আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রামের বাড়ীর পথে

বুদ্ধিজীবী হতে ডিগ্রী লাগেনা। ২৫ শে রমজান, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০, সোমবার। ৪২ দ্দিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেল। রোজার ছুটি। ছুটির দিনগুলোর বেশিরভাগ কাটিয়ে দিলাম চালনাতে।

প্রতিদিনের গদবাঁধা একই রুটিন। ভোর রাতে সেহেরী খেয়ে ঘুম, ঘুম থেকে উঠেই কম্পিউটারের সামনে বসা। নেট ঘাটাঘাটি। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া। বিকেলে নদীর পাশে গিয়ে বসি।

খোলা আকাশ, মুক্ত বাতাস আর আমি। দিগন্ত রেখার দিকে চেয়ে চেয়ে পার করি সময়। ইফতারীর আগে বাসায় ফিরি। লেবু চিপে চিনি মিশিয়ে সরবাত বানাই, ছোলা-মুড়ি মাখাই, আম্মার বানানো পেঁয়াজু বেগুনী দিয়ে ইফতারীর টেবিল সাজাই। কোন না কোন ফল থাকে।

সেগুলোকে কাটি। আব্বু আম্মু আর আমি এক সাথে বসে ইফতারী করি। ফিরোজ মসজিদে যায় ইফতারি করতে। আমাদের এলাকায় এখনো মসজিদে রোজাদারদের ইফতারি করানোর সিস্টেম টিকে আছে। নানি মাস কয়েক খুলনায় ছিলেন ছোটখালার বাসায়।

খালার ছেলে হয়েছে। ২৩ রোজায় নানী আমাদের এখানে এলেন। নানী বাড়ী ফেরার জন্য উদগ্রীব। ২৫ রোজায় নানীকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের বাড়ীর পথে। আমার গ্রামের নাম ভাগবাহ।

সুন্দরবনের খুব কাছে, কয়রা থানার ভিতর পড়েছে। চালনা থেকে লঞ্চে করে যেতে হয় আমার গ্রামের বাড়ীতে। সাড়ে বারোটায় লঞ্চ ছাড়ে আর পৌঁছে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে। নদীপথে ভ্রমণে পথের দূরত্বের চেয়ে সময়ের দূরত্বটাই বেশী। আসরের দিকে আমরা কাঠালতলার বাল্লায় পৌঁছলাম।

এখানে কোন ঘাট নেই। ঘাট গিলাবাড়ী। গিলাবাড়ী গেলে আবার উলটা আসতে হয় অনেকটা পথ। মাঝ নদীতে লঞ্চের গতি স্লো করা হয়। পাড়ে থাকানোকার মাঝিরা এসে যাত্রী নামিয়ে নেয়।

আমাদীরর এলাকায় এভাবে যাত্রী নামানোকে বলা হয় টবর করা। এইটুকু পথ যেতে মাঝিরা সাধারনত ১ টাকা নেয়। কিন্তু এখানকার মাঝিরা নেয় ৫ টাকা। নৌকায় করে আমরা চারজন নামলাম। আমাদের গ্রামের দুজন হিন্দু মানুষ।

আমি চিনিনা। নানী চেনে। খুলনা থেকে কচকেটের বাক্সে করে ইলিশ মাছ এনেছে। বাল্লায় বসে বিক্রি করবে। তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী দামে বিক্রি করে।

আমাদের এলাকায় ইলিশ মাছ খুব একটা সহজলভ্য নয়। উঠতি পয়সাওয়ালারা বেশি দামেই মাছ কিনে কানকোতে দড়ি ঝুলিয়ে দশ জনকে দেখাতে দেখাতে বাড়ি ফিরবে। মুদি দোকানের সামনে বসা কেউ না কেউ ইলিশ মাছের দাম জিজ্ঞেস করবে। ইলিশের মালিক গরবের সাথে দাম বলবে। বুক ফুলিয়ে সে নিজের রাস্তায় হেঁটে যাবে।

বসা লোকদের মধ্যে কেউনা কেউ বিরস মুখে বাজারে ইলিশের চড়া দাম নিয়ে সমালোচনা করবে। বয়স্কদের মধ্যে কেউ তার ছেলেবেলায় ইলিশ কত সস্তা ছিল সেই গল্প জুড়বে। অন্যেরা মন দিয়ে শোনে। এটাই চিরন্তন গ্রামীণ জীবন। ডাঙ্গায় উঠে আমি থমকে গেলাম।

বাল্লা থেকে আমাদের বাড়ী কিলো দেড়েক দূর হবে। আমাদের জন্য ভ্যান আসার কথা ছিল। আসে নাই। কয়েকবছর হল গ্রামের মাটির রাস্তার বুকে ইট বিছানো হয়েছে কিন্তু যোগাযোগের মাধ্যম এখনো সে চরণ বাবুর সাইকেল। কালে ভদ্রে ভ্যান, মোটর সাইকেল কিংবা নসিমন এর দেখা মেলে।

কিন্তু গ্রামের মানুষ এখনো এসবের খুব একটা তোয়াক্কা করে বলে মনে হয়না। পায়ে হাটঁতেই তারা স্বাচ্ছন্দ বোধ করে বলে আমার ধারণা। আজ কিছুই পেলাম না। নানীর ইয়াবড় ব্যাগ। তার উপর গোটা চারেক কুলা আরো হাবিজাবি কিসব।

আমার নিজের ব্যাগও আছে। উপায় না পেয়ে বড় মামাকে ফোন দিলাম। মামা একখানা চলতি মোটর সাইকেল পেয়ে পাঠিয়ে দিলেন। আমার দাদাবাড়ী নানাবাড়ী এক গ্রামে। ছোটকাল থেকে গ্রামে এলে আমি সবসমই নানাবাড়ী ঘুমাই।

জানিনা কেন। ফিরোজ আমার ঠিক উল্টোটা। ও সবসময় দাদাবাড়ী ঘুমায়। নানাবাড়ী থেকে মিনিট দুয়েক পথ পেরুলেই দাদাবাড়ী। নানাবাড়ী কিছুক্ষন বসে, নানাজানের কবরকে সালাম দিয়ে দাদাবাড়ী গেলাম।

কে কেমন আছে কুশল জেনে বারান্দায় রাখা দাদাজানের খাটের উপর উঠে বসলাম। বাড়ী আসলে সবাই ঘিরে বসে। এই আন্তরিকতা আমার কত ভাল লাগে তা তমাকে বলে বোঝাতে পারব না। পাশে ছোট দাদার শরীক। তারাও ছুটে আসে।

এ এক অম্লান প্রাণের টান। এ অনুভূতি কলমের ভাষায় লিখে প্রকাশ করা যায় না। আব্বু-আম্মু দাদা-দাদীর জন্য ঈদের কাপড় কিনে দিয়েছেন। নানীর কাপড় নানীকে পরিয়ে নিয়ে এসেছি। আমার খুব ভাল লাগে, আব্বু সবসময় দাদী এবং নানীকে একই দামের কাপড় দেন, তার সাধ্যে যতটা কুলায়।

ছোট খালুকে দেখেছি গত ঈদে নানিকে এক খানা কাপড় দিয়েছে কিন্তু তার নিজের মাকে দিয়েছে দুইটা। এটা তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আমি গরবিত, আমার পিতা এই বিষয়ে অনেক উদার। ভবিষ্যতের জন্য কিছু হলেও তো শিখলাম। সন্ধ্যার আলোর জ্যোতি কম থাকে।

দাদাজান আজকাল চোখে অনেক কম দেখেন। কাপড়ে বারবার হাত বুলিয়ে দেখেন আর খুশিমনেই বলেন এত দামি কাপড় আনার দরকার কি ছিল। কাপড় কেনার আগে দাদাজানকে ফোন করেছিলাম, কি রঙের কাপড় আনব। দাদাজান বলেছিলেন সাদা রঙের। পাশ থেকে দাদী বলে উঠলেন সাদা কাপড় শুধু ময়লা হয়।

তখন দাদা বললেন ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবির কাপড় আনতে। ঘিয়ে রঙের সিট এনেছি পাঞ্জাবীর। দাদাজানের মুখ বলে দিচ্ছে তিনি অনেক খুশী। দরজির দোকান অনেক ভীড়। দাদাজান নিজেই বললেন পরে একদিন তিনি বানিয়াখালী গিয়ে পাঞ্জাবী বানিয়ে আনবেন।

দাদীর মুখ দেখে বোঝা যায় না, দাদীজান খুব সম্ভবত খুষীর এক্সপ্রেশান করতে জানেন না। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন হয়েছে দাদী? দাদী হেসে বললেন, ভালো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।