আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাপেক্স রেখে রাশিয়া কেন?

আরিফুজ্জামান মামুন দেশীয় গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে বাদ দিয়ে বেশি অর্থ খরচ করে বিদেশি গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের সঙ্গে চুক্তি করেছে পেট্রোবাংলা। গত ৯ জানুয়ারি এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো এই চুক্তি করা হয়েছে সম্পূর্ণ বিনা টেণ্ডারে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী দ্রুত সরবারহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) বিলের সুযোগ নিয়ে এই চুক্তি করা হয়েছে। বিনা টেন্ডারে রাশিয়ার কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে স্থলভাগের ১০টি কূপ খননের কাজ দেয়া হয়েছে।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাপেক্সের মালিকানাধীন বেগমগঞ্জ, শাহাবাজপুর, শ্রীকাইল, সেমুতাং ও সুন্দলপুর কূপ এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিজিএফসিএল এর মালিকানাধীন তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের ৪টি, এসজিএফএল এর মালিকানাধীন রশিদপুরের ১টি কূপ। এই ১০টি অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপ খনন করতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। প্রতিটি কূপের গড় ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। ২১ ডিসেম্বর পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এক চিঠিতে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য গ্যাজপ্রমকে আমন্ত্রণ জানায়। চুক্তির সময় বাপেক্সের পুজি ও প্রযুক্তির অভাবের কথা বলা হলেও রাশিয়ার গ্যাজপ্রমকে স্থলভাগে ১০টি গ্যাসকূপ খননের কাজ দেয়া হয়েছে, সেই কাজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স শুধু যে দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে তা নয়, গ্যাজপ্রমের দাবি করা অর্থের অর্ধেকেরও কম খরচে সম্পন্ন করতে পারে।

যা সালদা নদী, ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর, সুন্দলপুর, সেমুতাং ইত্যাদি গ্যাসকূপ খননের মাধ্যমে বাপেক্স ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছে। রাশিয়ার যে কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়েছে সেই কোম্পানি সারা বিশ্বে বিতর্কিত। বিশ্বের মোট উৎপাদিত তেল-গ্যাসের ৮.৩% সরবরাহকারী রাশিয়ার এই জায়ান্ট কোম্পানিটি ঘুষ-দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, চুক্তি ভঙ্গ, চুক্তির বাইরে বাড়তি অর্থ দাবি করে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি নানা কারণে কুখ্যাত যাকে গত ২০১১ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও রেভিনিউ ওয়াচ ইনস্টিটিউট তাদের যৌথ জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে অস্বচ্ছ কোম্পানি হিসেবে উল্লেখ করেছে। এ ধরনের একটি কোম্পানির হাতে বিশেষ জ্বালানি আইনের দায়মুক্তির সুযোগে বিনা টেন্ডারে দ্বিগুণ অর্থ ব্যয়ে ১০টি কূপ খননের কাজ দিয়ে এবং ভবিষ্যতে পেট্রোবাংলার সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার ও জ্বালানি সেক্টরের মাস্টার প্ল্যান তৈরি করার দায়িত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতকে নতুন আরেকটি ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিনা টেণ্ডারে ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে বাদ দিয়ে বিদেশি কোম্পানির সাথে গ্যাস উত্তোলনের চুক্তির প্রক্রিয়ার কঠোর সমালোচনা করে প্রভাবশালী এশিয়া টাইমস অনলাইন ১০ জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘কোনো ধরনের টেন্ডার ও উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি বা পিএসসি ছাড়াই গত মাসে রাশিয়াকে গ্যাসকূপ খননের কাজ দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সখ্যের প্রকাশ ঘটাল বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ রাশিয়ার তৈরি সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্য ৮৫ কোটি ডলারের সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিটেরও আশায় আছে। ’ এশিয়া টাইমসের এই প্রতিবেদনে, প্রায় ২০০ কোটি ডলারের একটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য গত বছর রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি এবং ২০০১ সালের আগের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১২.৪ কোটি ডলার ব্যয়ে ৮টি মিগ-২৯ কেনার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। রাশিয়ার গ্যাজপ্রমের সঙ্গে ১০টি গ্যাসকূপ খননের এই চুক্তির প্রেক্ষাপটে রয়েছে গত ২০০৯ সালের ১২ জুলাই জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নেওয়া ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগাম। এই প্রোগ্রামের আওতায় গত ১৬ আগস্ট, ২০০৯ সালে পেট্রোবাংলা ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ নামে একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপজাল বা ডিপিপি প্রস্তত করে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠায় যেখানে দেশের গ্যাস উত্তোলন ত্বরান্বিত করার জন্য বিদেশী কন্ট্রাক্টর ভাড়া করে ৩,১০০ লাইন কি.মি. সিসমিক সার্ভে, তিতাসে ৪টি এবং রশিদপুরে ২টি গ্যাসকূপ খননের পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। ডিপিপি অনুসারে বাপেক্সের মালিকানাধীন ৩, ৬, ৮ ও ১১ নম্বর ব্লকের মোট ৩,১০০ লাইন কি.মি. দ্বিমাত্রিক সিসমিক সার্ভে, বিজিএফসিএলের মালিকানাধীন তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের ১৯, ২০, ২১, ২২নং গ্যাসকূপ খনন এবং এসজিএফএলের রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের ৮নং গ্যাসকূপ খনন ও ৫নং গ্যাসকূপ ওয়ার্কওভার করার কাজ অক্টোবর ২০০৯ সালে শুরু হয়ে ডিসেম্বর ২০১২-এর মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা।

বাপেক্স যে কাজগুলো স্বল্পখরচে করতে পারে সে কাজগুলোই বিদেশী কোম্পানিকে ভাড়া করে বাড়তি খরচ বহন করে করার পেছনে যুক্তি দেখানো হয় স্বল্পসময়ে সিসমিক সার্ভে ও কূপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় সিসমিক ক্র ও পর্যাপ্ত ড্রিলিং রিগ ও দক্ষ জনশক্তি না থাকার। অথচ বাস্তবতা হলো, ২০০৯ সালের অক্টোবরে শুরু হয়ে যে ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ কাজ ২০১২-এর ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা সেই কাজ ২০১২ সালের জানুয়ারিতে এসেও শুরুই হয়নি। টেন্ডারে নির্বাচিত কোম্পানির মামলা-মোকদ্দমা এবং নির্বাচিত কোম্পানির কাজ করতে অস্বীকৃতি ইত্যাদি নাটকের মাধ্যমে দুই বছরেরও বেশি সময় নষ্ট করার পর এখন আবার কোনো ধরনের দরপত্র আহবান ছাড়াই ১৮ মাসে কাজ সম্পন্ন করার কথা বলে মোট ১০টি কূপ খননের চুক্তি করা হয়েছে রাশিয়ার কোম্পানি গ্যাজপ্রমের সঙ্গে। বলা হচ্ছে, ১৯৯৭ থেকে ২০১১ সালে পিএসসি চুক্তির আওতায় বিদেশী কোম্পানি কর্তৃক কূপ খননের গড় খরচ পড়েছে ২০.৪১ মিলিয়ন ডলার বা ১৬৩ কোটি টাকা করে। সুতরাং গ্যাজপ্রমকে গড়ে ১৯.৩৫ মিলিয়ন ডলার বা ১৫৫ কোটি টাকা করে কন্ট্রাক্ট দেয়া যুক্তিযুক্ত।

অথচ এই তুলনা করার সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের গড় খরচের কথার কোনো উল্লেখ দেখানো হয়নি। বাপেক্সের একেকটি কূপ খননের গড় খরচ ৭০/৮০ কোটি, টাকা যা গ্যাজপ্রমের প্রস্তাবিত খরচের অর্ধেক। উদাহরণস্বরূপ : বাপেক্সের নিজস্ব লোকবল ও রিগের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন মোবারকপুর অনুসন্ধান কূপ খননে ৮৯.২৬ কোটি টাকা (গভীরতম কূপ), শ্রীকাইল-২ কূপ খননে ৮১.১২ কোটি টাকা, সুন্দলপুর কূপ খননে ৭৩.৬৫ কোটি টাকা (প্রকৃত ব্যয় ৫৫ কোটি টাকা) এবং কাপাসিয়া কূপ খননের জন্য বাপেক্সের ৭০.১৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। স্পষ্টতই, এভাবে গ্যাজপ্রমের প্রস্তাবিত গ্যাস কূপ খননের খরচের তুলনা বাপেক্সের সঙ্গে না করে অন্য বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে করার মানে হলো, পুরনো অনিয়মের দোহাই দিয়ে নতুন করে তা আবার জায়েজ করা। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, টেন্ডার ছাড়া পছন্দসই বিদেশি কোম্পানিকে ডেকে এনে কাজ দেয়ার এই ধারা শুরু হলে সামনের দিকে দেশের অর্থনীতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।

আগামীতে এই ধারা চর্চা হলে আমরা একেবারে শেষ হয়ে যাব। গ্যাজপ্রমকে কাজ দিয়ে সরকার প্রমাণ করল, জ্বালানি খাতের সমস্যা নিরসন নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাটেই তাদের মনোযোগ বেশি। এটা সবাই জানে, চাইলেই সরকার বাপেক্সকে দিয়ে এই কাজ করাতে পারত। তাতে ব্যয়ও অনেক কম হতো। কিন্তু সরকার সেই পথে হাঁটেনি।

সরকার গেছে বিদেশি কোম্পানি তোষণের পথে। এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য সুখকর কিছু নয়। এ প্রসঙ্গে বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামালউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, বাপেক্স এর পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও লোকবলের অভাব আছে। এটা খুবই সত্যি কথা কিন্তু এটা তো এমন কোনো সমস্যা না যা সমাধান করা যায় না। গ্যাস উত্তোলনে রিগ মেশিনসহ প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি চাইলে সরকার ধীরে ধীরে কিনতে পারে।

ভাড়াও আনা যায়। লোকবলের অভাব কোনো সমস্যাই না। আমি মনে করি, সরকার ডাক পাঠালে দেশ-বিদেশ থেকে অনেক প্রকৌশলী এসে হাজির হবে দেশের স্বার্থে কাজ করার জন্য। এভাবে নিজেদের সামর্থ্য বাড়ানোর চেষ্টা না করে বিদেশি কোম্পানির পেছনে ছোটা হলে তো আমাদের সমস্যা চিরকালই থেকে যাবে। আর তথাকথিত এই জরুরি সঙ্কটের সমাধান কোনোদিনই আসবে না।

জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বরে রাশিয়া সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সফরেই গ্যাজপ্রমের বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়টি আলোচনা হয়। ওই সফরের পরই বাংলাদেশে আসে গ্যাজপ্রমের একটি প্রতিনিধি দল। এ ছাড়া গত ৭ এপ্রিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি গ্যাজপ্রমের আমন্ত্রণে তাদের সদর দফতর পরিদর্শন করেন। তখন তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা মশিউর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুরও ছিলেন।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.