা তখন উর্দ্ধে আছে, ধীর গতিতে নিচে নেমে আছে। পুলিশের তো শরীরতত্ত্ব নিয়ে আইডিয়া আছে কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। শরীর কোন অঙ্গ কোন জায়গায় বিরাজমান, কোন কোন অঙ্গ সেনসিটিভ তা পুলিশ জানে তো ! আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম। পাছার কাছটা সিরসির করে উঠল। এখনি তো গদাম করে করে পড়বে।

কিছু সময়ের জন্য বোধকরি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। কারন চোখ মেলে দেখি পুলিশ আর নাই। শরীরে কোন ব্যথা নেই। যাক বাব, এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। পুলিশ মনে হয় আমার চেহারা দেখে মায়া করে ছেড়ে দিয়েছে।

সামনে আরো তাগড়া জোয়ান, আরো ভাল শিকার আছে কিনা। দুর্বল প্রাণী শিকার করে ফায়দা কি ? কিছুক্ষন পর, সবাই একটু নিরাপদ দুরুত্বে একসাথ হলাম। আমার একপাটি স্যান্ডেল গ্যাছে, শাহেদের ঘড়ি, রনির ক্যাপ আর প্রাপ্তির ঘরে আমার ফাটা নাক, শাহেদের মাথায় আলু, লিপনের ট্যামা হাত। আমরা হিসাব করে দেখছিলাম। হঠাত খেয়াল করি, আমাকের আইডিয়াবাজ বাবু ভাই কই ? এদিক ঐদিক খুঁজতে লাগলাম।

দেখলাম, পুলিশের গাড়ির সামনে বাবু ভাই। এক পুলিশ বাবু ভাইয়ের হাত ধরে রাখছে। আমরা একটু দূরেই ছিলাম। আবার পুলিশের খপ্পরে পড়ার কোন খায়েশ কারোই ছিল না। শুনতে লাগলাম, বাবু ভাই বলছেন, “ আমাকে ধরছেন কেন ? আমি তো আমার জুতা নিতে আসছি !” পুলিশ, “ জুতা নিতে আসছেন কেন ? জুতা নিয়ে আসবেনই যখন জুতা ফেলেই দৌড়ালেন ক্যান ?“ বাবু ভাইঃ “ আশ্চর্য তো ! আপনারা এমন গরুপেটা করছেন।

এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আপনাদের হাতের সুখ মেটাই , হু , এতো পরোপকারী আমি নই। “ পুলিশঃ “ করছি তো গরুপেটা, আপনার যদি মানুষই হবেন দৌড়াবেন কেন ? এইরকম ফ্রি কনসার্ট দেখার গরুরাই হামলে পড়ে। “ বাবু ভাইঃ “ আপনি আমাকে গরু বলছেন ! আশ্চর্য তো । মুখ সামলে কথা বলুন । আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারেন না।

আমি বি কম পাশ বাংলাদেশি নাগরিক। আপনাদের রাখা হয়েছে আমাদের সেবা করার জন্য। হুম। “ আমরা বাবুভাইয়ের সাহস দিকে মোহিত। আহা কিভাবে কথা বলছেন পুলিশের সাথে।

পুলিশ, “ এই এটাকে গাড়িতে তোল, ইনার সেবার প্রয়োজন। আশা করি আমাদের সেবায় ইনি সন্তুষ্ট হবেন । “ আমরা মানে মানে সটকে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। পুলিশের সাথে বাহাস করার কোন ইচ্ছা ছিল না। বাবু ভাই ইতিউতি তাকিয়ে আমাদের দেখলেন এবং সাথে সাথে বুঝলেন আমরা সটকে পড়ার তালে আছি।

বলে উঠলেন, “ তোরা আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছিস ! ওরে লিপন, রনিরে আমাকে বাঁচারে, পুলিশ আমাকে খেয়ে ফেললরে । “ এই আকুতিতে তো তাকে ফেলে রেখে চলে যাওয়া যায় না। আমরা গুটি গুটি পায়ে এগোলাম। পুলিশের নেতা গোছের একজনকে বললাম, “ স্যার, আমরা আসলে স্টুডেন্ট। উনি আমাদের বড় ভাই।

ফ্রি কনসার্টের লোভে পড়ে চলে এসেছি। আর জীবনে ফ্রি কোনকিছুই নিব না, সাধলেও না। “ নেতা বললেন ,” যাও, নিয়ে যাও বি. কম. পাশ করা সম্মানিত নাগরিক, যত্তসব। ওরে, জুতাগুলো রেখে ওকে ছেড়ে দে “। বাবু ভাই আবার কিছু বলতে গিয়েছিলেন ।

আমরা টেনে ওখান থেকে নিয়ে আসলাম। বাবু ভাই ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন। আমার জুতা, আমার জুতা করতে করতে কতক্ষন ঝিম মেরে রইলেন। হঠাত দেখি মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। যা বাবা , জুতার শোকে পাগল হয়ে গেলেন কিনা ! আবার কামড়ে টামড়ে দ্যায় কিনা, আমি একটু দূরে সরে রইলাম।

শাহেদ বলল, “ কি হইছে বাবু ভাই ?” । “ জুতা হারাইলে কি হইব, আমি একটা ঘড়ি পাইছি। হা হা হা। ভীড়ের মধ্যে পড়ে গ্যাছি। হাতে কি জানি লাগল ।

দেখি একটা ঘড়ি। ব্যস, আমি পকেটে পুরে ফেললাম। ঘড়িটা বেশ দামী মনে হচ্ছে রে। “ বলে হাতটা একটু উচু করে আমাদের দেখাতে লাগলেন। শাহেদ বলে উঠল, “ ঐ মিয়া, এটাতো আমার ঘড়ি।

আপনি পকেটে পুরে ফেলেছেন না ! আমার ভাইয়ের ঘড়ি। বাসায় গেলে আজকে নির্ঘাত প্যাঁদানি ছিল। “ এই বলে খপ করে ঘড়িটা ছিনিয়ে নিল বাবু ভাইয়ের হাত থেকে। বাবু ভাই আরো মিইয়ে গেলেন। জুতার শোকে না ঘড়ির শোকে ঠিক বোঝা গেল না।

তারপর আর মাসখানেক আর বাবুভাইয়ের খবর নাই। আড্ডায় আসেন না, ফোন দিলেও ধরেন না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।