আলোকিত জীবনের একজন সহযাত্রী বিদেশী বিনিয়োগের নামে আমাদের জাতীয় সম্পদ বহুজাতিক কর্পোরেশনের হাতে তুলে দেয়ার যুক্তি হিসেবে সব সময়ই যে দুটি বিষয়ের কথা বলা হয় তা হলো পুঁজি ও দক্ষতার অভাব। স্থলভাগ কিংবা সাগরের গ্যাস ব্লক ইজারা প্রদান কিংবা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক ফুলবাড়ি-বড়পুকুরিয়ার কয়লা উত্তোলনের তৎপরতা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই এ দু'টো অজুহাত প্রদান করা হয়। সামপ্রতিক কালে সাগরের তিনটি গ্যাস ব্লকের ৮০% মালিকানা ও রপ্তানির সুযোগ কনোকো ফিলিপস ও টাল্লোর হাতে তুলে দেয়ার তৎপরতার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাপেক্সের দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এবং এ কাজে বহুজাতিকের তুলনায় খুব স্বল্প পুঁজির প্রয়োজন হলেও কেন স্থলভাগের বেশির ভাগ গ্যাস ব্লক বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর হাতে তুলে দেয়া হলো? এই প্রশ্নটা তোলা জরুরি কেননা এর উত্তরেই লুকিয়ে আছে সাধারণ ভাবে রাষ্ট্রীয় খাতগুলোকে দুর্বল করে সেই সব খাতে বিদেশী বিনিয়োগ ও লুটপাটের বাস্তবতা নির্মানের রহস্য। এ বিষয়টিকে মাথায় রেখে তেল-গ্যাস-কয়লা উত্তোলনে রাষ্ট্রীয় খাতের দুর্বলতা সম্পর্কে প্রচার প্রচরণার আড়াল সরিয়ে আমরা এখানে বাপেক্স/পেট্রোবাংলার সামর্থ্য/অসামর্থ্য, অর্জন, ব্যর্থতা ও ব্যর্থতার কার্যকারণগুলো একটু বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।
বাপেক্সের সৃষ্টিই একে দুর্বল করার লক্ষ্যে
১৯৮৯ সালে বাপেক্সের সৃষ্টি হলেও এই প্রতিষ্ঠানটি পাকিস্তান আমলের Oil and Gas Development Company বা OGDC (১৯৬২-১৯৭১) এবং বাংলাদেশের পেট্রোবাংলা (১৯৭১-৮৯) এর উত্তরসূরী। ১৯৬২ সালে সোভিয়েত সহায়তায়OGDCপ্রতিষ্ঠার পর থেকে পাকিস্তান আমলেই বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম করে শুরু করে এবং ৪টি কূপ খনন করে সেমুতাং এ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারও করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সাবেক OGDCএর জনবল, রিগ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে দেশে "তৈল সন্ধানী" নামে একটি অনুসন্ধান কোম্পানী সৃষ্টি করা হয় এবং মূলত এ কার্যক্রমকে দেখভাল করার জন্য পেট্রোবাংলা সৃষ্টি করা হয়। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে "তৈল সন্ধানী"কে পেট্রোবাংলার সাথে একীভূত করা হয়। এর পর থেকে পেট্রোবাংলাই (এর এক্সপ্লোরেশন ডিরেক্টরেট) এই অনুসন্ধানের কাজ চালায়।
১৯৮৯ সালে বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে পেট্রোবাংলা এর Exploration Directorate কে অবলুপ্ত করে বাপেক্স গঠন করা হয়। আপাত দৃষ্টিতে এ ব্যবস্থা অনুসন্ধান কার্যক্রমকে জোরদার করার উদ্যোগ মনে হলেও মূল উদ্দেশ্য ছিল ঠিক উল্টো। কোন আয়ের উৎসবিহীন বাপেক্স দ্রুত একটি উদ্যমহীন হতাশাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়। শুরু থেকেই এর আর্থিক দিকসমূহ যেমন তার আয়, স্থায়ী খরচ, অনুসন্ধান ও খনন খরচ সবকিছুই দারুণ অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে। একেকটা প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ লম্বা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার কারণে বাপেক্সের কাজ হয়ে পড়ে দারুণ মন্থর।
বছরের শুরুতে ঘোষিত বরাদ্দটুকু যে কতদিনে আসবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, অসংখ্যবার সংশোধিত বাজেট হয়ে সেটা বাপেক্সের হাতে আসে অনেক খর্বিত আকারে, কখনো কখনো আসে অর্থবছরের একদম শেষ সময়ে - খুব অল্প সময়ে সেই বরাদ্দটুকু খরচ করে ফেলার একটা তাগিদ এবং তার সাথে সাথে দুর্নীতির সুযোগ সহকারে। আর এসবের মাঝে পড়ে সে সময় থেকে শুরু হয় বাপেক্সের দক্ষ লোকদের বাইরে চলে যাওয়া। সকলের হতাশা আরো বাড়িয়ে যখন ৯০ এর দশক জুড়ে ব্লকগুলো একের পর এক বিদেশী কোম্পানিদের হাতে তুলে দেয়া হয়- তখন বোঝা যায় বাপেক্সকে এমন ঠুঁটো জগন্নাথ বানানোর প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য।
বাপেক্সের সক্ষমতা:
ক) সাফল্যের হার
১৯১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশী বিদেশী কোম্পানি মিলে অনুসন্ধান কুপ খনন করেছে ৭৫টি যার মধ্যে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে ২৫ টি৪ অর্থাৎ সাফল্যের হার ৩:১। অন্যদিকে শুধু দেশীয় কোম্পানির কথা যদি ধরি তাহলে ওজিডিসি, পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স মিলিত ভাবে এ পর্যন্ত ১৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে।
এদের মিলিত সাফল্যের হার ২.২৫:১। আর শুধু বাপেক্সের কথা যদি ধরি তাহলে বাপেক্স ৪টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ৩ টি তে গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে অর্থাৎ সাফল্যের হার ১.৩৩:১৬, অর্থাৎ যে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের দক্ষতাহীনতার কথা বলে বহুজাতিক কোম্পানি ডেকে আনা হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের হার বাংলাদেশ কর্মরত ঐসব বিদেশী কোম্পানীর সাফল্যের হারের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি!
খ) নির্ভরযোগ্যতা
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মূল লক্ষ্য মুনাফা। ফলে মুনাফার জন্য বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, জাতীয় সম্পদ কিংবা পরিবেশের ভারসাম্য ইত্যাদি বিসর্জন দেয়া এসব তথাকথিত দক্ষ ও অভিজ্ঞ বহুজাতিকের জন্য কোন ব্যাপার-ই না। ফলে অক্সিডেন্টাল ও নাইকোর মতো �উন্নত প্রযুক্তি� ওয়ালা কোম্পানিগুলোর হাতে মাগুরছড়া ও টেংরাটিলার মত পরিবেশ ও সম্পদ বিনাশী দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। অথচ পুরাতন ও জীর্ণ যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করলেও বাপেক্স/পেট্রোবাংলা বা দেশীয় কোন কোম্পানির হাতেই এ ধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেনি।
একই ভাবে সাংগু গ্যাস ফিল্ডের মত তড়িঘড়ি করে ক্যাপাসিটির বেশী গ্যাস উত্তোলন করতে গিয়ে রিকাভরেবল গ্যাস উত্তোলনের অনেক আগেই গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদনক্ষমতা নষ্ট করার ঘটনাও পেট্রোবাংলা/বাপেক্সের নেই।
গ) বহুজাতিকের সাবকণ্ট্রাক্টর হিসেবে কার্যক্রম
দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার অজুহাতে বার বার বিদেশী কোম্পানিকে ডেকে আনা হলেও বাপেক্স তার সীমিত প্রযুক্তি দিয়েই স্থলভাগের গ্যাস উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কাজ করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, নিজের জন্য ছাড়াও বাপেক্স বহুজাতিক কোম্পানিকেও সাবকণ্ট্রাক্টর হিসেবে অনেকগুলো কাজ করে দিয়েছে। যেমন: বাপেক্স ফেনী-২ এ নাইকোর একটা অনুসন্ধান কূপ খনন করে দেয়, টাল্লোর হয়ে লালমাই ও বাঙ্গোরায় সিসমিক সার্ভের কাজ করে, চাঁদপুরে একটা কন্ট্রোল পয়েন্ট স্থাপন করে দেয় এবং বাঙ্গোরায় টালে−ার একটা কূপও (ওয়ার্ক ওভার) খনন করে দেয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো বাঙ্গোরায় টাল্লোর ওয়ার্ক ওভার কূপটি খননের জন্য বাপেক্স নেয় ১০ লাখ ডলার, যদিও বাপেক্সের খরচ হয় মাত্র ৫৩ লাখ টাকা।
সাবকন্ট্রাক্টর হিসাবে বহুজাতিকের কাছ থেকে এত লাভ বাগিয়ে নিতে দেখে খুশি হওয়ার কিছু নেই কারণ ঐ ১০ লাখ ডলার কিন্তু ঠিকই টাল্লো তার রিকভারি কস্টের মধ্যে দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকেই আদায় করে নিয়েছে! আমরা কেবল আফসোস করতে পারি আহা, ঐ গ্যাসক্ষেত্র যদি বাপেক্সের হাতে থাকতো তাহলে তো ১০ লক্ষ ডলারের বদলে স্রেফ ৫৩ লাখ টাকায় কাজটি করে ফেলতে পারতাম আমরা।
ঘ) কম খরচ
গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বিদেশী কোম্পানির হাতে উত্তোলিত গ্যাসের ৮০ শতাংশ মালিকনা তুলে দিতে হয় এবং সেই সাথে কস্ট রিকভারি�র নামে তারা বছর বছর হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। আমরা হিসেব করে দেখেছি দেশীয় কোম্পানি বাপেক্স কূপ অনুসন্ধান, কূপ উন্নয়ন, গ্যাস উত্তোলন ও প্রসেসিং প্ল্যান্ট সব মিলিয়ে গড়ে ৪০০ কোটি টাকা খরচ করে (প্রতি তিনটি কূপ খনন করে একটিতে সফল এই হিসেবে দুইটি শুস্ক কুপ খননের বাড়তি খরচও এখানে অনত্মর্ভুক্ত করা হয়েছে) গড়ে ২৪৫ বিসিএফ (বিলিয়ন কিউবিক ফুট) গ্যাস উত্তোলন করে যার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ২০ হাজার ৪১ কোটি টাকা (১ জুন ২০০৯ এর বাজার দর অনুসারে ১ ব্যারেল তেলের দাম ৬৬ ডলার ধরে)। অথচ বহুজাতিক কোম্পানির সাথে পিএসসি চুক্তির ফলে গড়ে তাদের কাছ থেকে ২৪৫ বিসিএফ গ্যাস পেতে হলে পিএসসি অনুসারে প্রতি মেট্রিকটন তেলের দাম সর্বোচ্চ ১৪০ ডলার অর্থাৎ প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের মূল্য ৩.৩৮ ডলার বা ২৩৬ টাকা ধরলে খরচ করতে হয় ৪৬২৫.৬ কোটি টাকা।
শুধু কূপ খনন বা গ্যাস উত্তোলন না, গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য যে সার্ভে করতে হয় সেখানেও বাপেক্সের বদলে বহুজাতিক কোম্পানিকে দিয়ে করানো হলো ৬/৭ গুণ বাড়তি খরচ গুনতে হয়।
তারপরও বাপেক্সের বদলে বহুজাতিককে দিয়েই এসব কাজ করানোর তৎপরতা চলে। চলমান গ্যাস সংকটের প্রেক্ষিতে গত বছর ২০০৯ সালে �ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রাম� নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পটিতে অতি দ্রুত নতুন নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ করার জন্য বাপেক্সের হাতে থাকা ৩, ৬, ৮ ও ১১ নম্বর ব্লকের মোট ৩,১০০ লাইন কি.মি ২উ সিসমিক জরীপের কাজ তিন বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। এ জন্য পেট্রোবাংলা থেকে তৈরী করা ডেভেলাপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপজাল (ডিপিপি) বা উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনাতে বলা হয়েছে যেহেতু বাপেক্সের বর্তমান যন্ত্রপাতি ও লোকবল দিয়ে বছরে ৩০০-৩৫০ লাইন কি.মি এর বেশী সিসমিক সার্ভে করা সম্ভব নয় সেহেতু বছরে ১০০০ লাইন কি.মি সিসমিক সার্ভে করতে পারে এরকম কোন বিদেশী কোম্পানিকে দিয়ে কাজটি করানো হোক। তিন বছর মেয়াদি এই সিসমিক সার্ভে প্রকল্পের সম্ভাব্য খরচ দেখানো হয়েছে ২৪৪ কোটি ৭১ লক্ষ টাকা যার মধ্যে প্রতি কি.মি সিসমিক সার্ভের জন্য ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ খরচ ২৯ হাজার টাকা, বিস্ফোরক দ্রব্যের খরচ বাবদ ২৯ হাজার টাকা এবং মূল সার্ভের খরচ প্রতি কি.মি এ ৫ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা করে পড়বে।
অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রতি কি.মি সিসমিক সার্ভের জন্য খরচ পড়বে ৬ লক্ষ ৫৩ হাজার টাকা করে। অথচ এর আগে বাপেক্স ২০০১ থেকে ২০০৩ সালে বহুজাতিক টাল্লোকে প্রতি কি.মি ৩ লক্ষ টাকা হারে লালমাই-বাঙ্গুরা এলাকায় এই সিসমিক সার্ভে করে দিয়েছে এবং বাপেক্স নিজের জন্য যখন সিসমিক সার্ভে করে তখন প্রতি কিমি এ খরচ পড়ে ১ লক্ষ টাকা করে।
বাপেক্সের সংকট
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তুলনায় অনেক কম খরচে গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন ও বিক্রয় করা ছাড়াও বাপেক্স বা পেট্রোবাংলা নিয়মিত ভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ যোগান দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২শ কোটি টাকা, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে ৩১৫০ কোটি টাকা এবং ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩৩৪৯ কোটি টাকা , যার মধ্যে বাপেক্স দিয়েছে ৮২ কোটি টাকা এবং সবচেয়ে বেশী দিয়েছে বিজিএফসিএল- ১৪৩১ কোটি টাকা১০। অথচ এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত আপগ্রেড না করার ফলে এগুলোকে কাজ করতে হচ্ছে মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি, অপ্রতুল লোকবল এবং স্বল্প পুঁজি নিয়ে।
যে প্রক্রিয়া ও নীতি-কৌশলের মাধ্যমে এ সংকট তৈরী ও জিইয়ে রাখা হয় সে বিষয়টা একটু বোঝা দরকার।
ক) অপর্যাপ্ত, বিলম্বিত ও আংশিক বরাদ্দ
বাপেক্স মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করে একথা সবারই জানা। কিন' যে প্রশ্নটা তোলা হয় না তা হলো, যন্ত্রপাতি পুরাতন হয়ে গেছে, জীর্ণ হয়ে গেছে এ বিষয়টা জানা থাকার পরও কেন সমস্যাটি সমাধানের জন্য সময় মত নতুন যন্ত্রপাতি কেনা বা মেরামত করা হয় না, উল্টো যন্ত্রপাতি ও সক্ষমতার অভাবের কথা বলে বিদেশী কোম্পানিকে ডেকে আনা হয়!
একটা উদাহরণ দেয়া যাক। বাপেক্স মাত্র তিনটি রিগ নিয়ে কাজ করে। তিনটি রিগই পুরাতন ও জীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ১৯৯৮ সালে বাপেক্স একটি নতুন রিগ কেনার জন্য অপারেশান ক্যাপাবিলিটি স্ট্রেনদেনিং প্রকল্প নামের একটা প্রকল্প তৈরী করে এবং বাপেক্স বোর্ড কতৃর্ক সেটা অনুমোদিতও হয়।
তারপরে ১৯৯৯ সালে পেট্রোবাংলা বোর্ডও এটা অনুমোদন করে, একই বছরে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগও অনুমোদন করে। কিন্তু সেটা একনেক এ পাশ হতে হতে পার হয়ে যায় আরো ৪টি বছর অর্থাৎ ২০০৩ সাল। এখানেই কাহিনীর শেষ নয়, বলা যায় শুরু। একনেকে ৮১ কোটি টাকা অনুমোদিত হলেও দেখা গেল ততদিনে রিগের আন-র্জাতিক বাজারদর অনেক বেড়েছে এবং দরপত্রে অংশ নেয়া সর্বনিম্ন দাম ৩১% বেশী, অর্থাৎ ১০৬ কোটি টাকা। ফলে টেণ্ডার বাতিল হয়ে যায় এবং আবার সেটা দাম পুনর্মূল্যায়নের জন্য পাঠানো হয়।
১ম সংশোধিত বাজেট (১৪২ কোটি টাকা) আবার একনেক এ অনুমোদিত হতে হতে পার হয়ে যায় ২০০৬ সাল, এবং যথারীতি এবারেও টেণ্ডার মিস। এভাবে আরো কয়েকবার দরপত্র আহবান করে ও বাতিল করে অবশেষে পঞ্চমবারে ২৫৬ কোটি টাকা সংশোধিত বাজেট সহ ২০০৮ সালের নভেম্বরে দরপত্র আহবান করা হয় এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে একটি চাইনিজ কোম্পানির সাথে চুক্তি সম্পাদিত হয়। রিগটি দেশে এসে অপারেশনে যাওয়ার কথা ২০১১ সাল।
�এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রডাকশন ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব বাপেক্স� নামের আরেকটি প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। বাপেক্সের ক্যাপাসিটি বাড়ানোর প্রকল্পটির মোট বাজেট ৩৪০ কোটি টাকা হলেও বিজিএসএল এর জন্য ১৪০ কোটি এবং কেবল বাকি ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হওয়ার কথা বাপেক্সের জন্য যে টাকা দিয়ে বাপেক্স সিসমিক ডাটা একুইজিশন সিস্টেম কিনতে পারবে, একটি ওয়ার্ক ওভার রিগ কিনতে পারবে, অনুসন্ধান সাপোর্ট ইকুয়েপমেন্ট কিনতে পারবে, দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ট্রেনিং এরও আয়োজন করতে পারবে।
মাত্র ২০০ কোটি টাকা দিয়ে এত কিছু কেনা যায়, অথচ বলা হয় পুঁজির অভাবে নাকি জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা ও প্রযুক্তির উন্নয়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও বেসরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বছর বছর ২৫ টাকার গ্যাস ২৫০ টাকায় কিনে কিংবা ৩ টাকার বিদ্যুৎ ১৪/১৫ টাকায় কিনে সেসব কোম্পানিকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ার সময় কোন পুঁজির অভাব হয় না! আহ, এই ২০০ টাকাও যদি সময় মতো ছাড় করা হতো! প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল জুলাই ২০০৮ থেকে জুন ২০১১ সাল পর্যন্ত ধরা হলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যনত্ম জুন ২০০৯ সাল নাগাদ বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ৪৫ লক্ষ টাকা (বাপেক্স ও বাখরাবাদ অংশ মিলিতভাবে)!
খ) বিদেশী কোম্পানির তুলনায় কম অগ্রাধিকার
বাপেক্সের অবস্থা অনেকটা সেই কৃষকের মতো যে সারা বছর জমি চাষ করে, বীজ বুনে, নিড়ানি দেয় আর ফসল তোলার সময় এলে মহাজনের লোক এসে সে ফসল কেটে নিয়ে যায়। বাপেক্স এর কাজ হলো গ্যাস অনুসন্ধান করে দেয়া, উত্তোলন করে বিক্রি করার অধিকার তো কেবল বহুজাতিকের! নইলে বাপেক্স গঠনের পর থেকে হাজার হাজার লাইন কি.মি সার্ভে করলেও এবং অসংখ্য সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র আবিস্কার করলেও অনুসন্ধান কূপ খনন করার অধিকার পায় কেবল মাত্র ৪টিতে, অথচ এসময়ে আইওসিগুলো বাপেক্সেরই চিহ্নিত করা সম্ভাব্য গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে ১৭ টি। ১৯৯৬ সালের পর থেকে ২০০৯ সাল পর্যনত্ম মোট ১৩ বছরে বাপেক্সকে কূপ খনন করতে দেয়া হয়েছে মাত্র ১টি!
রাষ্ট্রের কাছে বাপেক্সের গুরুত্বের একটা নমুনা দেয়া যাক। ২০০৪ সালে শ্রীকাইলে বাপেক্স একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করে।
এই কূপটিকে পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে দেয়া তালিকায় গ্যাস আবিষ্কার সংখ্যা বলা হয় ৮টি, যেখানে শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্রের কোন নাম গন্ধই মেলে না। এখনই অবাক হবেন না, বা মনে করবেন না যে দু�টি তথ্যের কোন একটি ভুল। আসলে দুটিই সত্য। শ্রীকাইল কূপটি খনন করে সেখানে গ্যাস পাওয়ার সমস্ত অনুষঙ্গ মিলেছিল বলেই সেটাকে গ্যাস আবিষ্কার ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল পেট্রোবাংলা। কিন্তু পরবর্তীতে কূপ দিয়ে পানি আসায় সেটাকে বাতিল করা হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে গ্যাস পাওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পরেও সেখানে এখন পর্যন্ত বাপেক্স পরবর্তী কূপ খননের জন্য কোন উদ্যোগ নেয়নি এবং সেটাকে গ্যাসক্ষেত্র হিসাবে ঘোষণাও করা হয়নি।
মূল কারণটা আসলে অন্যত্র। এই শ্রীকাইল ক্ষেত্রটি টাল্লোর একটি গ্যাসক্ষেত্র বাঙ্গোরার খুব কাছে, এবং শোনা যায় শ্রীকাইল ও বাঙ্গোরা একই গ্যাসক্ষেত্রের অন্তর্গত। সুতরাং কি আর করা! বাপেক্সের কাজই বন্ধ হয়ে যায়। আরেকটি অভিযোগের কথা শোনা যায়, সেটা হচ্ছে বাপেক্সের জিওলজিস্টরা কূপটি খননের জন্য ঠিক যে জায়গা চিহ্নিত করেছিল, বহুজাতিক টাল্লোর স্বার্থে সেই কূপটি প্রসত্মাবিত জায়গার বদলে ভিন্ন একটি জায়গায় খনন করা হয়েছিল!
গ) দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা না করার নীতি
কৌশলটা নতুন নয়,এমনকি দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে এটা এখন আর কৌশলও নয়।
বিরাষ্ট্রীয়করণ এখন রাষ্ট্রীয় নীতিতেই পরিণত হয়েছে- সময় থাকতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বাড়ানোর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করে সংকট তৈরী করা হয় এবং পরে সেই সংকটের অজুহাতে বিদেশী বহুজাতিকের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ তুলে দেয়া হয়। নইলে প্রতিবছর গ্যাসের চাহিদা যে বাড়ছে সেটা তো অজানা নয়, তাহলে সেই বাড়তি চাহিদা মেটানোর জন্য বাপেক্স/পেট্রোবাংলার জন্য বাড়তি যন্ত্রপাতি ও মানবসম্পদ তৈরী করার কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হবে না কেন? ২০০৯ নয় সালে নেয়া �ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রামের� কথাই ধরা যাক। ২উ সিসমিক সার্ভের ক্ষেত্রে বাপেক্সের তো দক্ষতার ঘাটতি নেই, তাহলে এই কাজে বিদেশী কোম্পানির দরকার কেন? কারণ বাপেক্স নাকি বছরে ৩০০-৩৫০ লাইন কি.মি এর বেশী সার্ভে করতে পারে না। তাহলে সময় থাকতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় ও লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে সার্ভে করার ক্ষমতা বছরে ১০০০ লাইন কিমি এ উন্নীত করা হলো না কেন? হলো না কারণ তাহলে তো আর বিদেশী কোম্পানির হাতে কাজাটি তুলে দিয়ে কমিশন খাওয়া হবে না! লক্ষণীয় বিষয় হলো, এক্সপ্রেশান অব ইন্টারেস্ট বা ইওআই আহবান করার সময় ১০ বছরের অভিজ্ঞতা, দক্ষ লোকবল ইত্যাদি শর্তের কথা বলা হলেও ৩ বছর সময়ের মধ্যে কাজটি শেষ করতে হবে এ জাতীয় কোন শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়নি অথচ ৩ বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেই পুরো কাজটা বাপেক্সের বদলে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে! আবার বিদেশি কোম্পানির হাতে এভাবে কাজ তুলে দেয়ার অজুহাত হিসেবে পু্ঁজির অভাবের কথাও বলা হয় অথচ আমরা দেখেছি ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে জ্বালানী খাতে এডিপি ৩,৫৭৪ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২,৫২৮ কোটি টাকা করা হয়েছে স্রেফ কাজগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারার অজুহাতে। ফলে বোঝা শক্ত নয় শাসক দলগুলো মুখে দক্ষতা বাড়ানোর কথা বললেও বাস্তবে অদক্ষতা পুনরুৎপাদন করে চলেছে যেন সেই �অদক্ষতার� সুযোগে বিদেশী কম্পানির হাতে জাতীয় সম্পদ তুলে দেয়া যায়।
সম্ভাবনা ও প্রস্তাবনা:
দক্ষতা, যোগ্যতা, সক্ষমতা ইত্যাদি শুরু থেকেই কোন দেশের থাকে না, এগুলো আকাশ থেকেও পড়ে না, সুনির্দিষ্ট নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমেই এগুলো অর্জন করতে হয়। আজকে স্থলভাগে বাপেক্সের যতটুকু দক্ষতা সেটা যেমন ধীরে ধীরে অর্জিত হয়েছে তেমনি স'লভাগে যতটুকু সংকট ও সীমাবদ্ধতা এবং সমুদ্রভাগে যে অক্ষমতা সেটাও শাসক শ্রেণীর পরিকল্পনা কিংবা পরিকল্পনাহীনতারই ফল। একসময় মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস কিংবা ভেনিজুয়েলার পিডিভিএসএ এদের কারোরই গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কোন দক্ষতা ছিল না কিন্তু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় উপযুক্ত প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি আমদানী ও ট্রেনিং এর মাধ্যমে তারা সেটা অর্জন করেছে। তাহলে বাংলাদেশের সেটা না পারার তো কোন কারণ দেখছিনা!
আমরা মনে করি অন্য সকল ক্ষেত্রের মত জ্বালানী ক্ষেত্রেও জাতীয় সক্ষমতার কোন বিকল্প নেই এবং এর জন্য দরকার হলো গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় বাপেক্স ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আপগ্রেড করা। এ লক্ষ্যে আমাদের দাবিগুলো হচ্ছে:
১।
ভবিষ্যতে দেশের অভ্যন-রে এবং উপকূলে অবসি'ত ব্লকসমূহে অনুসন্ধান ও উৎপাদন কাজ শুধুমাত্র বাপেক্সের উপর ন্যাস্ত করতে হবে। সকল পিএসসি বাতিল করতে হবে।
২। বাপেক্সকে আরও দক্ষ ও শক্তিশালী করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে যেন স'লভাগের মতো গভীর সমুদ্রেও দেশীয় কোম্পানীগুলো নিজেরাই তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্য চালাতে পারে। মধ্যবর্তী সময়টুকুতে একটি বা দু�টি ব্লক থেকে কাজ চালানোর মতো গ্যাস উত্তোলনের জন্য বাপেক্সের কর্তৃত্ত্বাধীনে দেশী-বিদেশী কন্ট্রাক্টর ও যন্ত্রপাতি ভাড়া করা যেতে পারে।
৩। বাপেক্সের জন্য প্রয়োজনীয় রিগ ও অন্যান্য সরঞ্জাম অবিলম্বে সরবরাহ করতে হবে।
৪। বাপেক্সের কারিগরি জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধির নিমিত্তে দেশ-বিদেশে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কারিগরি জনবলকে উপযুক্ত মর্যাদা ও গুরুত্ব দিতে হবে।
৫। বাজেটে বাপেক্সের জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে করতে হবে। এই বরাদ্দ একনেক এ অনুমোদন ও বাপেক্সকে প্রদানে অহেতুক সময়ক্ষেপণ বন্ধ করতে হবে। বাপেক্স ও পেট্রোবাংলা তথা পেট্রোবাংলার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আয় সরাসরি বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন প্রকল্পে সরাসরি বরাদ্দ করার সুযোগ দিতে হবে।
৬।
মূল সংস্থা পেট্রোবাংলাকে দক্ষ ও শক্তিশালী করতে হবে।
৭। গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন নিয়ে সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকতে হবে। বাপেক্সের অধীনে সমস- বাংলাদেশে জিওলজিক্যাল সার্ভে কাজ সম্পন্ন করার একটা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে, বাপেক্সকে দিয়ে বছরে কতটি অনুসন্ধান কূপ খনন করানো হবে- তারও একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে। এবং এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য সময়মতো প্রয়োজনীয় রিগ, যন্ত্রপাতি কিনতে হবে- অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে, লোকবল নিয়োগ ও তাদের দক্ষতা বাড়িয়ে তুলতে হবে।
(এই পোষ্টটি মুলতঃ কনোকো-ফিলিপস এর হাতে তুলে দেয়া হলো সাগরের গ্যাস ব্লক ১০ ও ১১ সংবাদের প্রেক্ষিতে)
সূত্রঃ । http://protectresourcesbd.org/news_details.php?id_news=29
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।